আমার মেয়েবেলা
(অঙ্ক পর্ব)
জীবন মানেই আমার কাছে ফেলা আসা আমার সেই শৈশব, কৈশোর,,,
আমার সেই সুন্দর মেয়েবেলা।
আর মেয়েবেলা লিখতে বসলেই আমার একটাই নাম মনে আসে।
“ফরাক্কা”
হ্যাঁ যে কোন কথা বলতে গেলেই ফরাক্কার কথা মনে পড়ে যায়। আমার মেয়েবেলার সবটুকুই জড়িয়ে আছে এই ফরাক্কাকে নিয়েই।এখানেই আমি আমার জীবনে সবথেকে বেশি আনন্দ পেয়েছিলাম। জীবন টাকে পরিপূর্ণ রূপে উপভোগ করেছিলাম।
ফরাক্কার কথা মনে হলেই আমার বুকের ধুকপুকুনি, একটু যেন বেড়েই যায় । কানটা কেমন গরম হয়ে আসে । চোখটা ঝাপসা হয়ে যায় । একটা যন্ত্রণার ছুরি যেন , বুকের ভেতরটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। ঢোঁক গিলে যন্ত্রণা সহ্য করতে গিয়ে দেখি গলায় ব্যথা করছে, বুঝতে পারি মনের ভেতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে,, রক্তাক্ত বিধ্বস্ত আমি তখন সামলাতে গিয়ে আরও বেসামাল হয়ে যাই। আকাশে খুঁজতে থাকি আমার প্রিয় মানুষ গুলোকে, চোখ বন্ধ করে আমার ফরাক্কার স্মৃতিতে হাত বোলাই, কান্না গিলতে থাকি, কিন্তু একসময় আর পারিনা, ডুকরে কেঁদে উঠি। গলায় অব্যক্ত যন্ত্রণার খোঁচায়, নাকি সব হারিয়ে যাওয়ার কষ্টে,,, সেটা বুঝতে না বুঝতেই বর্তমান এসে ডাক দেয়। আঁচলে চোখ নাক আমার ভেজা গাল মুছে, আবার শুরু করি ভালো থাকার অভিনয়, এই বর্তমানেরই সঙ্গে।
জীবন তো এমনই। সইতে হয়, মানতে হয়। নিজের কষ্টকে গিলতে হয়, বুক ফাটা কান্নাগুলো হাসির আড়ালে ঢেকে রাখতে হয়। সবকিছু গিলতে শেখাই হল সংসার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা। তা না হলে কিসের মেয়েমানুষ?
একথা অবশ্য আমি শিখে ছিলাম সেই ছোট্ট বেলায়, মায়ের কাছ থেকে, আমার ঠাকুমার কাছ থেকে, পরবর্তীতে অবশ্যই শাশুড়ি মার থেকে।
ছোট থেকেই শুনে এসেছি, যে সয় সেইই রয়। মানে সংসারে সে ই থাকে, যে সইতে পারে।
আমাদের মেয়েদের, সংসারে টিঁকে থাকাটাই হল মুখ্য, কেমন ভাবে টিঁকে আছি সেটা বড়ো কথা নয়। এভাবেই আমরা মেয়েরা এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে এই ধারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমি যেমন শিখে এসেছি সেই রকমই মেয়েকে শেখাচ্ছি। আবার আমার মা ঠাকুমারাও তাই শিখে এসেছেন। যে করেই হোক বিয়ের পর সংসারটা টিঁকিয়ে রাখতে হবে। এবং এই টিঁকিয়ে রাখার দায়িত্ব শুধু মেয়েদেরই। তবে এখন সমাজ অনেকটা আধুনিক হয়েছে। কিন্তু আমাদের মানসিকতা ততটা আধুনিক হয় নি বলেই আমার বিশ্বাস। এখনও ঘর ভাঙলে প্রথম দোষারোপের আঙুল ওঠে, সেই মেয়েটির দিকেই। যাকগে যা বলছিলাম-
এই ফরাক্কাতেই আমার প্রথম স্কুলে যাওয়া, বড়ো হয়ে ওঠা। আমি এখানেই আমার জীবনের সব আনন্দটুকু নিংড়ে নিয়ে ছিলাম।
তাই কিছুতেই যেন ফরাক্কাকে ভুলতেই পারি না।
ফরাক্কা মানেই
চারিদিক কুয়াশায় ঢাকা, কিছুটা অস্পষ্ট,, মায়াবী রূপকথার দেশ।
এখানের গঙ্গা চঞ্চলা, দাপিয়ে ছুটে চলেছে নিজের গন্তব্যে। আর এর পরেই মনের মানচিত্রে উঁকি দেয়, আমাদের সকলের প্রিয় সেই গঙ্গার ধার।
স্টেশন থেকে গঙ্গার ধার বরাবর একটা সোজা রাস্তা ব্রিজের 109টা গেট পেরিয়ে চলে গেছে মালদা,,, মানে উত্তরবঙ্গের দিকে,,,
আর একটা রাস্তা বাঁদিকে চলে গেছে।
মানে 11 টা গেটের কাছে গাড়িটা বাঁ দিকে বাঁক নিতেই মনের ভেতরটা কেমন নেচে উঠে। ১১টা গেট টপকেই ফরাক্কা টাউনশিপ শুরু হয়।
সেই গঙ্গার ধার ঘেঁষেই
একটু এগোতেই চোখে পড়ে ডান দিকে সেই বড় ঝুড়িওলা বুড়ো বটগাছ!!! এখনও ঠিক তেমন ভাবেই দাঁড়িয়ে!!
