|| বিশ্ব নারী দিবস ও পার্ল এস বাক || লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

বিশ্ব নারী দিবস ও পার্ল এস বাক:

মা হয়ে ওঠা এক বিশ্ব নারী।

পার্ল এস বাক ( ২৬.০৬.১৮৯২ – ০৬.০৩.১৯৭৩)।  তিনিই প্রথম আমেরিকান মহিলা, যিনি সাহিত্যে নোবেলজয়ী। সালটা ছিল ১৯৩৮। আমেরিকার মহিলা বলছি বটে, তবে তিনি আশি বৎসরব‍্যাপী জীবনের বেয়াল্লিশ বছর বয়স অবধি চীন দেশে কাটিয়েছেন। তিনি প্রকৃত অর্থে বিশ্ব নাগরিক, আর বিশ্ব মাতৃত্বের প্রতীক। বিশ্ব নারীদিবস উপলক্ষে তাঁকে বিশেষ ভাবে মনে করি। তিনি বলতেন, মেয়েরা ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসো। পুরুষেরা এসো ঘরে। এটাই হোক আজকের শিক্ষা। ঘর চেয়েছে পুরুষকে, আর বিশ্বভুবন চেয়েছে নারীকে। সভ‍্যতার পরিচয় দিতে চেয়ে বলতেন, একটা সভ‍্যতার মান বিচার করতে চাইলে দ‍্যাখো, সে তার সবচাইতে অসহায় মানুষের জন‍্য কতটুকু যত্ন নেয়।
একটা দেশ কেমনভাবে চলবে, সেই নিয়ে চাঁচাছোলা বক্তব্য তাঁর। বলেন, যে দেশে ভাল মানুষগুলোকে বোবায় পেয়েছে, যারা সংগ্রামে ঢিলে দিয়েছে, নজরদারিতে মন নেই, সেই দেশে নোংরা লোকদের দাপট বাড়ে।
 সমস্ত পৃথিবীটাকে ভাল মন নিয়ে খুঁজতে চাইলেন তিনি। সারাজীবন ধরে কত বিষয়েই না মাথা ঘামালেন! মেয়েদের অধিকার তো বটেই, যুদ্ধ, পারমাণবিক বোমা হামলা, বিশ্ব জোড়া ত্রাস, উচ্ছেদ, দেশান্তর, আর অনাথ শিশুদের পুনর্বাসনের মতো বিষয়ে  লাগাতার কাজ করেছেন তিনি। কাজ করতে করতে কলমের যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন।
 ১৯৩১ সাল। দু দুটি বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে একটা স্মরণীয় ব‍ৎসর। আমেরিকায় মুক্তি পেয়েছে চার্লি চ‍্যাপলিনের সিটি লাইটস। আর ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রুপোলি পর্দায়। সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা হয়েছে। স্ট‍্যালিন ভীষণভাবে চাইছেন সোভিয়েত দেশকে প্রথম সারির শিল্পোন্নত দেশ করে গড়ে তুলবেন। চীনের বুকে ইয়াংসি নদীতে ভয়াবহ বন‍্যা। লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘর হারিয়ে ঠিকানা হারিয়ে রিফিউজি।
গান্ধীজি ভারতের বুকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করছেন। ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার তাঁকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেও একসময় ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। আর লাহোরে বসেছে সর্ব এশীয় প্রমীলা কনফারেন্স।
 নিউজিল্যান্ডের হক বে তে সাংঘাতিক ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে, আর মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠছে। প্রায় পাঁচশো বার কেঁপে কেঁপে উঠেছে।
আমেরিকায় তৈরি করা হচ্ছে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। পরবর্তী চল্লিশ বছর ধরে যে সবচেয়ে উঁচু বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পাবে।
আর পৃথিবী জুড়ে মন্দা আর বেকারত্ব। জার্মানিতে নাৎসি পার্টি  নাচন কোঁদন শুরু করেছে।
 বিখ্যাত বামপন্থী ও ট্রেড ইউনিয়নিস্ট পিয়ের লাভাল ভোটে জিতে ফ্রান্সে ক্ষমতা পেয়েছেন। পরে তিনি বামপন্থী মেজাজ ঝেড়ে ফেলে দক্ষিণপন্থী হবেন।
