মাঝরাতে ঘুম ভাঙল আচমকা। কোথাও খুট করে শব্দ হল কি? আজকাল ঘুমটা পাতলা হয়ে গেছে খুব। অল্পতেই ভেঙে যায়। সামান্যতেই রেশ কেটে যায়। ডিম লাইটের আলোয় উঠল বেনু। হাত বাড়িয়ে সাইড টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি খেল ঢকঢক। দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িতে সময় দেখল অজান্তেই। দেড়টা। অথচ সে ভেবেছিল ভোর হয়ে এসেছে প্রায়। সময়টা দেখে মেজাজটাই বিগড়ে গেল। এখন বাকী রাতটা নির্ঘুম কাটাতে হবে তাকে। ইদানীং ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয়। একবার ঘুম ভেঙে গেলে সহজে ঘুম আসে না আর। কিন্তু ঘুমটা কেন ভাঙল আচমকা সেটাই ভেবে পেল না বেনু। বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল। বাথরুম থেকে ফিরে বারান্দায় গিয়ে বসল অগত্যা। চৈত্রের শেষ। ঝকঝকে আকাশে তারার মেলা। ফুটফুটে জোছনায় উল্টোদিকের কবরস্থানটা কেমন ভৌতিক দেখাচ্ছে। থম ধরে আছে প্রাচীরঘেরা বিশাল জায়গাটা। সারি সারি কবর। মাঝে মাঝে গাছের এলোমেলো উপস্থিতি আর তাদের লম্বা ছায়া হাওয়ার সাথে মিতালি পাতিয়ে দুলছে, কেমন এক রহস্যের জালে জড়িয়ে দিচ্ছে জায়গাটাকে। স্থির তাকিয়ে থাকল বেনু। জন্মাবধি জায়গাটাকে দেখে আসছে সে। ভয় বলতে যা বোঝায় সেটা ওদিকে তাকালে এখন হয় না আর। শৈশবে হতো। কেমন গা ছমছমে এক অনুভূতি এসে জাপটে ধরত তখন। সেসব অতীত এখন। বয়সের সাথে সাথে বোধগুলোও কেমন পরিবর্তিত হয়, মুখ লুকায় সময়ের গুহায়, ভেবে অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস পড়ল বেনুর। মা ঘুমিয়ে আছে ওখানটায়, বাবাও। ঘুমিয়ে আছে আরো কত আপনার জন। জায়গাটাকে বড় আপন মনে হয় তার। বড় চেনা। সে-ও ঘুমিয়ে পড়বে একদিন। ওখানেই। আর জাগবে না। আর উঠবে না। ভাবতেই দারুণ এক প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ল শরীরজুড়ে। ইচ্ছে হল ঘুমিয়ে পড়ে এখনই। পাশের রুমে হাজী বক্কর আলীর তুমুল নাসিকাগর্জন এখান থেকেই শোনা যাচ্ছে। বিউটি আর মেহেরবানু ঘুমাচ্ছে কণার রুমে। সারাবাড়িটাতে আর কোনো শব্দ নেই। হাজী বক্কর আলীর নাক ডাকানো বাদ দিলে নিজের নিঃশ্বাসের শব্দটুকুও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে বেনু। ইচ্ছে হল লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে ডেকে তোলে। তার নিজের শরীরে এত অসুখ, এত অশান্তি অথচ লোকটা কী নির্বিকার ঘুমায়! হিংসেয় বুক জ্বলে বেনুর। রাগ হয় ভীষণ। সদ্য গজানো কবরটার দিকে তাকিয়ে থাকে জ্বলজ্বলে চোখে। আজ রাতেই কবর দেয়া হয়েছে লোকটাকে। দশটার দিকে। খানিক বাদেই ফাঁকা, চলে গেছে যে যার পথে। কী নিঝুম এখন কবরটা! আহা। জীবন কী