সেখানে বাস থামে না, রেলগাড়ি দৌড়ে পালায়;
সেখানে সবুজ টিলায়, মেঘেরা ঘুমোতে যায় ;
সেখানে রূপকথা রাত, ডালে ফুল অন্তবিহীন ,
সেখানে নদীর বাঁকে– ফুরোলেও, হারায় না দিন!
কলকাতার লুম্বিনি পার্ক মানসিক হাসপাতালে সিট পেতে পেতে আরো সপ্তাহ দুয়েক অপেক্ষা করতে হলো, এবং সেই দুঃসহ দিনগুলোতেই একটা মারাত্মক দুঃসংবাদ মামার বাড়িকে কাঁপিয়ে দিলো।মায়ের মেজো বোন, মানে আমাদের মাসি ,মা’র চাইতেও ভালো কন্ঠ সঙ্গীতশিল্পী।রেডিওতে নিয়মিত অনুষ্ঠান করে ।ভালো নাম শিবানী ঘোষ , বাবার প্রিয় খুকু; যাকে হারমোনিয়ামে পেলে আমরা পাগল হয়ে যেতাম শুধু গান শুনতে শুনতে। মা, মাসি আর মণিমামা ,মামার বাড়ির বাইরের ঘরটাকে গানের ত্রিবেণী সঙ্গমে ভাসিয়ে নিয়ে যেত যেন । লতা মঙ্গেশকারের মতোই আরেকজন মারাঠি সঙ্গীতশিল্পী অপূর্ব বাংলা গান গায় ,মাসির গলায় সেই সুমন কল্যাণপুরের মন মাতানো গান না শুনলে জানতেও পারতাম না । বারাসাতে থাকার কারণে মাসি মামারবাড়িতে একটু কম আসতো । আর, মাসি এলেই হৈহৈ করতে করতে আসত ছন্দা আর সমু মাসির দুই ছেলেমেয়ে। আমার একটু লাজুক লাজুক মা যা পারতো না , তা হল, কলকাতা শহরে আমাদের নিয়ে চলাফেরা। কিন্তু , মাসি সেই বারাসাত থেকে ছন্দা আর সমুকে দুই হাতে নিয়ে ট্রেনে বাসে লাগেজ সামলে চেতলায় এসে উপস্থিত হতো। আমার মাসতুতো বোন ছন্দা আমার থেকে মাত্র ছয় মাসের ছোট হওয়ার কারণে আমাকে একেবারেই বেপাত্তা করতো, আবার ভালোওবাসতো।আর আমি কি করতাম ? সত্যি বলছি– হিংসে হিংসে আর হিংসে । ছন্দাকে যেন ঈশ্বর সমস্ত মধুকন্ঠ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন । একটা আমার বয়সি মেয়ে, মা মাসির আবদারে রিনরিনে গলায় গেয়ে উঠছে সন্ধ্যা মুখার্জির গান —
আকাশের অস্তরাগে আমারই স্বপ্ন জাগে,
তাই কি হৃদয়ে দোলা লাগে দোলা লাগে….
আচ্ছা ছন্দা কেন এত ভাল গাইতো ? আমি যে কবিতা বলতে পারি, সেকথা মামার বাড়িতে কোনো পাত্তা দেওয়ার মতো বিষয়ই ছিল না ? মা মাসি মামা আর ছন্দা মিলে গোটা সন্ধে দুপুর জমিয়ে রেখে দিত। আর ,আমি এমন ভাব করতাম, যেন খুব আনন্দ পাচ্ছি । জানিস তো দিদি, তুই ঠিকই বলেছিলি — ঝন্টুর পেটের মধ্যে গজগজ করে শুধু হিংসে । আর সমু আমার থেকে চার বছরের ছোট হলেও কী অসাধারণ এক প্রতিভা ! তবলা বাজানো ওকে কেউ শেখায় নি। কাকে বলে দাদরা ,কাহারবা, ঝাঁপতাল, ত্রিতাল কিছুই শেখেনি; কিন্তু, সেজো মামা একটু বাজিয়ে দিলেই ও বাজিয়ে ফেলতে পারতো এবং অনায়াসেই সবার গানের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করতো।দেখতে কী যে আশ্চর্য লাগতো! ঐটুকু-টুকু দুটো হাত দিয়ে তবলা চাঁটিয়ে যাচ্ছে ,আর চারিদিকে জয়ধ্বনি উঠছে । এ ছেলে বড় হয়ে….