এমন এক টালমাটাল ১৯৩১ সালের মার্চ মাসের দুই তারিখে প্রকাশিত হল গুড আর্থ, তিনশো ছাপ্পান্ন পৃষ্ঠার এক ইংরেজি ভাষার উপন্যাস। গুড আর্থ এ বিশ্বাসযোগ‍্য ভাবে তুলে ধরলেন চীন দেশের কৃষক সমাজের মর্মকথাকে। সূচনা হল এক ট্রিলজির, ১৯৩১ এ ‘গুড আর্থ’, ১৯৩২ এ ‘সনস’, আর ১৯৩৫ এ ‘এ হাউস ডিভাইডেড’।
ওয়াং লুঙ, আর তস‍্য পত্নী ও লান, এই গরিব চীনে দম্পতির গার্হস্থ্য।
 আমেরিকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে জন্মে কৈশোরের পড়াশুনা ও কলেজ পর্ব আমেরিকাতে সম্পন্ন হলেও  বাক আসলে বড়ো হলেন চীনে। পার্লের বাবা অ্যাবসালোম সিডেনস্ট্রিকার (১৮৫২ – ১৯৩১) ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক। ধর্মীয় মানুষের মতোই নারীজীবনের প্রতি বাস্তব সহমর্মিতার অভাব ছিল লোকটির। পার্লের মা ক‍্যারোলিন স্টালটিং সিডেনস্ট্রিকার (১৮৫৭ – ১৯২১) আধো খ‍্যাপা স্বামীকে নিয়ে সারাজীবন কষ্ট পেয়েছেন। মা বাবাকে নিয়ে তাঁদের দাম্পত্য জীবনের খুঁটিনাটি নিয়ে ১৯৩৬ সালে দু দুটো ব‌ই লিখেছেন। মাকে নিয়ে লিখেছেন দি এক্সাইল (নির্বাসন) : পোর্ট্রেট অফ অ্যান আমেরিকান মাদার। এই রচনাটি উইমেনস হোম কমপ‍্যানিয়ন কাগজে ১৯৩৫ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৩৬ সালের মার্চ অবধি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।
বাবাকে নিয়ে ওই ১৯৩৬ সালেই বেরিয়েছে ফাইটিং এঞ্জেল : পোর্ট্রেট অফ এ সোল।
আত্মজীবনীও লিখেছেন পার্ল। ১৯৫৪ সালে মাই সেভারাল ওয়ার্ল্ডস: এ পারসোনাল রেকর্ড। আর ১৯৬২ সালে এ ব্রিজ পাসিং।
দশ বছর বয়স পেরোতে না পেরোতেই কলম ধরেন পার্ল। নভিস ছদ্মনামে সাংহাই মার্কারি কাগজে প্রথম গল্প লেখা। সেটা ১৯০২ সাল।
 তারপর ১৯১১ সালে কৈশোর পেরোনোর দিনে  লেখেন দি রিয়েল সান্তা ক্লস। আর ভিলেজ বাই দ‍্য সী। একের পর এক গল্প বুনে চলেন পার্ল। ১৯১২ তে বাই দ‍্য হ‍্যাণ্ড অফ এ চাইল্ড। ১৯১৪ তে দি আওয়ারস অফ ওয়রশিপ। ১৯২৫ সালে রেনি ডে, ১৯২৬ সালে এ চাইনিজ ওম‍্যান স্পিকস, এরকম অনেক গল্প।
১৯৩১ সালে লিখলেন দি ফার্স্ট ওয়াইফ। ১৯৩২ সালে দি ওল্ড চাইনিজ নার্স, ১৯৩৩ সালে দি কমিউনিস্ট, দি রিফিউজিস, আর দি রিটার্ন লিখেছেন। ১৯৫৩ সালে লিখেছেন মুন ওভার ম‍্যানহাটান, ১৯৫৭ সালে হনিমুন ব্লুজ়, আর ১৯৬৪ সালে ইণ্ডিয়া মাই ইণ্ডিয়া। এগুলি তাঁর সুপ্রচুর গল্পের মধ‍্যে কয়েকটি।
বাক এর গুড আর্থ নিয়ে আরো কিছু বলা দরকার। এই উপন‍্যাসে চীনের কৃষকের জীবনকে তিনি ছুঁতে চেয়েছেন। এক সম্পন্ন স্বচ্ছল গৃহস্থ পরিবারে বাঁদিগিরি করত ও লান, প্রচণ্ড পরিশ্রমী একটা মেয়ে। তার সাথে বিয়ে হল ওয়াং লুঙ এর।
হদ্দ গরিব ওয়াঙ লুঙ। সংসার মোটে চলতে চায় না। চীনদেশে গরিবের বেঁচে থাকাই ঝকমারি। তার উপর একের পর এক সন্তান আসে। হবে নাই বা কেন? জন্মনিয়ন্ত্রণ সরঞ্জামের আয়োজন নেই যে! ও লান একটা মেয়েবাচ্চাকে আঁতুড়েই মেরে ফেলল।
ওয়াং লুঙ কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে পাড়ি দিল শহরে। রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করবে। কিন্তু কে বা রিকশা চড়ে? চালক বিস্তর, স‌ওয়ারি ক‌ই?