ভীষণ মিথ্যে আর ঠুনকো! বেনুও অমনই নিঝুম নীরবতায় ডুবে যেতে চায়। এই মিথ্যের বেসাতিতে সে হাঁপিয়ে উঠছে ক্রমশ। কণার মুখটা মনে পড়ে। আনমনে মাথা নাড়ে বেনু। চোখ মোছে আঁচলে। না। বেনুকে আর প্রয়োজন নেই কণার। বড় হয়ে গেছে কণা। মাকে ছাড়া চলবে তার। কষ্টটুকু সইয়ে দেবে দুরন্ত সময়। বক্কর আলীরও দিব্যি চলবে তাকে ছাড়া। ছেনাল মাগীটার সাথে তার সম্ভবত লটরপটর জমে গেছে এতদিনে। প্রথম প্রথম চোখে চোখে রাখত বেনু। এখন আর ওসবে আগ্রহ নেই। চুলোয় যাক বক্কর আলী আর ঐ ধুমসি মাগী। তার এখন অবসর চাই। সবকিছু থেকে সে গুটিয়ে নিতে চায় নিজেকে। সে এখন কামনা করে প্রশান্তিময় এক ঘুম। হঠাৎই টোটনের মুখটা মনে পড়ল বেনুর। যাবার সময় বারবার বলছিল, বোকামি করো না বেনু। শেষ পর্যন্ত লড়তে হবে তোমাকে। বাঁচতে হবে। কেন এমন হাল ছেড়ে দিচ্ছ বলো তো! বাঁচতে চাও না?
টোটনের মুখের দিকে নির্ণিমেষ তাকিয়ে ছিল বেনু। কণ্ঠে বিতৃষ্ণা আর নিরাসক্তি ঢেলে বলেছিল, না টোটন। বাঁচতে চাই না আর। অনেক তো বাঁচা হল। আর বেঁচে কী হবে! হাঁফ ধরে গেছে আমার।
উত্তরে কী কী সব যেন বলেছিল টোটন। বেনুকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল খুব করে। শুনে হাই তুলেছিল বেনু। ক্লান্ত লাগছিল তার। এখন, এই মাঝ রাত্তিরে আলো-ছায়ার লুকোচুরি-ডোবা কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেদিনের সেই ক্লান্তি এসে ভর করল শরীরে, মনে। মনে পড়ল টোটনকে। এক সময় এই টোটনের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারত বেনু। বুকে জমিয়ে রাখত এক সমুদ্র ভালোবাসার অতল জল। থাকত সীমাহীন প্রতীক্ষাও। অথচ আজ! কিছু নেই। কিছুই অবশিষ্ট নেই এখন আর। টোটন এখন বহুদূরের কেউ। টোটন আর কেউ নয় এখন তার। দীর্ঘশ্বাস পড়ল আবার। জীবন বড় অদ্ভুত। ফুরিয়ে যায় তবু জিইয়ে রাখে মায়ার মোহন ঘোর। হারিয়ে যায় তবু পুষে রাখে ঈর্ষাকাতর অধিকারের বোধ। নইলে টোটন কেউ নয়, এটুকু ভেবে কেন দীর্ঘশ্বাসের ভারে ভারী হয়ে ওঠে বেনুর ক্ষয়াটে হৃৎপিণ্ড! কেন দ্রুততর হয় তার হৃৎস্পন্দন! অন্ধকারে বসে টোটনের মুখটা মনে করার চেষ্টা করল বেনু। অগোচরেই দুফোঁটা জল গড়াল দুচোখ বেয়ে। কোথায় আছে এখন টোটন? কোন সুদূরে? টোটন বলেছিল এবার যাবে ভিয়েতনাম হয়ে কম্বোডিয়া। বলেছিল, দেরি হবে এবার ফিরতে। কত দেরি হবে টোটন? আর কখনও তোমার সাথে দেখা হবে তো? ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে বেনু। নিজের কণ্ঠটা নিজের কাছেই অপরিচিত শোনায়। রাত্রির নিঝুম নির্জনতার বুক চিরে বের হওয়া ফিসফিসে কণ্ঠে কেমন কেঁপে ওঠে বেনু। হঠাৎ কেমন শীত শীত লাগে। উঠে পড়ে বেনু। