— স্যার , ফেসিলিটিগুলো একবার ভেবে দেখুন ! প্যালেস , প্যালেস কে আগে গার্ডেন , গার্ডেন কে আগে মেন রোড , ভ্যালে পার্কিং ………..
ভদ্রলোক মিস্টার ইন্ডিয়া স্টাইলে হুড়মুড় করে বলে যাচ্ছিলেন , ভ্যালে পার্কিং শুনেই বিশুদার চোখগুলো ভ্যালভ্যালে হয়ে গেলো ।
— সেটা আবার কি জিনিস মশাই ? খায় না মাথায় দেয় ?
— (অনুচ্চারিত ) কোথাকার গাঁইয়া মাল এলো রে বাবা ! (সশব্দে ) স্যার , ফাইভ স্টার হোটেলে গাড়ি নিয়ে গিয়ে গেটের সামনে গাড়ি ফেলে রেখে মেজাজে চলে যান , হোটেলের উর্দিপরা ড্রাইভার আপনার গাড়ি পার্ক করে দেবে , আবার যখন দরকার হবে , টুক করে গাড়ীর নম্বরটা বলে দেবেন , আপনার সামনে গাড়ি এসে যাবে । ওই সিস্টেমটাকেই ভ্যালে পার্কিং বলে ।
শুনেই বিশুদার চোখ চকচক ……বাঃ বাঃ , এটা বেশ নতুন ব্যপার হবে তো ! তাহলে হয়েই যাক ! নেবার্স এনভি কাকে বলে , স্বচক্ষে দেখার আর একটা সুযোগ হবে ।
কেসটা হল বিশুদার মেয়ের বিয়ে । চাকরির পাশাপাশি বিড়ি ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ব্যবসা করে ভালো কামিয়েছেন , একমাত্র মেয়ের বিয়ে ছাড়া লোকজনকে দেখানোর তেমন সুবিধা হচ্ছে না । না না , বিড়ি শুনে হাসার কিছু নেই , ওই ব্যবসার দৌলতেই বিশুদার দোতলা বাড়ি তিনতলা হয়েছে , চারতলার ছাদে শ্বেতপাথর মোড়া ঠাকুরঘর হয়েছে বৌদির জন্য , ইন্টিরিয়ার ডেকরেটার দিয়ে চৌকো চৌবাচ্চার মত একধাপ নিচু জায়গায় ইনবিল্ট সোফাসেট হয়েছে , পার্ক স্ট্রিটের অকশন শপ থেকে কেনা ঝাড়বাতি , ক্রকারি সেট , সব হয়েছে । বৌদি অবশ্য বলেন , নামের পয়েই এত সব (বৌদির নামেই বিড়ির নাম …..সুভাষিনী বিড়ি ) আমরা ওসব স্পর্শকাতর বিতর্কিত ব্যপারে যাচ্ছি না ।
এহেন অবস্থায় মেয়ের বিয়ে …..তার ওপর ছেলের বাড়ি কোটিপতি ! যদিও ছেলে খোঁজার ক্রেডিটটা টিনা , অর্থাৎ বিশুদার মেয়েরই , কিন্তু বৌদির বক্তব্য , হাতে মোবাইলের টর্চ নিয়ে খুঁজলেও এর চেয়ে ভালো পাত্র বিশুদা খুঁজে পেতেন না । তার ওপর পাত্রপক্ষ এক কথায় ঘোষণা করে দিয়েছে , না মশাই , খাট , পালং , আলমারি , ড্রেসিংটেবিল , ওয়াশিং মেশিন হ্যানোত্যানো কিচ্ছু চাইনা আমাদের , সব আছে । বাড়ীতে তিনটে গাড়ি …..একটা তো গ্যারাজেই পড়ে থাকে । সোনার বোতাম ? ছ্যাঃ ,আজকাল কোন ছেলেটা পরে মশাই ? আংটিই বা কোন কম্মে আসে ? আমাদের কিচ্ছু চাই না , কেবল আপনার মেয়েটিকে চাই ।
এতেই বৌদি আরও চাপে পড়ে গেছেন । রোজ মেয়েকে নিয়ে মার্কেটিংয়ে বেরোচ্ছেন আর বিশুদার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সে বড় বড় খাবলা পড়ছে । একবার মিনমিন করে বলতে গিয়েছিলেন ……কি এত কিনে ঘর ভর্তি করছ , ওরা তো কিছু নেবে না ! ব্যাস ….হয়ে গেলো ! আগ্নেয়গিরির মুখ খুলে গেলো !
