তখন সেই সন্ধে গড়িয়ে রাত হতে না হতেই আমাদের বাড়ির উত্তরের কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যেত আকাশ নিচু হয়ে মাটির কাছাকাছি এসেছে আর আকাশের গায়ে মিটিমিটি অসংখ্য তারা জ্বলছে। শিশুমনে সেই যে এ দেখা ছাপ ফেলে গেল, আজও ভুলিনি তা। মায়ের কাছ থেকে প্রথম জানি ঐ যে দূরের তারার দেশ ও হল কার্শিয়াং শহর। আর তার নিচে অনেকটা ব্যবধান রেখে আবার মিটিমিটি আলোর মালা সেটি হল তিনধারিয়া পাহাড়। আমি সেই আলোর দেশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ওটাই ছিল আমার রূপকথার প্রথম দেশ। তোমরা তো সবাই দার্জিলিং যাও, গ্যাংটক যাও, এখন আবার ডুয়ার্স বেড়ানোর হিড়িক পড়েছে যে শহরটিকে ছুঁয়ে তোমাদের ওখানে যেতেই হবে, তার নামটি বোধহয় সবাই জান– শিলিগুড়ি। দার্জিলিং যদি শৈলরাণী হয়, তাহলে শিলিগুড়ি তরাই সুন্দরী। এক- একটা ঋতুতে শিলিগুড়ি এক- এক রকম। অন্যকোন দিক সম্বন্ধে জ্ঞান হওয়ার আগে আমার জ্ঞান হয়েছিল উত্তরদিক নিয়ে। দূরের ঐ নীল পাহাড় ওটাই বলে উত্তরদিক। সারাশহরটা রেললাইনের জালে জড়িয়ে ছিল। বর্তমানে সেই রেল- লাইনের ওপর, সেইসব স্টেশনের জমিতে বড়-বড় বহুতল আর দোকান বাজার এইসব।
বাবা কখনও কখনও ডুয়ার্স মালবাজার ওদলাবাড়ি এইসব জায়গা থেকে ফিরে গল্প করত– জানিস তো আজ দশমাইলে, সেবক পাহাড় ছাড়িয়ে এসে একপাল হাতি দেখলাম। আমাদের গাড়ি আলো নিভিয়ে দূর থেকে দেখতে পেয়েই দাঁড়িয়ে গেল। মহানন্দা অভয়ারণ্যে তখন হরহামেশাই চিতল হরিণ বা সন্ধের মুখে শহর লাগোয়া দু- মাইল পেরোলেই চিতার দেখা পাওয়া যেত। দেশবন্ধুপাড়া থেকে সেনকাকু বলে বাবার এক বন্ধু আসতেন। চা- বাগানে কয়লা সাপ্লাই করতেন, তারমুখে ঐ বন্য জন্তু- জানোয়ারের গল্প শুনতে খুব ভালো লাগত। আর ভালো লাগবেই না কেন! সবগুলি নাকি একদম জলজ্যান্ত সত্যি ঘটনা। তবে সত্যি ঘটনা হলেও, গল্প বলার কায়দায় এক-একজনের মুখে গল্প শুনতে খুব বেশি ভাল লাগে তাই না? মনে হয় সব যেন চোখের সামনে ঘটছে। সেনকাকু ও তাই ছিলেন।
শহর ছাড়ালেই আমাদের দীর্ঘ শাল- সেগুনের জঙ্গল। পাহাড় কোনদিন সকালে এতই স্পষ্ট যে তার গায়ে ঝড়ে পড়া সাদাঝোড়ার রেখা বাড়ির জানালা দিয়ে দেখি দিনের বেলায়। আমাদের সীমানাহীন সবুজ মাঠ তখন। রাতে চাঁদমণি চা- বাগানের কচি পাতার গন্ধ যেন নাকে এসে লাগে।
একদিন হা করে তাকিয়ে রয়েছি জানালা দিয়ে পাহাড়ের দিকে। হঠাৎ দেখি বাবা পেছন থেকে পিঠে হাত রেখেছে— যাবি কালকে ঐ তোর ঐ দূরের নীল- পাহাড়ে বেড়াতে? আমার অফিস কাল রোববার ছুটি।