• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক শিল্পকলায় শিল্পের জন্য শিল্প – লিখেছেন আলবার্ট অশোক (পর্ব – ৩৯)

ইন্সটলেশান আর্ট – ১

ইনস্টলেশান আর্ট। পাবলিক আর্ট

শিল্পীদের মূলতঃ দুটি ধারায় শিল্পকর্ম সৃষ্টির পথে এগোয়। (উপরের ছবিগুলি একটু দেখে নিন)

১। কিছু মানুষ বস্তু, মানুষ, জন্তু পাখীর ছবির সাথে এত আচ্ছন্ন যে তারা যাই করে তাদের যাত্রা পথ বিন্দু ওই বস্তুর মাধ্যমেই শুরু করে। ও তার ভাবনার বিন্দুতে গিয়ে শেষ করে।
২। কিছু মানুষ আগে ভাবনাটাকে যাত্রা শুরুর বিন্দু হিসাবে ভাবে ও তারা কোন বস্তু বা কোন অর্থবহ বিমূর্ত কিছুতে গিয়ে শেষ করে। সেইজন্য, আমরা দেখি শিল্প কর্মে বস্তুর প্রতিকৃতি বা কখনো বস্তুহীন ভাবনার ছবি।কোথাও বস্তুটা বড় প্রকাশ্য মনে হয়, কোথাও ভাবনাটা বিশাল হয়ে প্রকাশ পায়। বস্তু প্রকাশ পেলে সাধারণ মানুষ সহজে গ্রহন করে। ভাবনা বড় হলে, সাধারণ মানুষের বোধের নাগাল পায়না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। ফলে সর্বত্র শিল্প কর্মের মূল্যায়ন আশা করা বৃথা।
ইনস্টলেশান মানে কিছু জায়গা জুড়ে কিছু শিল্প কর্মের অর্থবহ সাজানো, শিল্পী এমন ভাবে সাজান যাতে দর্শক অনায়াসে তার ভাবনার সাথে একাত্ম হন।
যখন আমরা টেরাকোটার কথা ভাবি, আমাদের চোখের সামনে, কিছু শক্ত টালি, ছাদ সুরক্ষার মজবুত কিছু ভাবি। যে কোন ভাবেই টেরাকোটা বস্তু বানিয়ে আমরা ব্যবহারিক জগতে কাজে লাগাতে পারি। কিন্তু সবকিছু ভাল হলেও হাত থেকে পড়লে, বা উপর থেকে টেরাকোটা পড়ে গেলে টুকরা টুকরা হয়েযায়। সে এতই ভঙ্গুর।
টেরাকোটার মত মানুষের জীবনও তুলনা করা যায়। মানুষ, এমনিতে শক্ত, কিন্তু তাকেও দেখা যায় সময় সময় সে ভেঙ্গে পড়ে। কখনো ধূলায় মিশে যায়।
বাবক গোলকারের Babak Golkar’s টেরাকোটার ইনস্টলেশান তেমনি এক ভাবনার। খোলা জমি, চারিদিকে উঁচু উঁচু বাড়ি, রাস্তা, সাধারণ নাগরিকদের খোলা প্রাঙ্গন। গোলকার সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, যে তারা এসে এই টেরাকোটার পাত্রগুলির ভেতর চিৎকার করে দেখুক কেমন লাগে।
ইনস্টলেশান এমনভাবে, পরিবেশের মাটিতে এক ইঞ্চি বা দুই ইঞ্চি জল রাখা আছে, তার উপর বালির বস্তা, তার উপর নানা ধরণের আকৃতির টেরাকোটার পাত্র। পাত্রগুলির একদিকে মুখ বড় অন্য দিকে মুখ খুবই ছোট।
একটা শান্ত পরিবেশ, যদিও রাস্তার পাশ দিয়ে গাড়ি, ট্রাফিক, ব্যস্ত জনতার শব্দ ভেসে আসে। দর্শককে বলা হল, আপনারা এই পাত্রগুলির মধ্যে আওয়াজ করুন, জোরে চিৎকার করুন। দর্শক সিংহের মত গর্জন করলেও আওয়াজটা কোথায় যেন ইঁদুরের চিঁহিতে পরিণত হয়ে যায়। আবার কোথাও আওয়াজটা অনেক গুন জোরে প্রকাশ পায়। নির্ভর করে পাত্রের আকৃতি ও বাতাস বেরোবার পথের উপর।কিন্তু এই পাত্রগুলির মধ্যে বিকৃত করার উপাদান বা জিনিস আছে যা আপনার চিৎকারকে অন্যরকম করে দেবে। বিভিন্ন জায়গার পাত্রগুলির অবস্থান ভিন্ন আওয়াজ তৈরি হয়।
