• Uncategorized
  • 0

গল্পবাজে ড. ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

শিকড়ের টান

অবশেষে এ বাড়ি চলে গেল প্রোমোটারের হাতে। সবথেকে বেশি অসুবিধা সুশোভনের , চার ভায়ের মধ্যে সবার ছোট সুশোভন।বড় ডাক্তার,মেজ উকিল ,সেজ কনট্রাক্টর । তিনজন ই প্রতিষ্ঠিত। রায় ভিলার তিন তলায় এই তিন ভাই সংসার নিয়ে থাকেন।চারতলায় বিশাল ছাদ। চিলেকোঠার ঘর, সঙ্গে লাগোয়া কলঘর , ওখানে ই থাকে সুশোভন, আত্মীয়স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাই তাকে বলে উড়নচণ্ডী।খানিকটা হয়তো ঠিকই বলে ,বিয়ে করে নি, সংসারের চিন্তা নেই, আয় ব্যয়ের কোন হিসাব নেই।আর্ট কলেজ থেকে পাস করে কোনো উপার্জনের চেষ্টা ও করল না। শুধু রঙ তুলি ইজেল ক্যানভাস নিয়ে সারাদিন বুঁদ হয়ে থাকে। কখনো মাটির মূর্তি গড়ে মগ্ন হয়ে।স্নান খাওয়ার কোন হুঁশ থাকে না। একটা এন জি ও তে বস্তির ছেলে দের আঁকা শেখায়।তার জন্য কোন পারিশ্রমিক নেয় না, ওদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা তুলে ধরাই ওর ধ্যান জ্ঞান। তবে সব থেকে প্রিয় সঙ্গী হল অজস্র পায়রা। সকাল হলেই ওদের খাবার দেয় আদর করে ।সাদা কালো , ধূসর নানা রঙের পায়রা ছাদময় হেঁটে বেড়ায়।কখনো কোলে এসে বসে, ছবি আঁকতে আঁকতে হাত বুলিয়ে দেয়। ওদের বক বকম শুনতে শুনতেই সরস্বতীর মূর্তি তৈরি করেছিল গত বছর, সবাই কে হতবাক করে দিয়ে সেটাই এ শহরের শ্রেষ্ঠ মূর্তি র পুরস্কার পেয়েছে। আবার যখন মন উচাটন , তখন ওদের খাবার সাজিয়ে রেখে ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বিমূর্ত কোন শিল্পের সন্ধানে।তাই বড় তিন ভাই বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে কোনো প্রয়োজন মনে করেনি তার সঙ্গে আলোচনার।
খবরটা শুনে বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল সুশোভনের। ছাদের পায়রাগুলো র কি হবে তাহলে কি খাবে ওরা? অবশ্য সুশোভনের দুশ্চিন্তার বিষয় সকলের হাসির খোরাক হয়ে উঠল। কাউকে সমস্যা বোঝাতে ই পারলো না। কাছেই একটি ভাড়া বাড়িতে পুরো রায় পরিবার এসে উঠলো। নতুন নিজস্ব আবাসন হলে প্রত্যেকে নিজের নিজের ফ্ল্যাট পাবে। সুশোভন কেয়ার টেকারের বাড়ি আসে পরদিন। কেয়ার টেকার শিবু খুব সাধাসিধে লোক। ওর চার বছরের ছেলেকে ভালবেসে আঁকা শেখায় সুশোভন। মিস্ত্রিদের দেওয়াল ভাঙার শব্দে বুকের মধ্যে যেন মুগুরের ঘা পড়ে। পায়রা গুলো ভয় পায় ডানা ঝাপটায়। মুখে দু হাত ঢাকা দিয়ে বসে থাকে সুশোভন। শিবু বলে – দাদাবাবু, আপনি কিছু দিন এদিকে আসবেন না। নতুন বাড়ি তৈরি হলে তবে আসবেন। পায়রা গুলো উড়ে গেলে ই ভালো হবে। যাক চলে যাক।
ওখানে থেকে আর ভাড়া বাড়িতে ফেরেন নি সোজা চলে গেছে মুর্শিদাবাদ পীর ফকিরের মেলা।
বড়দার ফোন পেয়ে নতুন ফ্ল্যাটবাড়ির গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে এল। ঝাঁ চকচকে নতুন আবাসন নাম সিন্ডারেলা, সামনে পার্ক, সুইমিং পুল,ছাদে মরসুমি ফুলের গার্ডেন আরো কত কি। পার্কে ঢোকার মুখে বাহারি শিব মন্দির।শিবের মাথায় অবিরত ঝর্ণার জল পড়েই যাচ্ছে। মৃদু স্বরে গান হচ্ছে জয় জগদীশ হরে। চারদিকে বৈভব আর বিলাসিতার ছড়াছড়ি।তিনতলার পুব দিকে এক রুমের ছোট ফ্ল্যাট পেয়েছে সুশোভন। মনে হচ্ছে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। লিফ্টে সাত তলার ছাদে উঠে দেখে সুন্দর একটি মরসুমি ফুলের বাগান,কর্তব্যরত এক মালী। সুশোভন খোঁজ নেয় – আচ্ছা এখানে পায়রা আসে?
— না না স্যার কী রে বলেন, আমি কড়া পাহারায় থাকি কোন পাখি এসে ছাদ নোংরা করতে পারবে না।কত দামী দামী গাছ,ফুল।
সুশোভন মুখ চূণ করে নিজের ঘরে আসে। ভালো লাগছেনা একদম। এভাবে বাঁচা যায়না। নেমে আসে শিবুর বারান্দায় খাটিয়ার উপর বসে থাকে ঝুম হয়ে।শিবু জানতে চায় – দাদাবাবু কি হয়েছে?মন খারাপ? ঘর পছন্দ হয় নি?
— শিবু আমি এখানে থাকতে পারবো না, আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
— যাবেন দাদাবাবু আমাদের গেরামের বাড়ি? টেরেনে যাবো চল্লিশ মিনিট। ওই বাড়ি তো ফাঁকা পড়ে আছে, থাকবেন?পাকা ঘর আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। চলুন তাইলে আমি সাফসুতরো করে দে আসি। আজ আমার ছুটি।
চলো তবে , আমার ঝোলা খানা নিয়ে আসি।
পলাশডিহা স্টেশনে নামে। দুপাশে সবুজ ধানের শিষ মাঝখানে আলপথ দিয়ে হাঁটতে থাকে। মৌরী ফুলের গন্ধ ভেসে আসে। ভালো লাগায় মন ভরে যায় সুশোভনের। এর জন্য ই বোধহয় ওর মন এতদিন উন্মুখ হয়ে ছিল। ওর কেবলই মনে হতে লাগলো এবার থিতু হই ,সংসার করি, কারুর কাছে আশ্রয় নি, বুকে মাথা রাখি.. নরম মাটিতে শিকড় ছড়িয়ে দেবার সময় হয়েছে ….. মিঠে রোদের ওম মেখে শিস দিতে দিতে হাঁটতে থাকে সে মেঠো পথ ধরে ……
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।