ছেলেগুলো বড় হচ্ছে। বড় খিদে ওদের। মুখের দিকে তাকানো যায় না। ওয়াং লুঙ সম্মান নিয়ে চলতে চায়। মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়। শ্রমের অন্নে পেট ভরাতে চায়। ছেলেরা বোঝে না। কচি বয়সে খিদে চেপে থাকা শক্ত। একদিন ওরা কোথা থেকে মাংস যোগাড় করে আনল। পয়সা তো ওদের কাছে ছিল না! তাহলে চুরি করেই জুটিয়ে এনেছে দ‍্যাখো। ছি ছি, তার ছেলেরা শেষে চোর হল! প্রচণ্ড আত্মগ্লানিতে মাংসের দলাটা রাস্তার ধুলোয় ছুঁড়ে ফেলে দেয় ওয়াং লুঙ। কিছুক্ষণ পরে তার বৌ ও লান গিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা মাংস খণ্ডটা তুলে আনে। বড় মাথা ঠাণ্ডা তার। জানে, একটু পেটে খেতে না পেলে জান টিঁকবে না।
ওয়াং লুঙ বাস্তবটা দেখতে থাকে। একবার একটা বিশাল বড়লোকের বাড়ি লুঠ হল। ওয়াং লুঙ এখন আর নৈতিকতা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে চায় না। লুঠেরাদের মধ‍্যে ভিড়ে গিয়ে সে সোজা বড়লোক টাকে জানে মেরে দেবার ভয় দেখাল। গুণ্ডা সাজা ওয়াং লুঙ এর হাত থেকে বাঁচতে চেয়ে দামি দামি রত্নসম্ভার তার হাতে তুলে দিল বড়লোকটা। ওয়াং লুঙ এবার সংসার নিয় ফিরল পুরোনো জায়গায়। লুঠ করা টাকাপয়সা দিয়ে সে সেই স্বচ্ছল গৃহস্থদের জমির খানিকটা কিনে ফেলল।
তারপর পুষল মেয়েমানুষ। ঘরে তার পরিশ্রমী বৌ ও লান থাকা সত্ত্বেও মেয়েমানুষ পুষতে বাধল না তার। ছেলেরা বড় হয়ে গেল। তারা প্রৌঢ় বাপকে পাত্তা দেয় না। তাদের ঘরে ঘরে বৌ এল। বৌরা সারাদিন নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি করে। ওয়াং লুঙের খারাপ লাগে। শরীর খারাপ হল পুরোনো বৌ ও লান এর।  লুঠের ভাগ থেকে ও লান দুটো মুক্তো বাঁচিয়ে রেখেছিল। মৃত‍্যুশয‍্যায় অশক্ত হাতে সেই মুক্তোদুটো তুলে দিল স্বামীর পোষা মেয়েমানুষের হাতে। বোন, আমার দিন ফুরিয়েছে। আমি যাই। তুমি আমার বুড়োটাকে দেখো। ও লানের জন‍্য চোখের জল গড়িয়ে পড়ে ওয়াং লুঙের। এই নিয়ে গল্প গুড আর্থ। আর তার‌ই সূত্রে ট্রিলজি।
চীনের চাষির জীবন নিয়ে লেখা পার্লের গুড আর্থ ১৯৩১ ও ১৯৩২ সালে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত ব‌ইয়ের খেতাব পেল। গুড আর্থ এর সূত্রেই ১৯৩২ সালে  পার্ল পেলেন পুলিৎজার। লাইফ ম‍্যাগাজিন বলল, ১৯২৪ – ১৯৪৪ এই কুড়ি বছরে প্রকাশিত সেরা একশো ব‌ইয়ের অন‍্যতম এটি। তারপর ১৯৩৭ এ এই ব‌ই নিয়ে ফিল্ম।