— একটা মাত্র মেয়ের বিয়েতে ভিখিরির মত খালি হাতে মেয়ে পাঠাবো ? চায়নি বলেই তো আরও দিতে হবে …..মেয়েকে গিফট করতেও তো হয় ! তারপর প্রণামীর ব্যপার আছে ….শাশুড়ি , জ্যাঠশাশুড়ি , পিসশাশুড়ি , শ্বশুর , জ্যাঠশ্বশুর , পিসশ্বশুর , মামা , মামী , সম্পর্কিত দেওর ননদের পাল , নিজের ননদ ……
বৌদি হাঁপিয়ে গিয়ে চুপ করেন ।
— আর গয়না ? তুমি তো বলেছিলে , তোমার যা আছে , তাতেই হবে , এর ওপর আরও বিশ ভরি ?
— সব ঝেড়েপুঁছে মেয়েকে দিয়ে দেবো ? খোকার বৌয়ের জন্য আমার বিয়ের সেটটা রেখেছি । তার ওপর অত বড়লোকের বাড়ি যাচ্ছে ! ওরা তোমার মেয়েকে গয়নায় মুড়ে দেবে । তখন ? তখন যদি লোকে নাক সিঁটকে বলে , মেয়ের বাবা এই দিয়েছে ! ! ! তোমার মুখটা খুব উজ্জ্বল হবে তো ?
— এখন চল্লিশ হাজার টাকা ভরি ……
— ওসব জানি না । তুমি এ ব্যপারে নাক গলাতে এসো না দয়া করে !
অগত্যা বিশুদা চুপ আছেন । না থেকেই বা উপায় কী ? বিয়েবাড়ীর ভাড়া সাড়ে তিন লাখ …..তাও এক বছর আগে বুক করতে হয়েছে ! করোনার দৌলতে দুহাজার একুশে বিয়ের হিড়িক পড়ে গেছে …..ভালো বিয়েবাড়ি পাওয়া একেবারেই দুষ্কর । সব বুকড ! তার ওপর গিন্নি আর মেয়ের ওই সিংহী প্যালেসই পছন্দ । সেই সাথে অবশ্য বিশুদারও ! ওই বিঘেপ্রমাণ বাগানে টুনিবাল্ব আর ফুলের সাজে যা বাহার খুলবে না ! তার ওপর ওই ভ্যালে পার্কিং …….!
বাবা , ক্যাটারিংয়ের লোক এসেছে …..বাইরের ঘরে বসিয়েছি ……ছেলের প্রবেশ ।
বিশুদা মোটা খাতা আর কলম নিয়ে চলে যান । বৌদি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তৃতীয় দফা মার্কেটিংয়ের জন্য তৈরি হন ।
— নমস্কার , নমস্কার দাদা …..তাহলে ওই আইটেমই ফাইনাল তো ?
— না , মানে আমার গিন্নি বলছিলেন , স্ন্যাকসের মধ্যে যদি চিকেন রেশমি কাবাবটা রাখা যায় …..
— নিশ্চয়ই রাখা যাবে …..আপনি চাইছেন , আর হবে না , তা কি করে হয় ? তবে দাদা , লোকে কিন্তু একটু বেশি টানবে !
— বিশুদার মাথায় বাগানের এক কোণে সাজানো ককটেল পার্টির দৃশ্যটা ভাসছিলো । ধুপ করে বাস্তবে আছাড় খেলেন ।
— তার মানে মিটার আরও চড়বে , তাই তো ?
— হেঁ হেঁ …..কি আর বলব স্যার ……দু হাজার টাকা প্লেট ধরা ছিলো , আরও দুশো বাড়িয়ে দিন । এর কমে আজকাল কী হয় দাদা ? দেখছেন তো বাজারের অবস্থা ! আর আপনাকে সব এক নম্বর জিনিস দেবো দাদা …..খেয়ে দেখবেন , লোকে কেমন ধন্যি ধন্যি করে ! তার ওপর ওই আইটেমটা আছে …..লবস্টার থার্মিডোর …..ওটাই তো স্যার …… টাইগার প্রনের এখন দাম ……
মিয়োনো গলায় বিশুদা বলেন ……থাক , কী আর হবে , হচ্ছেই যখন , ভালো করেই হোক ……
— এই তো স্যার , এই হচ্ছে স্পিরিট ! ! ঠাকুর বলেছিলেন , এসেছিস যখন , একটা আঁচড় রেখে যা ! দেখবেন , কতদিন ধরে লোকে এই অনুষ্ঠানটা মনে রাখে !