সিমেন্টে বাঁধানো বসার জায়গা,,দু ধারে সারি সারি গাছের মাঝে, পরিষ্কার পিচ ঢালা রাস্তা!! কত কতওওও স্মৃতি!!!
সেখানে কারোর মন ভেঙেছে তো কারোর জুড়েছে। কারো প্রথম সিগারেটের সুখটান এখানেই, বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম প্রেমপত্র পড়ার যে সুখস্মৃতি! আবার কখনও দুজনের ঘর বাঁধার পরিকল্পনা, তো আবার কারোর শেষ দেখার সেই অভিমান,,,,, সব বুকে নিয়ে এখনও সেই বটগাছ আর এই গঙ্গার ধার তেমন ভাবেই রয়েছে।
ওখানেই আমার মেয়েবেলার স্বর্ণযুগ শুরু হয়েছিল। ওখানেই প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম আমিও।
মেয়েবেলার সবথেকে বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে আমার স্কুল যা সেই সময় আমাদের সবার কাছে বেশ আকর্ষণীয় ছিল। কারণ সেই সময়ে স্কুল ছাড়া আমাদের আর সেরকম কিছুই ছিল না। ছোট্ট বাজার, একটা ছোট্ট হাসপাতাল, রিক্রিয়েশন ক্লাব-সেখানে যাবতীয় অনুষ্ঠান হতো, আর বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রবি এই চারদিন সিনেমা দেখানো হতো । একই সিনেমা চারদিন ধরে। যার যে দিনটা সুবিধে হত, সে সেই দিনের টিকিট কেটে রাখত। মাসের প্রথমেই চারটে সপ্তাহের টিকিট একসঙ্গেই কাটা হত।
আমার প্রথম সিনেমা দেখা যে বার আমি মাধ্যমিক দেব।
বাবা একটা টিকিট হাতে ধরিয়ে বলল এত অংক করে মাথাটা তো গুলিয়ে যাবে। অংকে পাশ করতে হবে তো? রবিবার তিনটে থেকে ছটা তোর ছুটি। সিনেমা দেখতে যাস।
হ্যাঁ মাধ্যমিকে অংকে পাশ করাটা আমার কাছে প্রচন্ড্ একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রি টেস্টে অংকে পেয়েছিলাম ৯। আর টেস্টে আরও মন দিয়ে অংক করে পেলাম ৭।
অংকের স্যার(SRG শান্তি রঞ্জন ঘোষ ) টেস্টের রেজাল্ট বেরোনোর পর আমাকে ডাকলেন। কিন্তু একটুও বকলেন না। আমি লেখাপড়ায় অত ভাল ছিলাম না। ইতিহাস ভূগোল কিংবা বাংলায় যতই ভাল নম্বর উঠুক, অংকে ভাল না হলে সেই সময় তাকে ভাল স্টুডেন্ট হিসেবে গন্য করা হতো না। তাই অংকে ফেল আমি পড়াশোনায় সাধারণই ছিলাম। তবে অত অত ঝুড়িভর্তি নম্বর না পেলেও আমাকে কিন্তু সব টিচার রাই খুব ভালো বাসতেন। যাইহোক এস আর জি স্যার ডেকে পাঠালেন। কাঁচুমাচু মুখে স্যারকে বললাম আমার অসুবিধের কথাটা। “স্যার আমার অঙ্ক করতে একদমই ভালো লাগেনা। কীযে করি!” আরও যে কত কিছু বলেছিলাম!
“স্যার আমি বড় হয়ে ল পড়ব। অঙ্ক আমার জন্য নয়। জীবনের অনেক হিসেবই তো মেলাতেই পারছি না। অঙ্ক কী মেলাব?
