• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায় (পর্ব – ২)

গোলকচাঁপার গর্ভকেশর

কারুকাজ করা খাটটার একপাশে পিঠের পিছনে মোটা মোটা দুটো বালিশ দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসেছিল কোকিলাবেন রিন্দানী। হাতে একটা পুরোনো অ্যালবাম; খয়েরি রঙের চামড়া দিয়ে বাঁধানো, ভিতরে কালো চার্ট পেপারে আটকানো কিছু বিবর্ন হয়ে আসা সুখস্মৃতি। এটা কোকিলাবেনের বিয়ের অ্যালবাম। রোগের ভারে জীর্ন-দীর্ন, রক্তহীন, কোমরের নীচে থেকে প্রায় অবশ শরীরটা তখন কতো প্রাণোজ্বল ছিল। স্মৃতি বিজড়িত অ্যালবামের পাতা ওলটালো কোকিলাবেন। সুহাগরাতের আগে কিছু কমবয়সী রসিকা আত্মীয়াদের সাথে খাটের ওপর জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে নবদম্পতি। নীতিনের মুখে হালকা হাসি, পরনে শ্বশুরের দেওয়া দামী স্যুট। ভারী জরিদার শাড়ি পরা কোকিলার মুখে হাসির লেশমাত্র নেই, মাথা নিচু করে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মেহেন্দি রঞ্জিত হাতের রতনচুড় দুটোর দিকে।
আহমেদাবাদের নীতিনের সাথে যখন গান্ধীনগরের কোকিলার বিয়ে পাকা হয়, তখন কতো বয়স হয়েছিল কোকিলার? খুব বেশি হলে বছর কুড়ি। তাও শ্বশুরবাড়ির সবাই বলেছিল, এ মেয়ে বুড়ি হয়ে গেছে, দহেজ বেশি লাগবে। গ্রামের জমি-জিরেত বেচে এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের কারবারী সতীশভাইকে সাধ্যমতো পণ দিয়েছিল কোকিলার বাবা, আটা চাক্কির মালিক কেশবলাল। তবুও শ্বশুরবাড়িতে কতো ট্যারাব্যাঁকা কথা শুনতে হয়েছিল কোকিলাকে, বাবা দহেজে একটা লাল টুকটুকে চারচাকার গাড়ি না দিয়ে দু’চাকার মোটরবাইকেই কাজ সেরেছে বলে।
নীতিন অবশ্য কোনোদিনও কিছু বলেনি কোকিলাকে। ও তো থাকতেই চাইতো না ওই রক্ষণশীল যৌথ পরিবারে। তাইতো বিয়ের এক বছরের মধ্যেই চাকরি নিয়ে চলে এল পুনাতে, ছেড়ে দিল ওর শরিকি ব্যাবসায়ের ভাগ। সবাই মনে করেছিল কোকিলা ফুসলিয়েছে ওকে, না হলে কোনো গুজরাতি ছোকরা নিজের এতো বড়ো ব্যাবসা ছেড়ে চাকরি করতে যায় ? অনেকে তো এটাও বলেছিল, মেয়েছেলের কথায় চললে পতন অনিবার্য; কোকিলার বাবাও ছিল তাদের মধ্যে একজন। সতীশভাইয়ের এতো বড় ব্যাবসা দেখেই তো এতো পয়সা খরচা করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল কেশবলাল, এখন জামাই যদি সবকিছু ছেড়ে পরের গুলামি করতে যায়, তাহলে সমাজে মুখ দেখাবে কেমন করে ??