পাগলপনামোর খোরাক হল, আমাদের আকড়ে ধরারচেয়ে ও বেশি কিছু উপলব্ধি করার ক্ষমতা আছে। আপনি একটা জায়গায় যাবেন, অনেক রাস্তা আছে সেখানে যাওয়ার, কিন্তু আপনি গাড়ি চালাচ্ছেননা, আপনি গাড়িতে পিছনে চুপচাপ বসে আছেন, আর ড্রাইভারকে নানা কথা বলছেন, ড্রাইভার কিন্তু যেখানে নিয়ে যাবার সেখানেই আপনাকে নিয়ে যাবে তার মতকরে।
আমেরিকায় জন্ম, বড় হয়েছেন তেহরাণে, ইরান- কানাডায় থাকা শিল্পী বাবাক গোলকার Babak Golkar এর এই ইনস্টলেশান প্রদর্শনীর নাম, ‘ছাড়ার সময় হয়েছে’ এবং ‘চিৎকা্র রাখার পাত্র’, ‘Time To Let Go’ এবং ‘Scream Pots’ এই ইনস্টলেশনে আপনি আপনার আবেগ ধরে রাখুন, যে আবগ আপনি সাধারণের মধ্যে রাখতে পারবেননা।আবেগকে ছেড়ে দিয়েই মুক্তি। যেমন আপনি বালিশে মুখ দিয়ে কান্না করেন আপনার হতাশায় ব্যর্থতায়, প্রতিবেশীকে জানাননা। মানে আপনি হতাশায় চিৎকার করলেও পাবলিককে জানাতে পারছেননা নিরাপত্তা দেখে চিৎকার করতে হচ্ছে। সবার সামনে করলে নিজের দুর্বলতা আরো প্রকাশ পাবে।
আমাদের সমাজের যে সিস্টেম- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নানা চাপ আমাদের প্রতিদিন আমাদের বোঝা বাড়িয়ে তুলছে। আমরা নিতে পারিনা। আমরা কাউকে বলতেও পারিনা। কাউকে বললেও আমাদের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে আমরা আরো বিপদ গ্রস্ত হই।
শিল্পী এই টেরাকোটার পাত্র দিয়ে এই বার্তাই আমাদেরকে পরিষ্কার করে বোধে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। এখানে, আপনি যখন এই টেরাকোটার পাত্রের কাছে গিয়ে টেরাকোটা পাত্রের মুখে বিশাল করে চিৎকার করবেন তখন শুনবেন আপনার চিৎকার কেমন লাগছে, কিভাবে উপলব্ধি হচ্ছে। এক অস্বস্তির মধ্যেও স্বস্তি খুঁজে আমরা বেঁচে আছি। এখানে ভাবনাকে শিল্পী মূর্ত করলেন আপনার সাথে অংশ গ্রহনের সুযোগ দিয়ে। ছবি এঁকে, বস্তু এঁকে এই অনুভূতি আপনি উপলব্ধি করতে পারতেননা। ইনস্টলেশান আপনাকে সুযোগ দিল, একটা ভাবনার ভেতর আপনাকে নিয়ে গে্‌ আপনি সক্রিয় থেকে একটা বিষয় বুঝলেন। পেইন্টিং র দ্বিমাত্রিক তলে আপনি এটা কিছুতেই বুঝতেননা।
Time to Let Go (Vancouver Art Gallery Offsite, 2014) and Scream Pots use vessels to contain emotions you can never let out in public.
প্রথম ইনস্টলেশান আর্ট ১৯৬৫তে লাতিন আমেরিকায়
(যদি সংজ্ঞায়িত করি) ইনস্টলেশান আর্ট কি?
ইনস্টলেশন আর্ট বা শিল্প হল ত্রি-মাত্রিক কাজের একটি শৈল্পিক ঘরানা। যা প্রায়শই একটা-নির্দিষ্ট স্থানে হয় এবং কোনও স্থান বা জায়গার উপলব্ধি রূপান্তর করার জন্য কিছু নকশা বা প্রদর্শনের বিষয় রাখা হয়। ফলে স্থানটি অন্য একটা মাত্রা বা উপলব্ধ দিতে সক্ষম হয়।
সাধারণত, শব্দটি অভ্যন্তরীণ স্পেসে মানে, কোন ঘর বা হলের ভেতর প্রয়োগ করা হয়,যদি সেটি ঘর বা হলের বাইরে খোলা স্থানে হয় তাকে পাবলিক আর্ট, ল্যান্ড আর্ট বলা হয়।

