• Uncategorized
  • 0

|| আন্তর্জাতিক কবিতা দিবস || মৃদুল শ্রীমানী

বাংলা ভাষার কবিতা পড়তে গিয়ে চর্যাপদের সেই পংক্তিটি মনে করি। টালত ঘর মোর, নাহি পড়িবেষী / হাঁড়ীত ভাত নাই, নিতি আবেশী। ওর মানেটা বৌদ্ধ শূন‍্যবাদ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলে হত। কিন্তু ওই যে ‘হাঁড়িতে ভাত নেই’ কথাটা আমায় আকুল করে দিল। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে বড়ু চণ্ডীদাস কাহ্নের বাঁশির শব্দে রাধার রান্নার কি পরিণতি হল লিখেছেন। বাঁশির শবদে মোর আউলাইল রান্ধন। গতরে খেটে রোজগার করে তবে পরিবারের সদস্যদের খাওয়ার আয়োজন করে রাধা। পথে যেতে দানী নানাভাবে শরীর ছোঁয়ার চেষ্টা করে। এস এইচ ডবল‍্যু। তারপর বাড়ি ফিরে রান্না। পথে রাধা ওয়ার্কিং গার্ল। ঘরে ফিরে এসে রাধা হোম মেকার। মাল্টি রোল। সেই রান্না নষ্ট হলে জটিলা কুটিলা আয়ান ঘোষ কত না লাঞ্ছনা গঞ্জনা করবে!
ফুল্লরার বারমাস‍্যা পড়ি। ওই যে চণ্ডীকে ফুল্লরা নিজের দুঃখবাণী বলে চলে, আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ‍্যমান। বিদ‍্যমান কথাটা নিশ্চয়ই কালকেতুর বৌ বলে নি। কিন্তু কবি বললেন। ওই বিদ‍্যমান শব্দটা আমায় ভাবায়। গর্ত তো বিদ‍্যমান। কিন্তু গর্ত কেন? না তৈজসপত্র নেই। মাটিতে গর্ত করে খায়। তবে কালকেতুর খাবারের রকমারি গপ্পো ফেঁদেছেন কবি। অত রান্না একবেলায় একাটি কেউ রাঁধতে পারে না। আমি নিশ্চিত। অজস্র খাবারের ছবি এঁকে স্বপ্ন দেখান যেন অভুক্ত নিজেকে।
আবার কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম অত‍্যাচারের চোটে ঘরছাড়া হচ্ছেন। শিশুর হাত ধরে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন গাঁ ঘর। তখন কি বলছেন তিনি?
তৈল বিনা কৈলুঁ স্নান, করিলুঁ উদক পান, শিশু কান্দে ওদনের তরে। ওদন মানে অন্ন। ভাত। ভাত পায় নি বলে শিশু কাঁদছে। পেট ভরাতে পুকুরের জল খেয়েছে। স্নান করার আগে গরিব কবির গায়ে মাখার তেলটুকু জোটেনি।
অন্নের অভাবে গরিবের কষ্টের কথা বারে বারে কবির কলমে উঠে এসেছে। নজরুল ইসলাম লিখেছেন ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন।
সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন বড়মানুষ ভোজের পাতে ফেলে লুচি মিষ্টি/ গরিবরা পায় খোলামকুচি…
অন্নের কথা লেখেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। অন্নদেবতা কবিতাটি মনে পড়ে।
অন্ন বাক্য অন্ন প্রাণ অন্নই চেতনা;
অন্ন ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্ন আরাধনা।
অন্ন চিন্তা অন্ন গান অন্নই কবিতা,
অন্ন অগ্নি বায়ু জল নক্ষত্র সবিতা।
অন্ন আলো অন্ন জ্যোতি সর্বধর্মসার
অন্ন আদি অন্ন অন্ত অন্নই ওঙ্কার।
সে অন্নে যে বিষ দেয় কিংবা তাকে কাড়ে
ধ্বংস করো, ধ্বংস করো, ধ্বংস করো তারে।
আবদুল গাফফার চৌধুরী লেখেন,
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।
তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে…..
জেলগেটে দেখা কবিতায় আল মাহমুদ লিখেছেন
 এখন আকাল। মানুষ কি খেতে পায়?….
লিখেছেন,
আমাদের শহর নিশ্চয়ই এখন ভিখিরিতে ভরে গেছে।
সারাদিন ভিক্ষুকের স্রোত সামাল দিতে হয়।
আমি কতবার তোমাকে বলেছি, দেখো
মুষ্টি ভিক্ষায় দারিদ্র্য দূর হয় না।
এর অন্য ব্যবস্থা দরকার, দরকার সামাজিক ন্যায়ের।
দুঃখের শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে।
আরো লিখছেন,
মাছের কিমার একটা বল গড়িয়ে দিয়ে জানালে,
আবার ধরপাকড় শুরু হয়েছে।
আমি মাথা নাড়লাম।
মাগুর মাছের ঝোল ছড়িয়ে দিতে দিতে কানের কাছে মুখ আনলে,
অমুক বিপ্লবী আর নেই….
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, আমি ঢালিব করুণাধারা, আমি ভাঙিব পাষাণকারা, আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া আকুল পাগল পারা…
সে পাগল কি বলে? কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সংগীতহারা, অমাবস্যার কারা/ লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে…
সারা পৃথিবী জুড়ে যখন অন্নাভাব, দুটি অন্নের দায়ে যখন মানুষ পাগল হয়ে যাচ্ছে, তখন আমি কবিতায় মেকি সৌন্দর্য নিয়ে সময় কাটাতে পারব না।
রাষ্ট্র যদি ফ‍্যাসিস্ট হয়ে উঠতে চায়, দাঁত দেখায়, যে দাঁতে রক্ত লেগে আছে, আমি বলব, যতবার ভয়ের মুখোশ তার করেছি বিশ্বাস/ ততবার হয়েছে অনর্থ পরাজয়। আমি চাই সর্বহারার সচেতন আন্দোলন। যারা শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ-‘পরে…কাজ করে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।