স্যার আমার কথা খুব মন দিয়ে শুনে বললেন, “অন্তত কুড়ি তো তোল তাহলেই তো আর কোন দিন অংক করতেই হবে না। আর অংকে ফেল করলে আবার অংক করতে হবে।”
স্যারের কথা শুনে মাথাটা কেমন বোঁ করে ঘুরে উঠল। আবার অংক! উরি বাবা সেতো ভীষণ একটা ব্যাপার।
আমাদের সময়ে যেকোন বিষয়ে মিনিমাম কুড়ি পেলেই হত। সেই গ্রুপের অন্য বিষয়ে বেশি নম্বর পেয়ে গ্রুপে পাশ করে গেলেই আর কোনও সমস্যা নেই। আমি জীবন বিজ্ঞান আর পদার্থ বিজ্ঞানে (ফিজিকাল সায়েন্স ) বেশি তুলে ম্যানেজ করে নিতাম।
আসলে আমার প্রধান সমস্যা ছিল আমি একদমই পছন্দ করতাম না এই অঙ্ক সাবজেক্টটাকে। ভালোবাসা না হলে সেই বিষয়টা মাথায় ঢুকবে কী করে?
পরীক্ষার সময় অংক করতে শুরু করলেই আতঙ্কে আমি জানা অংক ভুল করতাম। আবার অংক টা ঠিক করলেও ভুল হয়েছে ভেবে অঙ্কটা কেটে বাড়ি চলে আসতাম। বাবা বলত কাটলি কেন? ভুল হলে কি তোকে কেউ মারত? কিন্তু পরের পরীক্ষায় সেই আমি, আবার ঠিক অংকটাই কাটতাম। আসলে আমি ভাবতাম যেটুকু করব ঠিক করব। খাতায় ঘ্যাঁচঘুঁচ কাটা চিহ্নটা দেখতে একদমই ভাল লাগত না।
###
ছোট থেকেই ঠিক হয়ে ছিল আমি ল’ পড়ব।বাবা মার খুব ইচ্ছে। বিশেষ করে আমার মায়ের স্বপ্ন ছিল মেয়ে আমার উকিল হবে।
আমিও জানতাম ওকালতি পড়তে গেলে অংক লাগে না। তাই সেই পড়ায় কোনও টেনশন নেই।
সেই ছোট্ট বয়স থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম, কালো কোর্ট গায়ে দিয়ে আমি এজলাসে কথার ফোয়ারা ছোটাচ্ছি। তখন থেকেই মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করেছি। ভয় পেলে চলবে না। মাথা উঁচু করে চলতে গেলে নিজেকে সৎ থাকতে হবে। সত্যি কথা বলতে ভয় কিসের? তাই অন্যায় দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়। আর একটা জিনিস খুব ভাবতাম , যেভাবেই হোক আইনের ফাঁক বার করে আমাকে জিততেই হবে,,,
খুব গোপনে এইভাবে নিজেকে তৈরি করতে লাগলাম। কিন্তু কেউ কোনো দিন টেরই পায় নি। একটা তের চোদ্দ বছরের মেয়ের যতটা ম্যাচুইরিটি থাকা উচিত
কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার থেকে অনেক বেশিই ম্যাচুইরিটি ছিল আমার। যেটা সেই সময় আমার জন্য একদমই ভাল ছিল না। আমি কিন্তু সেই বয়স থেকেই প্রচন্ড ফ্রাসস্ট্রেশনে ভুকতাম। অন্যায় সহ্য করতে পারতাম না। কিছু বাবার অন্যায়, কিছু মায়ের,,, আর এসব দেখতে দেখতে নিজেকে ঐ বয়সেই মনের মধ্যে আর একটা গোপন সত্তা তৈরি করে নিয়েছিলাম। কিন্তু সে খবর কেউ জানতেই পারে নি।
আমি কিন্তু কোনও দিন আমার সবটা কারোর কাছে শেয়ার করি নি। আমি হেসে খেলে বেড়ালেও মনের মধ্যে যে অন্য কিছু চলত সেটা কাউকে কোনও দিন বুঝতেই দিই নি। কিছুটা বাবা বুঝতে পারত। তবে সবটা নয়। আমি ছিলাম একদম শামুকের মতো। বাইরে থেকে কারোর বোঝার ক্ষমতা নেই আমার ভিতরে কী চলছে। আজও এত এত বন্ধু পরিবৃত্ত হয়েও আমি ঠিক সেরকমই আছি। একদম একা,,,
আমার প্রিয় বন্ধু আমি নিজেই। যেখানে আমি একটা খোলা আকাশের মতো…
ক্রমশ…