• Uncategorized
  • 0

গল্পেরা জোনাকি তে তনুশ্রী দেবনাথ

অসুখ

‘একাকিত্ব’… শব্দটার সঙ্গে প্রতিটা মানুষই বোধহয় কমবেশী পরিচিত।মধ্য চল্লিশে এসে তা যেন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে সুরমা।
লেখা পড়ার ইতি টানতে না টানতেই বাবা মা সুপাত্র দেখে পাত্রস্থ করেছিলেন তাকে।সে বিয়েতে অসুখের চেয়ে সুখ ই ছিল বেশি।বিতানকে স্বামী হিসেবে পেয়ে নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবতী মনে হতো। চাকরি সূত্রে বিতানকে বেশিরভাগ সময়ই থাকতে হতো সুরমার থেকে দূরে কর্মস্থলে।সে সময় গুলোতে সংসারের হাজারো কাজ সামলে অবসর কাটতো বই পড়ে, সেলাই ফোঁড়াই করে। কিন্তু নিঃঝুম নিঃস্তব্ধ রাত গুলোতে একাকিত্ব যেন গিলে খেতে আসতো সুরমাকে।একা ঘরে একা বিছানায় দম বন্ধ হয়ে আসতো। একাকিত্ব কাটাতে সন্তানের কথা ভাবলো ওরা, সুরমার মনে হলো মা হলে তার একাকিত্ব দূর হবে।
ঋদ্ধি এল সুরমার কোল আলো করে।আর আসতে না আসতেই সুরমার সমস্ত সময় চুরি করে নিল সে।সারা দিন রাত কিভাবে যে কেটে যায়! একটু একটু করে ওর বেড়ে ওঠা দেখতে থাকলো অবাক চোখে। বাবা কে যেহেতু খুব কম কাছে পায় তাই ছেলের সবটুকু জুড়ে শুধুই তার মা।বিতান যখন ছুটি ছাটায় বাড়ি থাকে সেও মেতে থাকে ছেলেকে নিয়ে। আনন্দের জোয়ারে ভাসতে থাকে ওরা, ছেলেকে ঘিরেই ওদের যা কিছু। কখনো কখনো প্রচুর খাবার দাবার সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে তিন জনে সারা দিনের নামে।
বড় হচ্ছে ঋদ্ধি, নিজের চারপাশে একটা জগৎ গড়ে উঠছে ওর। স্কুল, কোচিং, সাঁতার ক্লাস, সেখানকার বন্ধু বান্ধব সব নিয়ে অন্য একটা জগৎ খুঁজে পায় সে। ইদানিং একটু গিটার বাজানোর নেশাও হয়েছে। সুতোটা তবু মায়ের হাতেই আছে।সব জায়গাতেই মা তার সঙ্গী। হাজার ব্যস্ততার মাঝেও ছেলের সঙ্গে ছোটাছুটি করার মধ্যে অদ্ভুত এক তৃপ্তির স্বাদ পায় সুরমা।
স্কুলের গণ্ডি পার করে ঋদ্ধি। এবার উচ্চ শিক্ষার কথা ভাবতে হবে। শুরু হবে নতুন অধ্যায়, সাবলম্বী হতে হবে । নতুন জীবনে মায়ের অবাধ যাতায়াত আর থাকবে না। হাসিমুখে মেনে নেয় সুরমা।সে জানে এটাই নিয়ম,ঋদ্ধিকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।বন্ধন মুক্ত করতে হবে একটু একটু করে। ঋদ্ধি বেশ ভালো ছাত্র, বেঁধে রাখলে আখেরে তার ক্ষতির সম্ভাবনাই প্রবল।একের পর এক সিঁড়ি টপকাতে থাকে ঋদ্ধি। বাবা মায়ের বুক ভরে ওঠে গর্বে। স্বপ্ন দেখে তাদের ছেলে বাবা মায়ের সাথে সাথে দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে।
আজ ঋদ্ধির জন্মদিন, আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবে বাড়ি ভরে গেছে। ছেলের সাফল্যে বিতান বেশ কিছু কাছের মানুষ কে আমন্ত্রণ করেছে বাড়িতে।সবাই মিলে একটু আনন্দ হই চই করতে চায়। সেই আনন্দের দিনে আরো একটা আনন্দের সংবাদ এসে পৌঁছালো। ঋদ্ধির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার,এক সপ্তাহের মধ্যে জয়েন করতে হবে। তবে কলকাতা নয়, ওকে চলে যেতে হবে অন্য শহরে বেশ কয়েক বছরের জন্য, তারপর ইচ্ছা হলে কলকাতায় ফিরতে পারবে অথবা ওখানেও থেকে যেতে পারে। বাড়ি ভর্তি লোক জন আনন্দে আত্মহারা ঋদ্ধির সাফল্যে,বিতান ও ব্যতিক্রম নয়, ছেলের সাফল্যে সে গর্বিত। কিন্তু একজন বোধহয় খুশি হতে পারলো না, বন্ধ ঘরে কান্নায় ভেঙে পড়লো সুরমা।এত কষ্ট করে তিল তিল করে মানুষ করেছে ছেলেকে, ছেলের জয় তো তার ই জয়। তবু ও তাদের ছেড়ে অন্য শহরে চলে যেতে হবে এ যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারে না মায়ের অবুঝ মন।
ছেলে অন্য শহরে,বিতান ও তার কর্মস্থলে, সুরমা আবারো একা। আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরে নিষ্ঠুর এক অসুখ…..’একাকিত্ব’ । যার থেকে মুক্তির উপায় তার জানা নেই। তলিয়ে যেতে থাকে সুরমা এক গভীর খাদের মধ্যে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।