• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক টুকরো হাসিতে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – একুশ 

টুকরো হাসি – একুশ

ডাক্তার

মান্তুমাসি বেজায় চটেছে। দশ বছর পরেও যখন আমাদের পিঠেপুলি খাওয়াল না, তখন আমার মা আর ছোটোমাসি সেটাকে ভালোভাবে নিতে পারেনি। দাদুকে ডেকে পাঠিয়েছে। এবার সংসার চালানোর দায়িত্ব অঙ্কা মামাকে দেওয়া হবে। সবাই মিলে এটাই ঠিক করেছে।
শুনে মান্তুমাসি বলেছে, কেন? আমি কি কিছু পারি না। আমি সেলাই করতে পারি। কুচি কুচি করে আলু কাটতে পারি। হালুয়া বানাতে পারি। খিচুড়ি বানাতে পারি। গান গাইতে পারি। বাসন মাজতে পারি। ছবি আঁকতে পারি। এক্কাদোক্কা খেলতে পারি । হা ডুডু খেলতে পারি।
আমার মা বলেছিল,  দিদি এসব কথা আমাদের বলে কি হবে? পাত্রপক্ষ কোনোদিন তোমাকে দেখতে এলে তখন এসব বললে হয়ত কাজে দেবে। 
তুই চুপ কর। আমি ঘর মুছতেও পারি। এই বলে বড়ো বালতিতে করে জল নিয়ে একটা ন্যাতা পতাকার মতো  মাথার উপরে তুলে নাড়াতে নাড়াতে এনে লম্বা বারান্দাটা চোয়াল শক্ত করে মুছতে লাগল।
মা ইশারা করতে আমরা সেখান থেকে আড়ালে চলে গেলাম।
কিছুক্ষণ বাদে মান্তুমাসির পরিত্রাহি চিৎকার। বালতিতে ধাক্কা লেগে বারান্দায় আছড়ে পড়েছে। সবাই ছুটে গেলাম। 
দাদুকে দেখে বলল, আমাকে সবাই মিলকে ধাক্কা দেকে পা চেপে ধরা হ্যায়ছে। আমার বুকমে ব্যথা হোতা হ্যায়। মাথামে দরদ হচ্ছে হ্যায়। ইয়ে একটা ষড়যন্ত্র। সবকো জেল ভেজ দো।
দাদু বলল, কে ষড়যন্ত্র করবে? ঠেলবেই বা কে! কেঊ তো এখানে ছিলই না।
মান্তুমাসি দাদুর উপর রেগে গেল। বলল, তুম কিম্ভূত হ্যায়। ইচ্ছা করে নেহি জানতা হ্যায়। আমি কাউকে নেহি ছাড়তা হ্যায়। ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে হিসেব নেব হ্যায়। 
মান্তুমাসি আর কথা বলতে পারল না। বঙ্কা আর শঙ্কা মামা মান্তুমাসিকে পরিচিত নার্সিংহোমে নিয়ে গেল। দাদু দেখতে গিয়েছিল। মান্তুমাসি বঙ্কা আর শঙ্কা মামাকে বলেছে, ওই বুড়ো দাড়িওয়ালা শালাকে জুতো ছুড়ে মার।
বুটাই আমাকে বলল, বাংলামে পিতাজী কো ক্যা শালা বোলতা হ্যায়?
কাল আমি আর বুটাই যখন খেলছিলাম মান্তুমাসি আমাদের কাছে এসে বলল, কি খেলা হবে?
