পাহাড়ের ধাপে ধাপে বাড়ি বেশ একটা জমজমাটি জনপদ। দোকান বাজার আর আমাদের মতন ছোট্ট- ছোট্ট পাহাড়ের ছেলেমেয়েরা টয়ট্রেনের সাথে দৌড়চ্ছিল। দেখলাম কতগুলো পাহাড়ী কুকুরও ছুটছে তাদের সাথে। তিনধারিয়ার সেই প্রথম ছবি এখনও ধরা মনে। আমরা রাতের বেলায় দেখতাম শিলিগুড়ি থেকে পাহাড়ের ওপর তিনধারিয়ার আলো। ট্রেনের পাশ দিয়ে জিপ, ছোটোবাস, পাহাড়ের মাল নিয়ে যাওয়া ছোট-লরী সাঁইসাঁই ছুটে যাচ্ছে আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথে। টয়ট্রেনের মন্থরগতি ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে পারবে না। তিনধারিয়া পার হতেই একপাশে খাদ আর একপাশে পাহাড় আবার শুরু হল। নির্জন পথে শুধু কু- ঝিক্- ঝিক্ কু- ঝিক্- ঝিক্ শব্দ। ট্রেনের কয়লার ধোঁয়া বাতাসে ভাসছে। তখন ঐ ছোট্ট-বেলায় কী যে ভালো লাগত বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ধোঁয়ার গন্ধ। সেই গন্ধ এখনও খুঁজে ফিরি, পেলে হয়ত ঐ ছোট্ট- বেলা খুঁজে পেতাম। সবুজ পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে গায়ে রঙ- বেরঙের নাম না জানা ফুল, অনেক রঙের প্রজাপতিদের ওড়াওড়ি দেখতে পাচ্ছিলাম। আর গতরাতের বৃষ্টির জন্য পাহাড়ি ঝর্ণাগুলো বুঝি আরও শব্দতুলে নিচে নেমে আসছিল সাদাজলের তুফান মেলে।
বাবা বললেন- সামনেই আসবে পাগলাঝোরা। ঝোরার ঝোরা মহাঝোরা পাগলাঝোরা। দেখবি কী বিরাট পরাক্রমশালী ঐ ঝর্ণা। প্রতিবছর ভোগায়। ওর জলের ধারায় হিলকার্ট রোগে ধ্বস নামে প্রতি বছর। রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।
মনে বেশ আনন্দ খেলল। পাগলাঝোরা দেখব বলে। পরে জেনেছিলাম আরও ,এই পাগলাঝোরা থেকে মহানন্দা নদীর সৃষ্টি। এর জলেই আর আশপাশের বিভিন্ন পাহাড়ী ঝোরার জলেই মহানন্দা নদী সারাবছর জলে পরিপুষ্ট থাকে। একদম শুকিয়ে যায় না। গয়াবাড়ি স্টেশন পেরোতেই সেই ঝোরার ঝিরঝির জল গায়ে মেখেই আমরা এগিয়ে গেলাম গিদ্দা পাহাড়ের দিকে। এখান থেকে পাক খেয়ে- খেয়ে পাহাড়ি পথ ধাপে- ধাপে খাড়াই কার্শিয়াং পাহাড়ে উঠে গিয়েছে। এই গিদ্দা পাহাড়ে নেতাজী সুভাষ বোস কিছুদিন কারাবাসে ছিলেন।
এই কার্শিয়াং ব্রিটিশরা সিকিমের রাজার কাছে থেকে পেয়েছিলেন যৌতুক হিসেবে। নেপালি ভাষায় খার্সাং- ভোরের ধ্রুবতারা। আমাদের সবার আদরের কুয়াশা ঘেরা কার্শিয়াং। সত্যি তাই গিদ্দা পাহাড় পেরুতেই কুয়াশা মাখা হল কার্শিয়াং। আমরা জানি আজ এখানেই আমরা টয়ট্রেনের থেকে নামব। কার্শিয়াং শহরে নেমে কার্শিয়াং দেখে বাসে বা ট্রেকারে করে শিলিগুড়িতে বাড়ি ফিরে যাব। কার্শিয়াং আসছে জন কোলাহল বাড়ছে। একটু যেন শীত- শীত করতে লাগলো।
মুহূর্তের মধ্যে পাহাড়ের রূপ পাল্টে যায় দেখলাম। বাবা আমাদের বললেন- এই হল কার্শিয়াং স্টেশন। এখানে একটু হেঁটে ওপরে গিয়ে হিলকার্ট রোড ধরে হোটেলে বসে খাবার খেয়ে, তারপর ঈগলস্ ক্রাগ দেখতে যাব। আমি কার্শিয়াং স্টেশনে নেমে তার বাহারী সজ্জা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। মনে হল যেন ব্রিটিশ সাহেবরা এই শহরে এখনও আছে। কী সুন্দর রেলের কাঁচের বাতি ঝুলছে। আর জমাটবাঁধা কুয়াশায় মনেই হচ্ছিল না আমরা নীচের সমতল থেকে গরমের রাতে ঝলমল কার্শিয়াং দেখতে পাই। এ তো এক শীতের শহর!
তারপর খেয়েদেয়ে ঈগলস্ ক্রাগে পৌঁছুতেই ঘটল এক রহস্যময় যাদু!