• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায় (পর্ব – ৩)

গোলকচাঁপার গর্ভকেশর

“তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও, বারান্দায় বেরিয়ে সবার সাথে হাততালি দিতে হবে তো।”,মায়ের ঘরে ঢুকে মিষ্টি হেসে বলল দেবাঙ্গী।
বিরক্তি ভরা মুখ নিয়ে খাটের ওপর জবুথবু হয়ে বসেছিল কোকিলাবেন। দেবাঙ্গীকে দেখে এবার একটু নড়েচড়ে বসার চেষ্টা করল, মুখের ভাবে প্রকাশ করে দিল মনের অসন্তোষ। প্রতি রবিবার বিকেলে নিয়ম করে কোকিলাবেনের ব্লাড-প্রেসার মেপে দেয় দেবাঙ্গী। কোকিলাবেন যখন সচল ছিল তখন দেবাঙ্গীর সাথে দু’তিন মাস অন্তর ডাক্তারের চেম্বারে যেতো রুটিন চেক-আপের জন্য। শয্যাশায়ী হওয়ার পর মায়ের নিয়মিত চেক-আপের জন্য ব্লাড-প্রেসার মনিটর, গ্লুকোমিটার-এর মতো ছোটখাটো মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টগুলো দেবাঙ্গী বাড়িতেই কিনে রেখেছে। সময়মতো নিজেই ডাক্তারি করে মায়ের ওপর। কোকিলাবেন ভেবেছিল আজও সে জন্যই এসেছে দেবাঙ্গী। কিন্তু দেবাঙ্গীর কাছ থেকে, সাজগোজ করে বারান্দায় গিয়ে হাততালি দেওয়ার প্রস্তাব শুনে মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল কোকিলাবেন,”আমি গিয়ে কি করবো ? আমার ও সব ভালো লাগে না। তুই যা”
মায়ের কথা গায়ে না মেখে দেবাঙ্গী একমনে নিজের কাজ করে যেতে লাগলো; চুল বেঁধে দিয়ে, গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে কোকিলাবেনকে বসিয়ে দিল হুইলচেয়ারে। তারপর চেয়ারটা ঠেলতে ঠেলতে বেরিয়ে এল বারান্দাতে।
এতো আতঙ্ক, এতো মৃত্যুমিছিলের মধ্যেও কেমন একটা আনন্দ-উৎসবের পরিবেশ চারিদিকে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল দেবাঙ্গী। আজ ভীতিকে ছাপিয়ে গিয়েছে ফুর্তি। দূরের ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে বড়দের সাথে থালা-বাটি হাতে বাচ্চাদের আবছা অবয়ব। ওদের সামনের ‘বি’ বিল্ডিং-এ একগাদা চেনা মুখের ভিড়। মাঝবয়সী অলকা পাটিল, আধবুড়ো ইউসুফ ফারুকি, কমবয়সী দম্পতি প্রিয়াংকা আর প্রানেশ, স্বাস্থ্য সচেতন কর্নিলিয়াস মাসকারানাস সবাই অপেক্ষা করে আছে, কখন পাঁচটা বাজাবে। অলকা পাটিল হাত নাড়ালো দেবাঙ্গীর উদ্দেশ্যে, স্বামী বিকাশ পাটিল আর ছেলে রোহিতকে নিয়ে অলকা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে হাততালি দেওয়ার জন্য। দেবাঙ্গীও অল্প হেসে হাত নেড়ে নিয়মমাফিক ফিরতি বার্তা দিল অলকাকে। এবার সামনের দোতলায় চোখ পড়তেই আশিষকে দেখতে পেল দেবাঙ্গী। আশীষ সপরিবারে বারান্দায় চলে এসেছে। সবিতা আন্টি মানে আশিষের মা কি যেন হুকুম করছে ওর রুগ্ন বউটাকে। বউটা এক দৌড়ে ঘরের ভেতর চলে গেল শাশুড়ির হুকুম তামিল করতে। আশিষের রোগা রোগা ছেলেমেয়ে দুটো মনের আনন্দে একবার ঘরের ভেতর যাচ্ছে আর একবার বারান্দায় বেরোচ্ছে। আশিষ আনমনা ভাবে তাকিয়ে আছে গোলকচাঁপা গাছটার দিকে। হলুদের ছোঁয়া লাগানো সাদা সুগন্ধী ফুলে ভরে আছে বুড়ি গাছটা, এখান থেকেও ফুলগুলোর মন মাতানো গন্ধ টের পাচ্ছে দেবাঙ্গী। ও আনমনা হয়ে ভাবে, ওর মতো আশিষও কি এই গোলকচাঁপা ফুলগুলোর মন মাতানো গন্ধ অনুভব করতে পারছে ? আশিষের মনেও কি দোলা দিচ্ছে এই বসন্তের গন্ধ, এই ভালোবাসার গন্ধ? মনে করিয়ে দিচ্ছে বিস্মৃত অতীতকে?