আমরা খুশি হয়ে ঘাড় কাত করলাম। বললাম, খেলা হবে। 
মান্তুমাসি বলল, আমি হব গোলরক্ষক। 
বুটাই বলতে যাচ্ছিল ক্রিকেট খেলায় গোলরক্ষক হয় না। আমি আলতো চিমটি কেটে ওকে থামিয়ে দিলাম। বুটাই বল করল। আমি সজোরে মেরে বল বাড়ি ছাড়িয়ে রাস্তায় পাঠিয়ে দিলাম। 
মান্তুমাসি চিৎকার করে বলল, গো-ও-ও-ল।
বুটাই বলল, ইয়ে সব ক্যা বোলতা হ্যায়? আমি বুটাইকে ইশারায় থামতে বললাম।
ও ফুটবলটা নিয়ে এল। মান্তুমাসি বল দেখে খুশি হয়ে বলল, এবার দেখ কেমন খেলা হবে। 
বুটাই বলটা নিয়ে এমন জোরে মারল যে, সেটাও রাস্তায় গিয়ে পড়ল। মান্তুমাসি চিৎকার করে বলল, ছয়, একেবারে ওভার বাউন্ডারি।
বলটা রাস্তা থেকে এনে বুটাই মান্তুমাসির কথা শুনে হাসতে হাসতে শুয়ে পড়ল। খুব মজা পেয়েছে ও। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, খেলা হোবে খেলা হোবে। 
মান্তুমাসিও বলতে লাগল, খেলা হবে খেলা হবে।  আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, কি খেলা হবে তো? মান্তুমাসি আমাদের বোকা ভেবেছে। মনে করছে আমাদের পিঠেপুলি না খাইয়ে এইভাবে খেলা হবে খেলা হবে করে ভুলিয়ে রাখবে। সবই বুঝি। আমরা অঙ্কামামাকেই সমর্থন করব। তবে সেটা বুঝতে দেব কেন! আমিও হাততালি দিয়ে নাচতে লাগলাম। বললাম, খেলা হবে খেলা হবে। ভয়ানক খেলা হবে।
এইসব মনে পড়ছিল। মান্তুমাসিকে আজ নার্সিংহোম থেকে বাড়ি আনা হবে। 
অঙ্কামামা বলল, এই অবস্থায় তো দিদি হাঁটতে পারবে না। বাড়িতে যে একটা পেরাম্বুলেটার আছে ওটার ধুলো পরিস্কার করে সেটাতে যদি বসে তাহলে আমরা না হয় পালা করে ঠেলব।
দাদু বলল, মন্দ বলিসনি।
বঙ্কা আর শঙ্কামামার কাছে কথাটা শুনে মান্তুমাসি রেগে আগুন। বলল, নিজের বেলা যাতায়াতে প্লেন আর আমার বেলা পেরাম্বুলেটর? নেহি চলেগা। আমি বাইরে গিয়ে অনশন করব ধর্ণা দেব। ওখানে বসেই চণ্ডীপাঠ করব। বিষ্ণুমাতার কাছে নালিশ জানাব।
আমার মা আর ছোটোমাসি দাদুর দিকে তাকিয়ে বলল, এবার তো কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না। পাড়া প্রতিবেশীর কাছে মুখ দেখাতে পারব না।
 দাদু বাধ্য হয়ে একটা হুইলচেয়ার কিনে আনল।
মান্তুমাসি শঙ্কা মামাকে বলল, সিঙ্গাপুর থেকে পায়ের ব্যবস্থা কর। অনলাইনে পা এল। একটা ঢাউস পা। সেটা পরে মান্তুমাসি ওই পা আমাদের মুখের দিকে এমন ভাবে এগিয়ে রাখল দেখে মনে হবে যেন লাথি দেখাচ্ছে ।
ছোটোমাসি  মাকে বলল, শোন ঝামেলায় কাজ নেই। যে যার বাড়ি চল। এখানে যা হয় হোক । দিদিই কলকাতার সব দেখা শোনা করুক।
মা বলল, এটাই তো দিদি চেয়েছে। তোর যেমন সিমপ্যাথি হচ্ছে, তেমন যখন বাড়ির সবার হবে, তখন আবার সব দায়িত্ব হাতে নিয়ে যা ইচ্ছে করবে।
যা ইচ্ছে না রে। শুনলি না সেদিন বলছিল আমাদের জন্য কতকিছু করবে। বাব্‌বা লিস্টি যেন আর শেষ হতে চায় না।
বুঝতে পেরেছে আর আমরা ভাওতায় ভুলছি না। তাই এখন এটা করব ওটা করব। কেন এতদিন মনে ছিল না? ন্যাকা!
দাদু জানাল, বাজারে যেতে হবে। অনেককিছু কেনাকাটা করার আছে।
শুনে মান্তুমাসি বলল, আমিও যাব।
দাদু বলল, তোর পায়ের তো এই অবস্থা! যাবি কি করে? 
মান্তুমাসি কিছুতেই কথা শুনল না। বলল, আমার একটা পা আছে ,আমি সেই পায়েই দেখিয়ে দেব কেমন কাজ  করতে পারি। তাছাড়া তোমাদের দুটো পা তো ঠিক আছে। সেই পা গুলি তো আমার নিজের লোকেরই পা। নিজেরই পা বলা যায়। তাছাড়া আমার এই একটা পায়েই এমন কাজ হবে না!
