একেবারে ছোট বেলায় যখন পড়া লেখা শুরু হয় তখন এক থেকে ধীরে ধীরে ৫০, আবার ব্যাক কাউন্টিং করে এক… এভাবেই চলতে থাকে।আমাদের জীবনটাও ঠিক তেমনি।এক থেকে শুরু হয়ে ক্রমশ ধাপে ধাপে গিয়ে পৌঁছানো পঞ্চাশের কোঠায়।
চল্লিশ পেরোলেই চালসে আর পঞ্চাশ অতিক্রম করলে বার্ধক্য। তখন আর রঙ মেখে খুকি সাজার কোনও মানে নেই। কারণ তখন ব্যাক ক্যালকুলেশন করে যেখান থেকে এসেছি সেখানে ফেরার দিন গোনা।
এই শব্দ বাক্যগুলো অসম্ভব জটিল মনে হত আমার।কিন্তু যিনি বলছেন তাঁকে ছেড়ে যেতেও মন চাইছে না।তাঁকে যে আমি খুব ভালো চিনি,তাও নয়।অথচ একটা কিসের আকর্ষণে বসে আছি তাঁর কাছে।তাঁর গা দিয়ে অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ। পরনে সাদা ফাইন থানের শাড়ি।অনেকটা অবাঙালি বিধবারা যেমন পরেন।আমার ঠাকুমাও এমন শাড়িই পরেন।
ঠাকুমার সাদা চুল দেখিনি তখনো।কিন্তু সামনে যিনি বসে তাঁর পুরো চুলটাই সাদা। এনাকেও দিদাই বলি অবশ্য। ঠাকুমা নয়।কেন জানি না মনে হত ঠাকুমা একজনই,বাকি ওই বয়সের সবাই দিদা।
বড় দিদা,ছোটো দিদা,মেজদিদা…।
কিন্তু এই দিদা হঠাৎ করে আমাকে কেন এসব বলছেন? আমি তো এখন দশের ঘরে।তাহলে!
একটু পরেই কারণটা বুঝতে পারলাম।আমি বলেছিলাম -তোমার চুল কেন সাদা? তুমি কি আগে চুল রঙ করতে?
কেউ আমাকে বলেছিলেন,বুড়ির চুল সাদা হয়,কারণ আগে তারা চুল রঙ করত।যেমন সাদা বুড়ির চুল দেখিসনি? গোলাপি রঙটা উঠে গেলেই সাদাটা বেরিয়ে যায়।
আমি আমার সেই সদ্য শোনা পাণ্ডিত্য ফলাতে গিয়ে এই প্রশ্ন করলাম।তার উত্তরে তিনি এগুলো বললেন।
কিন্তু চল্লিশ পেরোলেই চালসে কেন পড়বে? হনুমান চল্লিশা শুনেছি। আজিমগঞ্জে অনেকেই পাঠ করেন।তার সঙ্গে চল্লিশ পেরোনোর কি সম্পর্ক?
ঠাকুমার বোন ছোট দিদা ঠোঁট রাঙাতেন পান খেয়ে।একটা কিছু চুলে লাগাতেন।সামনের কপালটাতেও অনেক সময় সেই রঙ লেগে থাকত।পান খেয়ে ঠোঁট ঠিক মত লাল না হলে দেখেছি আলতা তুলোয় দিয়ে ঠোঁটে লাগিয়ে নিতেন।কপালে বড় সিঁদুরের টিপ।চওড়া সিঁথিতে সিঁদুর।মাঝে মাঝে মাথা চুলকাতেন।
স্কুলে পড়া বাচ্চাদের মাথায় উকুন থাকে।উকুন ব্রেনের রক্ত চোষে।তাই মাথা চুলকায়।কিন্তু ছোটো দিদা স্কুলে যায় না,তার বাড়িতে কোনও বাচ্চাও নেই। তাহলে?