১৯৩১ সালে চীনের বিধ্বংসী বন‍্যায় হতাশ্রয় গরিবের কাহিনি পার্লের কলমে ঝরণা হয়ে উছলে উঠল। বাস্তু হারানো নিরন্ন মানুষের জীবন নিয়ে একের পর এক গল্প।
ইয়াংসি নদীর বন‍্যায় বাস্তুহারা বৃদ্ধ অশক্ত চাষিটির গল্প লেখেন পার্ল। বৃদ্ধের ছেলে বৌ কোথায়! ঝাঁকায় করে সামান্য যা কিছু বন‍্যার কবল থেকে সে বাঁচাতে পেরেছে, তাই, আর শিশু নাতিটিকে নিয়ে পথ হাঁটে বৃদ্ধ।
 নিজে সে খায় নি কতদিন। শিশু নাতিটিও। ক্ষুধায় নিতান্তই কাতর বেচারা। হাঁটা দূরস্থান, দাঁড়িয়ে থাকার পর্যন্ত সামর্থ্য নেই শিশুটির। তাই তাকে ঝাঁকায় শুইয়ে দিয়ে তাকে কাঁধে নিয়ে কোনো ক্রমে পথ হাঁটে বৃদ্ধ পিতামহ।
ঝাঁকায় শুয়ে থাকা বাচ্চাটাকে কেউ দেখলে ভাববে মৃত। এতটাই করুণ অবস্থা তার। বৃদ্ধের‌ও পা চলতে চাইছে না। তবু অদম‍্য চেষ্টায় সে টলমল পায়ে কোনোমতে হেঁটে চলেছে।
এমন সময় একজন পথিক দয়ার্দ্র হয়ে বৃদ্ধকে পয়সা ভিক্ষা দিল।
 তার পর কি কি হয়, পড়তে গিয়ে বৃদ্ধ চাষির প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে আমার। আত্মমর্যাদাবোধে সুস্থিত এই ধরণের চাষি অবশ‍্য‌ই বিপ্লবের সহায়ক শক্তি। পার্ল এস বাক চেনান চীনের সংগ্রামী চাষিকে।
 পার্ল সিডেনস্ট্রিকার বাক কলাকৈবল‍্যবাদী ছিলেন না। তিনি মানুষের জীবনের কথা পরম আগ্রহে লিখে গিয়েছেন। কথার সুষমায় কতটুকু সৌন্দর্য গড়ে উঠল, সেই নিয়ে মাথা ব‍্যথা ছিল না পার্লের। তবে তিনি মনের কথা সপাটে বলতে জানতেন। বানিয়ে গুছিয়ে কী বললে শৌখিন সেজে থাকা যাবে, স্থিতাবস্থার গায়ে আঁচড়টি না কেটে রাজনৈতিক বিতর্ক সাবধানে এড়িয়ে বাঁচা যাবে, এমন গোছের সাহিত‍্যিক বাক ছিলেন না। বর্ণবিদ্বেষ, লিঙ্গবৈষম‍্য, আর যুদ্ধদীর্ণ এশীয় এলাকার শিশুদের কষ্ট নিয়ে তিনি আমেরিকার মানুষকে সচেতন হতে বলেছেন। দরকার বুঝলে কঠোরভাবে সমালোচনা করতে দ্বিধাবোধ করেন নি। একজীবনে পার্ল অনেক মাত্রার জীবনযাপন করেছেন। তিনি ভাল বধূ হতে চেয়েছিলেন। দায়িত্বশীল স্নেহময়ী মা, আবার এক‌ই সাথে দক্ষ লেখক, সমর্থ সম্পাদক হয়ে উঠেছিলেন। বিশ্ব ব‍্যাপারে তাঁর নিজস্ব মতামত প্রকাশে দ্বিধা ছিল না। আর রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্টের ভূমিকা পালনেও তাঁর অনীহা ছিল না। নিজেকে পার্ল সিডেনস্ট্রিকার বাক নানা ভূমিকায় আবিষ্কার করেছেন।
প্রেম সম্বন্ধে বাক বলেন, গায়ের জোর খাটিয়ে ভালবাসা আদায় করা যায় না। কান মুচড়ে দিয়ে, চোখ রাঙিয়ে, জবরদস্তি করে ভালবাসা হয় না। রবি ঠাকুরের ভাষায় বলতে গেলে এ যেন কোন্ সুদূর হতে আমার মনোমাঝে/ বাণীর ধারা বহে — আমার প্রাণে প্রাণে। …. এই ধরণীরে গগন-পারের ছাঁদে সে যে তারার সাথে বাঁধে.. কিংবা ওগো, বাতাসে কী কথা ভেসে চলে আসে, আকাশে কী মুখ জাগে! ওগো, বনমর্মরে নদীনির্ঝরে কী মধুর সুর লাগে।