আবার যদি একটা পা নিয়েই কত কাজ করতে পারে এই ফিরিস্তি দিতে থাকে এই ভয়ে দাদু বলল, ঠিক আছে যাবি যখন বলছিস তো চল।
আমরা বাজারে যাচ্ছি। সামনে দাদু। মান্তুমাসির হুইলচেয়ারের দুপাশে মা আর ছোটোমাসি। বঙ্কা আর শঙ্কামামা হুইলচেয়ার ঠেলে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অঙ্কামামা মুখ গম্ভীর করে ওদের পিছনে। খুব চিন্তিত। সংসার চালাবার যা একটা সুযোগ হাতে আসছিল, তাতে হাতে কিছু বাড়তি টাকা আসত। বাড়িটাকে অন্যরকম করে সাজানো যেত। সেটা বোধহয় মান্তুমাসির এই পা নাটকের জন্য হাতছাড়া হয়ে যাবে।
আমি আর বুটাই সবার শেষে। বুটাইয়ের হাতে একটা বড়ো কটকটে  লাল রঙের রুমাল। ঠান্ডা গরমে ওর নাক থেকে জল গড়াচ্ছে। ওটা দিয়ে নাক মুছছে।
আমি বললাম, ওইরকম একটা বিটকেল লাল রঙের রুমাল এনেছিস কেন? তোর আর রুমাল ছিল না?
বুটাই বলল, এটা দিয়ে মুছলে, নাক থেকে জল পড়া বন্ধ হয়ে যাবে।
কেন রে! ওটাতে কি জাদু আছে?
বাবা বলেছে একসময় একটা দল  এখানে লাল কাপড় দিয়ে বহুত কল কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। তাই তো আমার বাবা তোর বাবা এই রাজ্যে কোনো কাজ না পেয়ে  নিজেদের বাড়ি ছেড়ে বাইরে কাজের জন্য গিয়েছিল। এখন একটু বেড়াতে এলে দেখছিস না মান্তুমাসি কেমন বহিরাগত বলে অপমান করে।  লাল কাপড় যদি অত বড়ো বড়ো কলকারখানা বন্ধ করতে পারে তবে আমার সর্দি বন্ধ হবে না? বুটাই বলল।
আমরা সবাই বাজারের ভিতরে ঢুকে পড়েছি। 
বুটাই হঠাৎ মান্তুমাসির কাছে গেল। ওকে যেতে দেখে আমিও গেলাম। দেখি মান্তুমাসি ভালো পা ব্যাথা পায়ের উপর তুলে দিয়ে বেশ আরাম করে বসেছে। যেন অঙ্কামামাকে বেশ টাইট দিতে পেরেছে। মনে এমন একটা খুশির ভাব।
বুটাই গিয়ে বলল, ইয়ে ক্যা কিয়া? দোনো পায়র একসাথ কর দিয়া,আভি তো বহুত দর্দ হোগা।
মান্তুমাসি বলল, বাচ্চা লোগ খুব বকবক করতা হ্যায়। তুম কুটুস কুটুস করবে না। চুপ করো। কথাটা বলেই যাতে কেউ দেখতে না পায় তাড়াতাড়ি পা নামিয়ে নিল।
বুটাইয়ের নাক বেয়ে জল গড়িয়ে আসছিল। ও বড়ো লাল রুমালটা বের করল নাক মুছবার জন্য।
বাজারে একটা বিশাল ষাঁড় ঘোরাফেরা করে। সেটা আপন মনে  ফেলে দেওয়া আনাজ খাচ্ছিল। বুটাইয়ের লাল রুমালের দিকে নজর পড়তেই খেপে গেল। নাক দিয়ে ফোঁস্ ফোঁস্‌ আওয়াজ করতে করতে ছুটে এল বুটাইয়ের দিকে। বুটাই ভয়ে হাতের রুমালটা ফেলে দিতেই সেটা গিয়ে পড়ল মান্তুমাসির কোলের উপরে।
চারিদিক থেকে গেল গেল আওয়াজ। মান্তুমাসি ষাঁড়টাকে আসতে দেখে ভাবার সময় নিল না। সটান উঠে দাঁড়িয়ে টেনে দৌড় দিল।  চকিতে কোথায় মিলিয়ে গেল দেখা গেল না।
ষাঁড়টা এসে হুইল চেয়ারটাকে উলটে ফেলে দিল।
আচমকা এই ঘটনা ঘটিয়ে যেন রাগ কমে গেল। ষাঁড়টা দুলকি চালে অন্যদিকে চলে গেল। 
বুটাই এসে দাঁড়াল আমার পাশে। বলল, কী সংঘাতিক! বহুত তাজ্জবকি বাত!
বললাম, ভাগ্যিস তুই সময়মতো দেখতে পেয়েছিলি । তা না হলে এতক্ষণে তোকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটতে হত। কী ভয়ানক ষাঁড়।
বুটাই বলল, ও তো ষাঁড় নেহি আছে। দেখলি না মান্তুমাসির পায়ের কেমন ইলাজ হয়ে গেল। ব্যথা একদম গায়েব। একে তুই ষাঁড় বলবি? ও তো  ডাক্তার।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।