তবে শেষ অবধি নীতিনের জিদের কাছে হার মেনেছিল ওর বাপ-দাদারা, কিন্তু নতিস্বীকার করেনি। তাই ব্যাবসার ভাগ ছেড়ে দেওয়ার জন্য নীতিনের প্রাপ্য টাকাপয়সা দিলেও ওদের সাথে সম্পর্ক রাখেনি আর কেউই।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর হতে চলল এই পুনা শহরে আসার। প্রথম কয়েক বছর ভাড়াবাড়িতে থাকার পর জমানো টাকা দিয়ে সালুঙ্কে বিহার রোডের ওপর এই ‘রাজগৃহ হাউসিং সোসাইটি’-তে একটা দু’কামরার ফ্ল্যাট কিনল নীতিন। তিনতলার ওপর। আলো ঝলমলে, হাওয়া-বাতাস খেলা। জল আসতোই না। নিজের মতো করে নতুন সংসার গোছাতে শুরু করলো কোকিলা। সংসার গোছাতে গোছাতে জীবনটাকে গোছানোর সময় পার হয়ে যাচ্ছিল। তাই আর দেরী না করে কোকিলাকে গর্ভবতী করে দিল নীতিন। সুখবর পাওয়ার পর কেউ একবার দেখতেও এলো না কোকিলাকে। একা একাই দশটা মাস সবকিছু সামলাতে হোলো ওকে। পাছে সবার কাছে তানা শুনতে হয় সেই ভয়ে প্রসবের কয়েকদিন আগে জিগনাবেনকে মেয়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল কেশবলাল। আর ছেলে হয়েছে শুনে শ্বশুরবাড়ি থেকেও এসেছিল দু’একজন। জিগনাবেন নিজের নামের সাথে মিলিয়ে নাতির নাম রেখেছিল জিগনেশ; প্রতিবাদ করার কেউ ছিল না, নিজের পরিবারের লোকজনদের ব্যাবহার দেখে নীতিনও বেশ মনঃক্ষুন্ন হয়েছিল, তাই নবজাতকের ওই নামটাই বহাল রয়ে গেল।
জিগনেশের কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল কোকিলাবেনের। একে প্রথম সন্তান তায় ছেলে, জিগনেশকে একেবারে চোখে হারাতো কোকিলা। পাঁচ বছর পর যখন দেবাঙ্গী জন্মালো তখনও ভালোবাসা ভাগ করেনি কোকিলা। উড়ো খইয়ের মতো ছিটেফোঁটা ভালোবাসা দেবাঙ্গীর কপালে জুটতো ঠিকই, কিন্তু আসলটা সব সময় রাখা থাকতো জিগনেশের জন্যই। আর সেই জিগনেশ কি না শেষ পর্যন্ত এইভাবে ঠকালো বাবা-মাকে! কাউকে কিছু না জানিয়ে একটা মারাঠি মেয়েকে ঘরের বউ করে আনলো। মাছ-মাংস খাওয়া মেঘনা আডমানেকে দেখলেই শরীরের ভেতর একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হোতো শাকাহারি কোকিলাবেনের, গা গুলিয়ে উঠত। সেই ছোট্ট অস্বস্তিটা অবশ্য চিরস্থায়ী হল না, একটা বড় দুঃখ এসে ভুলিয়ে দিল সবকিছু। মেঘনাকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে আলাদা সংসার পাতলো জিগনেশ। মাঝেমধ্যে ফোনে দু’একটা কথাবার্তা ছাড়া আর কোনো যোগাযোগই রাখলো না পরিবারের সাথে। বাবার মৃত্যুর পর কয়েকদিনের জন্য এসেছিল জিগনেশ। শ্রাদ্ধশান্তি করে ছেলে হওয়ার কর্তব্য পালনের পর জানান দিয়েছিল অধিকারের। সদ্যবিধবা মাকে বুঝিয়েছিল হাই-মেনটেনেন্সওয়ালা বড় ফ্ল্যাটটা বেচে দিয়ে অবিবাহিতা বোনকে নিয়ে একটা এক কামরার ফ্ল্যাটে শিফট করতে। ততদিনে অবশ্য একটা জিনিস বেশ ভালোমতোই বুঝতে পেরেছিলো কোকিলাবেন, এই জন্মে তার আর ছেলের সাথে থাকা হবে না; কারণ কোকিলাবেন চাইলেও জিগনেশ একেবারেই চায় না মা ওদের সাথে থাকুক। তাই এক কথায় নাকচ করে দিয়েছিলো জিগনেশের সেই প্রস্তাব। সেই থেকে আর এ পথ মাড়ায় না জিগনেশ। হয়তো কোকিলাবেনের মৃত্যুর পর আসবে, ফ্ল্যাট বেচে নিজের হকের টাকা আদায় করবে বোনের কাছ থেকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল কোকিলাবেন। প্রথমদিকে মুখ তুলে চাইলেও এখন একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন দ্বারকাধীশ।
