অনার্স ফাইনাল ইয়ারে এসেই দার্শনিক হয়ে গেছে! মাস্টার্স শেষ করলে, কিংবা তারপর ডক্টরেট করলে কী হবে আল্লা মালুম।
বিষয়টা নিশ্চয় অন্যরকম। অন্য কোনো বিষয়ে পাস করার আগে কেউ কিছু হয় না। স্টুডেন্টই থাকে। এমবিবিএস পাস করার আগে কেউ ডাক্তার হয় না। গণিতে মাস্টার্স কমপ্লিট করে বিশেষ পারদর্শিতা না দেখাতে পারলে গণিতবিদ হয় না। অথচ সে……!
‘কিন্তু অনার্স ফাইনাল ইয়ার চার বছর’-ব্যাপারটা বুঝলাম না। টোটাল অনার্স কোর্স চার বছরের সেটাই জানতাম। ফিলোসফি অনার্স-এর ফাইনাল ইয়ার কি চার বছরের?
রান্টু বলল: ফাইনাল ইয়ার চার বছর-বিষয়টা বুঝলাম না।
: মানে চার বছর ধরে আমি ফাইনাল ইয়ারে আটকে আছি। পাস করতে পারছি না। আমার ব্যাচমেটরা মাস্টার্স কমপ্লিট করে চাকরি-বাকরি করছে। কেউ কেউ ডক্টরেট করে ফেলেছে। কেউ কেউ বিসিএস ক্যাডার হয়ে ব্যাপক দাপট দেখাচ্ছে। ঘুষ-দুর্নীতি করে আঙ্গুল ফুলে বটগাছ হয়ে গেছে। আর বিয়ে-টিয়ে করে ঘর-সংসারও করছে বেশির ভাগে।
মাই গড! এরও তো দেখছি গাব্বুর মতো অবস্থা। সে আবার গাব্বুর প্রবলেম সলভ করবে কীভাবে?
সে বলল: যাকগে, এ নিয়ে আমি বিশেষ টেনশন করি না। ও, আমার নামটাই তো তোমাদেরকে এখনো বলা হয়নি। আমার নাম হেলাল উদ্দিন। দার্শনিক হেলাল উদ্দিন। তোমরা আমাকে দার্শনিক হেলাল ভাই বলে ডাকবে।
আমি বললাম: সব সময় দার্শনিক হেলাল ভাই বললে কেমন শোনা যাবে?
: সব সময় না। বিশেষ বিশেষ সময় বলবে।
: জি আচ্ছা।
রান্টুটা আবার তুলনামূলক ত্যাঁদর। ও বলল: দার্শনিক হেলাল ভাই, এই যে এতক্ষণ এত কথা বলা হল, আমরা কিন্তু আপনার মুখ থেকে দার্শনিক কোনো বক্তব্য শুনতে পেলাম না।
: ও তাই? শুনবে, শুনবে। আমার সাথে থাকলে পদে পদে দার্শনিক মন্তব্য শুনতে পাবে, দার্শনিক সত্যের মুখোমুখি হবে।
: আপাতত এখন একটা দার্শনিক মন্তব্য করেন শুনি।
: ‘অনেক ক্ষেত্রেই গভীর প্রেম-ভালোবাসার ইতি টানা হয় গভীর দুঃখের ভেতর দিয়ে।’
সরাসরি ‘প্রেম-ভালোবাসা’ সম্পর্কিত দার্শনিক মন্তব্য দিল। আমরা আর কিছু বললাম না। মনে হল, কথাটা সত্য। তবে এরকম কথা এর আগে অনেকেই বলেছে।
২
তারপর থেকেই আমরা দার্শনিক হেলাল ভাইয়ের সাগরেদ, শিষ্য, মুরিদ যাই বলা হোক না কেন তা হয়ে গেলাম। কেউ দেখলে মনে করবে, কত কালের পরিচয় আমাদের। হেলাল ভাই ‘তুমি’ থেকে অনায়াসে ‘তুই’ তে নেমে গেল। তার মুখে ‘তুই’ আমাদের কাছে জীবনানন্দের কবিতার মতই মুগ্ধকর।
মোজাফ্ফরের চায়ের দোকানই হয়ে গেল হেলাল ভাইয়ের স্থায়ী ঠিকানা। সেখানে গেলেই তাকে পাই। আমরাও সময়-অসময় তার কাছে ছুটে যাই। গল্প করি। আবৃত্তি করি। গান করি। এটা-ওটা নিয়ে তর্ক করি। ঝগড়াও করি। আর চা, সিঙ্গারা, আলুচপ, পিঁয়াজু, বেগুনী, জিলাপী, ডালপুরি এসব খাই। বিল যা আসে তা হেলাল ভাই-ই দেয়।
একদিন হেলাল ভাই বলল: আমার জন্য তোদের একটা কাজ করতে হবে।
হেলাল ভাইয়ের জন্য কাজ! আমরা তো এক পায়ে খাড়া।
আমি বললাম: কী কাজ বলেন?