 বিবাহিত জীবনযাপন বিষয়ে বাক বলেন, ভাল দাম্পত্য আমি তাকেই বলব, যা সংশ্লিষ্ট ব‍্যক্তিদুজনের ক্রমবিকাশ এবং  ক্রমবিবর্তনের পথরোধ না করে দাঁড়ায়। তাদের প্রেমপ্রকাশের ভাষায় যেন মালিন‍্য না থাকে।
 অথচ ব‍্যক্তিজীবনে বাক একটি প্রেমহীন অসাড়তার মধ‍্যে পড়েছেন আর চৈতন্যের জোরে তা থেকে মুক্তিও অর্জন করেছেন।
১৯১৭ সালে বছর পঁচিশ বয়সে পার্ল সিডেনস্ট্রিকার এর বিয়ে হয়েছিল জনৈক কৃষিবিজ্ঞানী জন লসিং বাক এর সাথে। এঁর পদবি বাক সারাজীবন বহন করেছেন। এই বিবাহে একটি অনিন্দ্য সুন্দরী কন‍্যাসন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু কন‍্যাটি রূপে অনুপম হলেও মস্তিষ্কের বুদ্ধি বিকাশ ঘটিত নিদারুণ ও দুশ্চিকিৎস‍্য রোগের শিকার ছিল। বয়স অনুযায়ী যখন শিশুকন‍্যার বুদ্ধি বিকাশ হয়ে উঠল না, এমনকি ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিলেন, তখন পিতা জন লসিং শিশুটির প্রতি সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন গবেষণায়। শিশুকে তো মা ফেলতে পারেনা। দুনিয়ার কোণায় কোণায় গিয়ে ব‍্যাকুল মাতৃহৃদয় শিশুর চিকিৎসা খুঁজেছেন। পরে নিরুপায় হয়ে এ ধরনের শিশুদের জন‍্য হোম খুঁজেছেন। পার্লের সেই জীবনযন্ত্রণা ধরা আছে দি চাইল্ড হু নেভার গ্রি‌উ রচনায়।
যে বিপদে পাঁচজন কুঁকড়ে পড়ে, প্রকৃত মানুষ সেই বিপদের সামনে স্বীয় মনুষ্যত্বের পরিচয় রাখে।
পার্ল তাই করলেন। অনাথ বাচ্চাদের দত্তক নিজে নিলেন। অন‍্যদের নিতে উৎসাহ যোগালেন। এক আধ দিন নয়, পাঁচ দশক ধরে প্রায় পাঁচ হাজার বাচ্চার বাপ মায়ের কোল জোগাড় করেছে পার্লের সংস্থা। যে বাচ্চাদের বাপ মা জুটল না, তাদের‌ও পুনর্বাসন দিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন পার্ল।
 ১৯৭৩ সালে আশি বছর বয়সে পার্ল এস বাকের প্রয়াণ। ফুসফুসের ক‍্যানসারে ভুগে ভুগে। আজ পার্ল এস বাকের জন্মভিটায় একটি মিউজিয়াম ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়েছে। বাক চেয়েছিলেন এই বাড়িটি যিনিই দেখতে আসতে চাইবেন, তাঁরই আপন হবে। আর এই বাড়ি সারা পৃথিবীতে নতুন ধরনের চিন্তা ভাবনা , নবীন স্বপ্ন আর জীবনবোধের সিংহদুয়ার খুলে দেবে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।