দেবাঙ্গীর কথা ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায় কোকিলাবেনের। কি কষ্টটাই না করে মেয়েটা। একে দশটা-পাঁচটার চাকরি তার ওপর পঙ্গু মায়ের সেবাযত্ন। সর্বক্ষনের জন্য একজন আয়াকে রাখার কথা বলেছিল দেবাঙ্গী। ওর সরকারি চাকরি, আয়ার মাইনে দিতে কোনো অসুবিধাই হোতো না। কিন্তু আয়া রাখা মানেই তো দায়িত্ব শেষ। এরপর যদি মাকে আয়ার হাতে ছেড়ে দিয়ে মেয়ে নিজের ভালোমন্দ বুঝে নেয়? জীবনসঙ্গী জোগাড় করে পেতে ফেলে নিজস্ব সংসার ? তখন কি করবে কোকিলাবেন? জিগনেশকে সবকিছু দিয়েছিল তবুও সে দায় ঝেড়ে ফেলেছে, দেবাঙ্গীকে তো ওর প্রাপ্য স্নেহটুকুও দেয়নি, তাহলে ওকে এখন আটকাবে কোন অধিকারে? তাই দেবাঙ্গীর কথায় রাজি হয়নি কোকিলাবেন। উপরন্তু নিজের অপরাধবোধ ঢাকতে একঝুড়ি কথা শুনিয়ে দিয়েছিল দেবাঙ্গীকে। দেবাঙ্গীও অশান্তির ভয়ে আর কোনোদিনও আয়া রাখার কথা পাড়েনি। তারপর থেকে এভাবেই চলছে। রোজ সময়মতো রান্নাবান্না করে, অফিসে বের হওয়ার আগে মাকে স্নান করিয়ে, দুপুরের খাবার খাইয়ে, ব্লাড-প্রেসারের ট্যাবলেট খাইয়ে, নতুন ডায়পার পরিয়ে রেখে যায় দেবাঙ্গী। মনে করে খাটের পাশের টেবিলটাতে গুছিয়ে রেখে দেয় জলের বোতল, বিস্কুটের কৌটো আর জোয়ানের শিশি। ছোটবেলা থেকেই কোকিলাবেনের অম্বলের ধাত, বিকেলের দিকে একটু লেবু-জোয়ান না খেলে কিছুতেই আর গলা-বুক জ্বালা সারে না। তবে ইদানিং আর তেমন কষ্ট হচ্ছে না, যা খাচ্ছে তাই হজম হয়ে যাচ্ছে। হয়তো এতোদিন ধরে লাগাতার লেবু-জোয়ান খাওয়ার সুফল।
ইদানিং অফিস থেকে ফিরতেও বেশ দেরী হচ্ছে দেবাঙ্গীর। দেবাঙ্গীর ফিরতে একটু দেরী হলেই বুক ধড়পড় করতে শুরু করে কোকিলাবেনের, মাথার ভেতর ভিড় জমায় নানা ধরনের কুচিন্তা। বার বার মনে হয় রাস্তাঘাটে মেয়েটার কোনো বিপদ হল না তো? দেবাঙ্গীর কিছু হলে কোকিলাবেনকে কে দেখবে? কিভাবে কাটবে ওর বাকি জীবনটা? দেবাঙ্গীকে কিছু জিজ্ঞেস করলে ও সেই একই উত্তর দেয়, কাজের চাপ বেড়ছে তাই ওভারটাইম করছি।
দরজার কাছে পায়ের শব্দ পেয়ে নড়েচড়ে বসল কোকিলাবেন। দেবাঙ্গী আসছে। ওর কাছে কিছুতেই মনের ভাব প্রকাশ করা যাবে না। কোকিলাবেনের মনের কথা একবার আঁচ করতে পারলে মাথায় চড়ে বসতে পারে দেবাঙ্গী। তারপর জিগনেশের মতোই বিয়ে করে নিতে পারে নিজের পছন্দের ছেলেকে; ওদের ‘বিরাদরি’র বাইরের কোনো ছেলে, মাস-মছলি খাওয়া ছোকরা, ঠিক মেঘনার মতো। না, বেঁচে থাকতে তা কিছুতেই হতে দেবে না কোকিলাবেন। একবার ভুল করেছে, আর একবার কিছুতেই নয়। যতদিন জীবন আছে ততদিন দেবাঙ্গীর ওপর নিজের আধিপত্য বজায় রাখবে কোকিলাবেন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।