সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ১৫)

আমার মেয়েবেলা
তর্পণ
আজকাল বাবা মার ছবির দিকে তাকালে চোখ নামিয়ে নিই কেমন যেন একটা না বলতে পারা অপরাধ বোধে। ভেতরে ভেতরে একটা যন্ত্রণার কাঁটা যেন বিঁধতে থাকে,,, বিঁধতেই থাকে। আমি নিজেকে ওঁদের,, একজন অপদার্থ সন্তান ছাড়া আর কিচ্ছু ভাবতেই পারি না।
যতদিন বাবা মা বেঁচে ছিল ওঁদের কাছ থেকে আমি শুধু নিয়েই গেছি, যখনই দরকার হয়েছে হাত বাড়িয়েছি। বাবা এক বুক ভরসা দিয়ে বলেছে,,,,
আমি আছি তো চিন্তা করছিস কেন। মা সব সময়ই সাহস জুগিয়েছে। বাবা বলত মামনি কখনও পিছনে ফিরে দেখার চেষ্টা করবি না। যা হয়ে গেছে সেটা তো অতীত। সেটা নিয়ে ভেবে কী হবে? ভগবানে বিশ্বাস রাখবি। সাহস করে এগিয়ে যা। ঠিক পারবি। মনে রাখবি যে কোনও কাজ,, যে কেউ করতে পারে। শুধু সাহসটা থাকা দরকার। আর এই সাহস নিজেকে নিজের জন্যই আনতে হবে। হেরে গেলে তো হয়েই গেল। জীবনটা একটা খেলার মাঠের রেসের ঘোড়ার মতো।তোকে ছুটতেই হবে যা হোক করে। মাঝপথে থামতে তো পারবিনা। যেদিন থেমে গেলি,, মানে মৃত্যু হল তোর।
জীবনে খুব কম সময়ের জন্যই বাবা মাকে পেয়েছিলাম । কিন্তু যতটুকু পেয়েছি ততটুকু দিয়েই কাজ চালিয়ে নিয়েছি,,, এখনও নিচ্ছি। কিন্তু মাঝে মাঝে বড্ড দরকার হয় যে বাবা মাকে! বিশেষ করে বাবাকে।
বাবা এত সুন্দর করে যেকোনো কঠিন বিষয় সমাধান করে দিত যে আমি অবাক হয়ে যেতাম।যতটুকু পেয়েছি আজ মনে হয় অনেকটাই। তবু,,, তবু একটা কী যেন না পাওয়ায়, হাহাকার করে ওঠে মন। মেয়ে হিসেবে আমি সেভাবে কিচ্ছু করতে পারি নি। এবং এই না করতে পারার প্রধান অন্তরায় আমার বর্তমান পরিস্থিতি।
১৯৯১ সালের ১০ই ডিসেম্বর ভাই চলে যাওয়ার পর আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম।আমার তো, আর কোন ভাই বোন ছিল না। তাই জীবনের অনেক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে শুধু আমাকেই। আমার তখনও বিয়ে হয় নি। খুরতুতো ভাইরা তখন খুব ছোট্ট। তাই তাদের সঙ্গে আমার সবকিছু শেয়ার করার মতো সেরকম পরিস্থিতিই তৈরি হয়নি। সেইজন্য আমাকে, একাই অনেককিছুই সামলাতে হয়েছে।
আর সেই সময়, আমার যে যে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল সেটা ইচ্ছে থাকলেও বিভিন্ন প্রতিকূলতার জন্য আমি নিতে পারি নি। আমার যতটা সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল, সেটাও আমি নিতে পারি নি।
কোন দিনই আমি সেভাবে আমার ইচ্ছে মতো কঠিন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি বলে মনের ভেতর একটা অপরাধবোধ কাজ করে। বড্ড ছোট মনে হয় নিজেকে।
তবে আমি তখনও যেমন পারিনি আজও পারিনা। আমি যেমন অত্যন্ত রক্ষণশীল নামকরা এক ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে ছিলাম। আর আজ তেমনই আমি অসম্ভব,,,, অসম্ভব রক্ষণশীল এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক বনেদি পরিবারের একমাত্র গৃহবধূ। যার ফলে মেনে নেওয়া,,,,,মানিয়ে নেওয়া ছাড়া আর সেভাবে আমার জীবনের অভিধানে কোনও শব্দ তৈরিই হল না। আর এইভাবে মেনে নিতে নিতে এবং মানিয়ে নিতে নিতে এখন আর মনেই পড়ে না আসলে আমার সত্যিকারের চাওয়াটা ঠিক কী ছিল,,,,,,,,
এক এক সময় নিজেকে খুব দোষারোপ করি,, একটা বড়সড় অপরাধী বানিয়ে ,,,আমি কিছু দিনের জন্য প্রচন্ড ভাবে বিষন্নতায় ডুবে যাই। তখন অতীত বর্তমান কিছুই মনে থাকে না। আমি তখন স্বপ্নে দেখা সুন্দর একটা ভবিষ্যতের মধ্যে যাপন করে নিজেকে আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করি। নিজেকে নিজেই কাউন্সেলিং করার চেষ্টা করি। ইচ্ছে করেই বাবার কথাগুলো মনে করি। ভাবতে চেষ্টা করি বাবা থাকলে কী বলত আমাকে?
কিছুদিন পর আবার বাবার কথামত সব কিছু সরিয়ে উঠে দাঁড়াই।
কিন্তু এখনও কিছু কিছু পরিস্থিতিতে আমাকে পিছনে ফিরতেই হয়। আর আমার পিছনের রাস্তাটা তো আর সহজ সরল নয়। একটা দাবানল যেন । আর সেই আগুনের আঁচ আমার মনুষ্যত্বকে যেন দগ্ধে দগ্ধে মারে।
অনেক কিছুই করতে ইচ্ছে করে আজকাল। তখনও করত। যেগুলো করতে চাই খুবই যুদ্ধ করে সেগুলো কে হাসিল করতে হয়। সহজে তো কিছু আসে না। এর জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়। অপমান সহ্য করতে হয়। অবহেলাও সহ্য করতে হয়। তদুপরি কাউন্সেলিং করতে হয় পরিবারের বয়োঃজ্যেষ্ঠদের।
আবার এমন কিছু কিছু ইচ্ছেপূরণ,,, আমি জানি যা কোনও দিনই সম্ভব নয়, সে আমার এ জন্মে তো নয়ইইইই। পরের জন্মের কথা বলতে পারি না।