একটা গোলকধাঁধার মতো ইনস্টলেশন এর মধ্য দিয়ে ভ্রমণ – এবং আর্টের অংশ হওয়া।
মার্টা মিনুজান Marta Minujín (b. 1943), ১৯৬০ সালে লাতিন আমেরিকার শিল্পের অন্যতম শক্তিশালী কণ্ঠ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই পারফরম্যান্স, ভিডিও এবং ইনস্টলেশন তৈরি করতেন, অ্যান্ডি ওয়ারহল Andy Warhol সহ অন্যান্য শিল্পীদের সাথে সহযোগিতা করেও করেছেন।
শিল্পী রুবান সান্টাটনিন (Rubén Santantonín (1919-69)) এর সাথে, ১৯৬৫ সালে মিনুজিন লা মেনসুন্ডা La Menesunda তৈরি করেছিলেন, যা শিল্প ইতিহাসের অন্যতম প্রথম পরিবেশ বা স্থাপন । এর শিরোনাম স্থানীয় বুয়েনস আইরেস এর জন্য স্ল্যাং (অর্থ হল মারামারি, দাংগা,হট্টগোল ইত্যাদিতে হতবুদ্ধি হওয়া) এবং এই কাজটি শহরের একটি প্রাণবন্ত রাস্তার ক্যাওস বা হট্টগোল থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
লা মেনসুন্ডার ধাঁধার মতো কাঠামোটি দর্শকের পাঁচটি ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। দর্শনার্থীরা এগারোটি জায়গার মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করতে পারেন, নিয়ন লাইট এবং পারফর্মার ভর্তি কক্ষ রয়েছে এবং একটি টানেল সহ। আপনার ম্যানিকিউর প্রয়োজন? নখের যত্নবিদদের সাথে সম্পূর্ণ লা মেনসুন্ডার বিউটি সেলুনটি পরিদর্শন করতে ভুলবেন না।
মিনুজান এবং সান্টানটোনিন এই পরিকল্পনাটি দর্শককে প্ররোচিত করার জন্য কল্পনা করেছিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে তাদের আরাম হারাম করে দেওয়া, ভোগান্তি এনে দেওয়া। এবং তাদের রুটিন থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া। লা মেনসুন্ডাকে বিশেষ করে তোলে যখন সমস্ত কক্ষগুলি আমাদের পরিচিত উপাদান দিয়ে সাজানো, যা প্রতিদিনের পরিস্থিতিতে মানুষ মুখোমুখি হয়। যাইহোক, কক্ষগুলি একটি বিশ্রী উপায়ে সাজানো যেখানে দর্শকদের অবশ্যই হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হবে, ঘরের ভেতর নরম মেঝে এবং সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে। কক্ষগুলির অভ্যন্তরে কী ঘটে এই নিয়ে দ্বিধা তৈরি করে: বিছানায় কোন ঘরে দম্পতির শুয়ে আছে আপনি না তাকিয়ে না কথা বলে চলে যাবেন? আমাদের কি তাদের দিকে তাকাতে হবে যেন তারা কোনও ভাস্কর্য বা দ্রুত ঘর ছেড়ে চলে যাবেন? আমাদের কি ঘরের সুইচ টিপতে হবে? বেরোবার জন্য আমাদের কোন পথটি বেছে নেওয়া উচিত? প্রায় কোনও কিছুই সংজ্ঞায়িত করা হয় না এবং যখন আপনি গোলকধাঁধায় প্রবেশ করেন তখন আপনাকে কেবল সেই লক্ষণগুলি অনুসরণ করতে হবে কোথায় যেতে হবে কোন নির্দেশ পালন করবেন।বিভ্রান্তি বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পথ খোঁজার সময়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।