এই পাড়ায় যতগুলো মেয়ে আছে তাদের নাম জোগাড় করে দিবি। ক্লাশ টেন থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত মেয়েদের নাম, অবশ্যই অবিবাহিত মেয়ে।
আমরা একেবারে খাবি খেয়ে গেলাম। আমাদের প্রিয় হেলাল ভাই এ কেমন কাজ করতে বলল? এ যে আমাদের কল্পনারও অতীত ছিল। আমরা কেউ কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। হেলাল ভাই ধমক দিয়ে বলল: কিরে, পারবি না? খুব কঠিন কাজ বলেছি?
কজটা কঠিন না। পাড়ার প্রায় সব মেয়েই আমাদের পরিচিত। কার নাম কী, কোন স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, কে ভাল স্টুডেন্ট, কে মাঝারি গোছের, কে ফেলটুস তাও জানি।
কে ফর্সা, কে শ্যামলা, কে কালো, কে মোটা, কে চিকন, কে লম্বা, কে খাটো, কে হাসলে গালে টোল পড়ে তাও জানি।
আরও জানি কে গান করে, কে আবৃত্তি করে, কে নাচ করে, কে ছবি আঁকে ইত্যাদি।
কে কিছুই করে না তাও জানি। জানি কার বাবার নাম কী, কার বাবা কী করেন এবং বাসার নম্বর কত। কিন্তু হেলাল ভাই তাদের নাম দিয়ে কী করবে?
ফেকু বলল: মেয়েদের নাম দিয়ে কী হবে হেলাল ভাই?
: পত্র লিখব।
: পত্র……! কিসের পত্র?
: প্রেমপত্র।
: সবগুলো মেয়েকে?
: হু…..।
এ পাড়ায় প্রায় শ’খানেকের মতো মেয়ে আছে। সবাইকে আপনি প্রেমপত্র লিখবেন?
: প্রেমপত্র ঠিক নয়। প্রেম হওয়ার আগে প্রেমপত্র হয় না। বলতে পারিস প্রেম প্রস্তাবপত্র।
: প্রেম প্রস্তাব যদি দিতে চান তো ফোন নাম্বার যোগার করে দেই। এ যুগে কেউ পত্র লেখে?
: যুগের সাথে অনেক কিছুই বদলায়। তবে কিছু কিছু জিনিস রোমান্টিকতায় অপরিবর্তনীয় থেকে যায়। প্রেমের ক্ষেত্রে চিঠির তুলনা হয় না।
প্রেমিকের কাছ থেকে একটা চিঠি আসা মানে, সাথে প্রেমিকের আলিঙ্গন আসা। প্রেমিকার কাছ থেকে একটা চিঠি আসা মানে, সাথে প্রেমিকার মাদকতাময় ঠোঁটের চুমু আসা।
‘চুমু’ কথাটা শুনে ফেকু লজ্জায় হলুদ হয়ে গেল। মুখটা অন্যদিকে ফেরাল। আমরা মাথা নিচু করলাম।
হেলাল ভাই বলল: তোরা তো আবার চুমু বলিস না, বলিস কিস। ফ্লাইং কিস….আহ! চুমু শব্দের কাছে কিস-এর কোনো মূল্য নেই।
আমরা কেউ কিছু ভাবতে পারছিলাম না। একযোগে সব মেয়েকে প্রেমপ্রস্তাব দিয়ে শেষে কোনো ঝামেলায় পড়ে না যাই। তা ছাড়া, আমরা বন্ধুরা আড্ডাবাজি করি, কেউ ভালো ছাত্র কেউ ছাত্র হিসেবে একটু খারাপ। কিন্তু মেয়েদের ব্যাপারে আমাদের কারোরই বিশেষ আগ্রহ নেই। খুব একটা সমস্যায় পড়ে গেলাম যেন।
মন্টু বলল: হেলাল ভাই, একজনকে পত্র দেবার পর কিছুদিন অপেক্ষা। তার কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেলে তারপর……..।
: আরে না, একযোগে সবার কাছে পত্র পৌছে দিবি।
: শেষে যদি এক যোগে কয়েকজন আপনার প্রেম প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়, তাহলে তো বিপদে পড়ে যাবেন।
হেলাল ভাইয়ের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে গেল। আফসোসের সুরে বলল: না রে, সেরকম কিছু হবার সম্ভাবনা নাই।
: বলা যায় না। কোনো কিছুরই সম্ভাবনা নাই, আবার অনেক কিছুরই সম্ভাবনা আছে।
: শোন, আগে যে পাড়ায় ছিলাম, সে পাড়ায় একযোগে চল্লিশজন মেয়েকে প্রেমপ্রস্তাবপত্র পাঠিয়েছিলাম। একজনও সাড়া দেয়নি। তার আগের পাড়ায় একযোগে একশ’ চল্লিশ জনকে প্রেম প্রস্তাবপত্র পাঠিয়েছিলাম। একজনও সাড়া দেয়নি।