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করে। ঘুম আসে না একদম। একবার ইচ্ছে করে কণাকে ফোন দেয়, কথা বলে। পর মুহূর্তেই ভাবনাটা নাকচ করে দেয়। সারাদিন ব্যস্ত থাকে মেয়েটা। অনেক চাপ থাকে পড়ার। এত রাতে ঘুম ভাঙিয়ে তাকে বিরক্ত করার কোনো মানে হয় না। টোটনকে ফোন করলে কেমন হয়? ভাবল বেনু। কণা তার ফোনে হোয়াটস এপ না কি একটা জিনিস সেট করে দিয়ে গেছে এবার। বেনু অত কিছু বোঝে না। কণা দেখিয়ে দিয়ে গেছে তাকে, কীভাবে ফোন রিসিভ করতে হয়, ফোন দিতে হয়। কণার সঙ্গে ইদানীং কথা হয় এভাবেই। কণাই ফোন দেয় সচরাচর। রিসিভ করে বেনু। কণাকে দেখাও যায় এখন কথা বলার পাশাপাশি। এমবি শেষ হলে কণাই রিচার্জ করিয়ে দেয় আবার। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল বেনু। টোটনের নাম্বারটা বের করল খুঁজে। নাই টোটন। গতকাল শেষ হোয়াট এপে এসেছে টোটন, তারপর আসেনি আর। ফোন রেখে শুয়ে পড়ল বেনু। টোটন এখন কোথায় কে জানে! ঘুমাচ্ছে, নাকি জেগে? ভাবনাটা মনে আসতেই ফিক করে হেসে ফেলল বেনু। কিশোরী বয়সে এমন ভাবত সে। তখন টোটনকে বলত, তুই যখন ঘুমাবি আমিও ঠিক তখন ঘুমাতে যাব। আমরা একইসময়ে ঘুমিয়ে পড়ব আবার একইসময়ে জেগে উঠব, ঠিক আছে?
টোটন হাসত। চোখ টিপে বলত, ধূর! তারচে একসঙ্গে ঘুমানোর ব্যবস্থা করলে ভালো হয় না?
লজ্জায় লাল হয়ে বেনু বলত, অসভ্য কোথাকার!
তার ফর্সা গাল লাল হয়ে উঠত ভীষণ, রক্ত ছুটে বের হতে চাইত যেন। বিস্মিত হয়ে বেনুর দিকে তাকিয়ে থাকত টোটন। বেনুকে দেখে কিছুতেই তৃষ্ণা মিটত না তার। তাকিয়ে থাকত নিমেষহীন। তারপর কত জল গড়িয়ে গেল এই গড়াইয়ের বুক চিরে। কতবার চর পড়ল আর পার ভাঙল তার। বেনুও কিশোরীবেলা পার করে কলেজে ভর্তি হল, টোটন ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে চলে গেল ঢাকায়। পরের দৃশ্যপটগুলো পরিবর্তিত হয়ে গেল খুব দ্রুত। সেখানে ঢুকে পড়ল হাজী বক্কর আলী। টোটনের বাবার সঙ্গে বেনুর বাবার সম্পর্কের রেষারেষি শেষ হল হাজী বক্কর আলীর সাথে বেনুর বিয়েতে গিয়ে। বাবা মারা গেল। বাবার সঙ্গে অভিমান করে পড়াশোনা সেই যে পড়াশোনা ছাড়ল বেনু আর ও পথ মাড়ায়নি সে। নইলে তার মতো ভালো স্টুডেন্ট এ তল্লাটে কে ছিল আর! দীর্ঘশ্বাসে খানিকটা ক্ষোভ হাওয়ায় ছড়িয়ে দিল বেনু। খানিকটা কষ্ট। তার মেয়ে কণা মেডিকেলে পড়ে এখন। বেনুও কি পারত না! তারও স্বপ্ন ছিল, ছিল সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের দুরন্ত স্পৃহা। তবু বাস্তবে হয়নি কিছুই। দুটো পরিবারের মিথ্যে রেষারেষি তার জীবনটাকে স্থবির করে দিল। সে এখন বেনু মশলাঘরের মালিক। গা থেকে মশলার গন্ধ আসে ভুরভুর। ভাবতেই গা গুলাল বেনুর। বেসিনে গিয়ে উগরে দিল যা ছিল পেটে।