এই কৌতূহল চলল। নিজের মতো রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টায় ও ঘটনার ঘনঘটায় একদিন আবিষ্কার করলাম ওই যে চুলে ডাই করে,তার থেকেই মাথা চুলকায়।
অবশ্য উকুন কিভাবে আমাদের আক্রান্ত করেছিল ষড়যন্ত্র করে তার গল্পটাও এই রহস্য সমাধানে সাহায্য করেছিল।
আমার ঠাকুরদা যখন মারা যান,তখন ঠাকুমার সব বোনেরা এসেছিলেন।এসেছিলেন পালি মাসিমা দিদা।মানে বাবার মাসি,আমাদের মাসিমা দিদা।তিনি আবার দাদাঠাকুরের ছেলের পুত্র বধূ।পালিমাসিমার খুব ইচ্ছে ছিল আমার মায়ের সঙ্গে তাঁর বড় ছেলের বিয়ে দেওয়ার।কিন্তু মায়ের বিয়ে হল আমার বাবার সঙ্গে।
লাভবান হলাম আমরা।একদিকে তিনি মাকে প্রচন্ড স্নেহ করতেন,অন্য দিকে বাবা তাঁর দিদির ছেলে।আর আমরা তাদের সন্তান।তাই ভালোবাসা দ্বিগুণ। এহেন পালি মাসিমা দিদার সঙ্গে এলো তাঁর দুই নাতনী।এরা যে আমার বাবা হতেও পারতেন তাঁর মেয়ে।অচিরেই তাদের সঙ্গে প্রচন্ড বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।মাটিতে খড় পেতে পাশাপাশি শোওয়া,একসঙ্গে গঙ্গা স্নান ও সারাদিন এঁটে থাকা।আর তার ফলস্বরূপ মাথা ভরে গেল উকুনে।উকুন যে কি দ্রুত বংশ বিস্তার করতে পারে আর মাথার রক্ত কিভাবে চুষে খায় তা সেবার উপলব্ধি করেছিলাম। চিরুনি মাথায় না পরায় তারা নিজেদের গতিতে বেড়ে যাচ্ছিল।এমন হল যে কোনও ওষুধেই তাদের নিধন করা গেল না।অগত্যা কলকাতা ফিরেই মা মাথা নেড়া করে দিল।তখন ক্লাস ফাইভ কি সিক্স।
বন্ধুদের কৌতূহলী মন থেকে বাঁচার জন্য বললাম,আমাদের বংশের নিয়ম ছেলে মেয়ে, পরিবারের সবাইকে( নাতি নাতনি) মাথা নেড়া হতে হবে।
যাহোক,এই উকুনে চুলকানো আর ছোট দিদার চুলকানোর মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করে নিশ্চিত হয়েছিলাম এ উকুনের নয়।
কিন্তু সেই দিদা,যিনি ঠাকুমার বোন ছিলেন,তাঁর কথাগুলো বহুদিন পর্যন্ত মন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।ব্যাক কাউন্টিং অর্থাৎ জীবনকে একটা বয়সের পর পিছন থেকে গুনতে হয়।
কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারিনি,পঞ্চাশ বছরটাই কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? চল্লিশ পেরোলে কেন চালসে আর কেনই বা ফেরার দিনের প্রতীক্ষা!
তবে যে বাবা মাঝে মাঝেই বলেন- “জীবন একটা খাঁচা
এমনি এমনি বাঁচা,”
সেটাই সত্য? উত্তরটা খুঁজে চলি হাজার বছরেরও বেশি বয়ে চলা গঙ্গার স্রোতে আর ধিকধিক করে জ্বলা কাঠের চুল্লির ওপর দিনের শেষ সূর্যের পড়ন্ত আলোয়।তখন অদ্ভুত এক বৈপরীত্য তৈরি হয় মনে।একদিকে বেঁচে থাকার মোহ আর অন্য দিকে কেন বাঁচব, কেনই বা এত কাজ করা,যদি ফিরেই যেতে হবে?
আর তখন অজান্তেই গুনগুন করি বাবার লেখা এই লাইনগুলো –
” এক ফুঁয়েরই তোড়ে
কোথায় যাব ঝরে
তবুও কত আশা
কাজ করছি খাসা”।