অনেক বছর আগে এমনই এক বসন্তের পড়ন্ত বিকেলে সবার অলক্ষ্যে ওই গোলকচাঁপা গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে দুজনে একসাথে বুকে ভরে নিয়েছিল সাদা-হলুদ ফুলগুলোর মন মাতাল করা গন্ধ, প্রথমবার প্রেমে পড়ার পাগল করা গন্ধ।
আশিষ আগরওয়াল। দেবাঙ্গী রিন্দানীর প্রথম প্রেম। ছোটবেলা থেকেই একসাথে খেলাধুলা করে বড় হয়েছিল দুজনে। আশিষ দেবাঙ্গীর থেকে বছর তিনেকের বড় ছিল। তিন তিনটে মেয়ের পর ছেলের মুখ দেখেছিল শঙ্করলাল আর সবিতা আগরওয়াল। বংশের প্রদীপ, ‘কোলপোঁছা’ ছেলে তাই আশিষ ছিল বাবা-মায়ের চোখের মণি, ঠিক যেমন ওদের পরিবারে ছিল জিগনেশ। ছোটবেলায় আশিষকে খুব একটা পছন্দ করতো না দেবাঙ্গী, কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে অনেক কিছুই পালটায়। তাই সুঠাম চেহারার, গৌরবর্ন, সুদর্শন আশিষ যখন কিশোরী দেবাঙ্গীকে প্রেম নিবেদন করল তখন আর ও, না করতে পারল না। বাবা-মা যদি একবার জানতে পারে তাহলে যে কি লঙ্কাকান্ড বাঁধাবে তা জানা ছিল দুজনেরই। একই হাউসিং সোসাইটিতে থাকলে কি হবে, দুই পরিবারের জীবনযাত্রায় যে আকাশ-পাতাল ফারাক। কিন্তু কিশোরবেলার প্রথম প্রেম সমাজের বাঁধা গতে চলতে নারাজ। তাই উদ্দাম ভালোবাসার স্রোতে ভেসে গেল সব ভীতি, সব শঙ্কা, অনিশ্চয়তার উত্তাল সাগরে তরতর করে ভেসে চলল ওদের প্রেমের পানসি…
হঠাৎ একটা বিরক্তিকর শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়ল দেবাঙ্গীর। চারদিক থেকে ভেসে আসছে সমবেত হাততালির শব্দ, শঙ্খধ্বনি, প্রবল উৎসাহে ধাতব পাত্র বাজানোর আওয়াজ। পাঁচটা বেজে গিয়েছে তাহলে, স্মৃতির ভাঁটায় ভাসতে ভাসতে সময়ের কথাটা একেবারেই মনে ছিল না দেবাঙ্গীর। অন্যান্যদের মতো দেবাঙ্গীও হাততালি দিতে শুরু করল। আশিষ আর ওর হাড় জিরজিরে বউটা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছন্দবদ্ধ ভাবে হাততালি দিচ্ছে, একটু তফাতে দাঁড়িয়ে কি সব বিড়বিড় করতে করতে তালি বাজাচ্ছে শঙ্করলাল আর সবিতা, সোসাইটির গোমড়ামুখো কর্মকর্তাদের সব নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে আশিষের বদমায়েশ ছেলেমেয়েদুটো মনের আনন্দে চামচ দিয়ে থালা বাজাচ্ছে। আশিষের পরিবারের সবার মুখেই এখন আনন্দের স্পষ্ট ছাপ।
দেবাঙ্গী ভাবে, এই সংসারটা তো ওর হওয়ার কথা ছিল, ওই হাড়গিলে রুগ্ন মেয়েটার জায়গায় আশিষের স্ত্রী হয়ে ওর পাশে দাঁড়ানোর কথা ছিল দেবাঙ্গীর। কিন্তু কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল…
“আর ভালো লাগছে না, কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে, আমাকে ঘরে নিয়ে চল।” তিতিবিরক্ত হয়ে বলে উঠল কোকিলাবেন। সবে হাততালি দেওয়া শুরু হয়েছে, এ সময় ভেতরে চলে যাওয়াটা খুবই অশোভন। কিন্তু আর কিছুক্ষন এখানে থাকলে কোকিলাবেনের ব্যাবহার শোভনতার সীমা ছাড়াবে। মাকে তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতর নিয়ে চলল দেবাঙ্গী, খাটের ওপর বসিয়ে দিয়ে আর এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে আবার বেরিয়ে এল বারান্দায়। বউ পাশে থাকলেও আশিষ কিন্তু ওদের বারান্দার দিকেই তাকিয়ে আছে। তাহলে কি আশিষ দেবাঙ্গীর ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছে ???
আশিষের চোখে চোখ পড়ে গেল দেবাঙ্গীর। ও আশিষের চোখে সেই কিশোর বেলার আকুতি দেখতে পেল। অনেক বছর আগে ওকে একবার কাছে পাওয়ার জন্য, ছুঁয়ে দেখার জন্য, ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ানোর জন্য এমনই ব্যাকুলভাবে তাকিয়ে থাকতো আশিষ। কিন্তু এখন আর কি হবে সে সব পুরোনো কথা ভেবে? আশিষ এখন পুরোদস্তুর সংসারী, ওর জীবনে দেবাঙ্গীর আর কোনো জায়গা নেই। একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিল দেবাঙ্গী, তারপর অলকা পাটিলের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোনে অল্প হাসি এনে, আবার নতুন উদ্যমে ছন্দবদ্ধ ভাবে হাততালি দিতে দিতে মিশে যেতে চাইলো সবার সাথে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।