ও ভগবান, আমি সমুকে কিন্তু একটুও হিংসে করতাম না, ভীষণ আদর করতাম ওকে। আমাদের দক্ষিণেশ্বরের বাড়িতে ছন্দা, সমু ,মাসি,মেসো এলে, শুধু আনন্দ আনন্দ আর আনন্দ! বারাসাত কলোনির মোড়ের থেকে একটু দূরে সমুদের ইস্কুল। সেদিন ইস্কুল ফিরতি কয়েক বন্ধু মিলে কলকল করতে করতে কল্যাণী রোড ধরে হাঁটছিল । সমুর হাতে একটা উড পেনসিল ছিল। হঠাৎ কী করে যেন হাত ফসকে রাস্তার দিকটায় পেনসিলটা গড়িয়ে গেল।প্রাণের বন্ধু মদন চিৎকার করে বলল –যাস না সমু… লরি আসছে……
দুসংবাদটা যখন
চেতলার গলি দিয়ে ঢুকে, মামারবাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়ালো,তারপর মৃত্যু সংবাদ হয়ে সোজা দরজা ঠেলে দমকা হাওয়া হয়ে ঢুকে পড়লো,তখন মামার বাড়ির রাঁধুনি নীলমণির মা, আমার মার চুলের জট ছাড়িয়ে চুল ব়ে়ঁধে দিচ্ছিল, আর মাকে আদর করতে করতে বলছিল– হ্যাঁ রে মলিনা (মায়ের ডাক নাম ) , তোর সত্যি সত্যিই আর গান গাইতে ইচ্ছে করেনা ? ঘুম, বিশ্রাম তো ভালোই হচ্ছে রে।এতগুলো ওষুধ খেতে হচ্ছে বলেই কি…
হঠাৎ সমুর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে মা’র কী মনে হল জানিনা, তবে ঠিক অহল্যার মতো পাথর হয়ে গেল। আমি চোখের সামনে নীলমণির মাকে গোঁ গোঁ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখলাম।দিদি তুই বিশ্বাস কর, মামার বাড়ি থেকে একটা কান্নার আওয়াজও উঠছে না।কান্না যখন শোকে পাথর হয়ে গিয়ে কাঁদতে ভুলে গেলো , তখন আর কেউ শুনুক বা না শুনুক, বাইরের ঘর থেকে , নাকি ভর সন্ধের আকাশের কোথাও আমাদের প্রিয় মাসির গলায় সুমন কল্যাণপুর কান্না ঝরিয়ে দিচ্ছিল…..
ভোরের আকাশ থেকে আলো মুছে নিওনা…
ভুলের আমার স্বর্গ যেন ভেঙে দিও না গো, ভেঙে দিও না…
আমার স্বপ্ন দেখা দুটি নয়ন, হারিয়ে গেল কোথায় কখন ,
কেউ তা জানেনা গো, কেউ তা জানে না…
একসময় মামা’রা একটা গাড়ি জোগাড় করে ছুটলো বারাসাতে । জ্ঞান ফিরে নীলমণির মা আবার রান্নাঘরে ঢুকলো। দিদিরে, পেটের খিদে বোধহয় সব দুঃখকেই ভুলিয়ে দেয়। একসময় মা চোখের জলে ভাসতে ভাসতে আমার মাথায় হাত রেখে বললো–ঝন্টু ,আমি কখনও পাহাড় দেখিনি রে। আর ঝরণা কি করে পাহাড়ের গা দিয়ে নেমে আসে, তাও দেখিনি। তুই বড় হয়ে আমাকে শিলং পাহাড়ে নিয়ে যাবি ? তারপর আমাকে চমকে দিয়ে বলে উঠলো,ঝন্টু তোর ছোটোমাসি দীপা কোথায় রে ? এই ভর সন্ধেবেলা কোথায় বেরোলো সে ? ছোটোমাসি মার কাছে এসে কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে দিয়ে বললো– বড়দি, আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে রে । মা হঠাৎ নীলমণির মার দেওয়া চা ভর্তি কাপটা উঠোনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো– সমুকে কেন চলে যেতে হল , ভগবান জবাব দাও। আমাদের সমু তোমার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছিল ? ঝন্টু… তুই আমাকে ধরে থাক। আর আমার গানের খাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে দে। মণি,দুলাল– তবলাগুলো আছড়ে ভেঙে ফেলে দে। এ বাড়ির সমস্ত গান বন্ধ করে দে। দিদিমা (আমরা ডাকি ভাই বলে), সেই যে ঘরের দরজা বন্ধ করেছে, আর খোলে নি।
এতক্ষণে খোলা সদর দরজা দিয়ে পাড়ার সুজন প্রতিবেশীরা সমুর জন্য আমার মায়ের বুকফাটা কান্নাকে ঘিরে দাঁড়ালো ,আর তার মধ্যে হঠাৎ দেখলাম, বাবা কখন এসে দাঁড়িয়েছে।ক্যাওড়াতলা মহাশ্মশান এ বাড়ি থেকে তো খুব কাছেই; যেন সেখানকার কাঠের চিতার উড়ন্ত ছাই এবাড়ির দমবন্ধ বাতাসের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো।আমাদের বাবা তখন উঠোনের ভিড় থেকে ভাঙা কাপের টুকরোগুলো একটা একটা যত্ন করে তুলছে , যাতে কারোর পা কেটে না যায়।
দিদি, দিদি রে , আমাদের মিস্টি ভাই সমু চিরদিনের মতো চলে গেল …..