বিয়ের দিন ……প্যালেসে ধুতি পাঞ্জাবি মানাবে না বলে বিশুদার পরণে নতুন স্যুট …..কন্যাসম্প্রদানে কনের জ্যাঠা বসেছেন , এটাই রক্ষা ! এমন সময় গেটের কাছে মহা হট্টগোল !
— বিশুদা , কোথায় গেলে ? একবার এসো তো এখানে …..
— মামা , ও মামা ……কোথায় গেলে ? কি সব লোকজন রেখেছ এখানে ?
বিশুদা পড়িমরি করে গেটের কাছে যান । দেখেন , দুটো টোটো বোঝাই করে বোন , ভগ্নিপতি , তাদের দুই ছেলে , বৌ , নাতিনাতনির দল এসে গেছে , গেটের উর্দিধারী দুজন প্রহরীর সাথে বিতন্ডা চলছে । বাতাবরণ টেনশনে টান টান ।
— আরে , হলটা কী ? ? জামাইবাবু , টুবলু ….কি হল ?
— এই যে বললে , কত টাকা দিয়ে কী সব ভ্যালা না ভ্যালু পার্কিং করেছ , তা , গাড়ি ছাড়া কিছু পার্ক করা যাবে না , সেটা বলে দিলেই পারতিস , গাড়ি ভাড়া করে আসতাম !
টোটো পার্কিং ! ! এই জন্য সতেরো হাজার টাকা দিয়ে ভ্যালে পার্কিং ! !
মনের ভাব মুখে ফুটতে না দিয়ে বিশুদা উর্দিধারীর দিকে কড়া চোখে তাকান ।
— স্যার , আমরা বলেছি , ওদিকে ফ্রি পার্কিং স্পেস আছে । ওনারা মানছেন না !
বোন নাকিসুরে বললো ……দাদা , তুমি যে বঁলেঁছিঁলেঁ ওঁরা পাঁর্ক কঁরেঁ দেঁবেঁ …….
— স্যার , সোফার ড্রিভন কার পার্কিং সোফারকেই করতে হবে ।
— মানে ! ! শালা বিপ বিপ , তোর আমাকে ড্রাইভার মনে হচ্ছে বিপ বিপ ! ! ! ! ! এত খরচা করে টোটো কিনলাম , মামাকে দেখাবো বলে চালিয়ে আনলাম আর তুমি বিপ বিপ বলছো আমি ড্রাইভার ! ! ! ! ! ! তোমার ইয়েতে ইয়ে করি আমি ! !
খিস্তির বহর দেখে বিব্রত সিকিউরিটি ধবধবে পোশাক আর টুপি পরা ড্রাইভারকে ধরে আনে , সে মনে মনে বাপান্ত করতে করতে টোটো পার্ক করতে যায় ।
ভাগ্নে বলে , নম্বর টুকে রাখুন দাদা , ফেরার সময় টোটো যেন দরজার সামনে পাই । গলায় গামছা মোড়া দিয়ে টাকা নিচ্ছে , তার আবার প্যাখনা কত !
ওদিকে সিংহী প্যালেসের ভেতরে সুন্দরীদের কলরব , উলুধ্বনি , শাঁখের আওয়াজের সাথে টুনিবাল্বের রোশনাই মিলেমিশে বেশ একটা স্বপ্ন স্বপ্ন পরিবেশ তৈরি হয়েছে । বিশুদা চট করে ককটেলের জায়গায় গিয়ে এক পেগ অন দ্য রকস মেরে দিয়ে প্যালেসের টাইলস মোড়া টয়লেটে গিয়ে একটা সুভাষিনী বিড়ি ধরিয়ে মনে মনে গান ধরলেন ……..
“দোষ কারও নয় গো মা …..
আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা ! “