শাকপাতা কুড়িয়ে এনেছিল সেই সকালে। কিন্তু রান্নাটা হয়ে ওঠেনি আর। দুপুরের দিকে কারা যেন বিরিয়ানির প্যাকেট বিলি করছিল স্টেশনের প্লাটফর্মে এসে। দেখে লোভ যে খানিকটা লাগেনি, তেমন নয়। গ্যাঁট হয়ে তবু নিজের জায়গাতেই বসেছিল মেহেরবানু। ছেলে হাজী বক্কর আলীর বাড়ি থেকে এবার সহজে পালানোর মওকা মিলছিল না একদম। বিউটিটা পাক্কা হারামজাদি। কণার কথামতো মেহেরবানুকে নজরবন্দী করেই রেখেছিল বলা যায়। কিন্তু মেহেরবানুও তক্কে তক্কে ছিল সেই থেকে। তবু সুযোগ মিলছিল না মোটেই। হাঁসফাঁস অবস্থা ছিল মেহেরবানুর। বেনু তার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথাবার্তা বলতই না প্রায়। হাজী বক্কর আলী পারতপক্ষে ছায়াও মাড়াত না মায়ের। বিউটিকে বলা ছিল মেহেরবানুর যেন কোনো অসুবিধা না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখতে। সেই সাথে মেহেরবানু যেন বাড়ি থেকে এক পা-ও বের হতে না পারে সেটাও দেখতে বলা ছিল তাকে। হারামজাদি ছেড়িটা কথা মতো মেহেরবানুর পেছনে লেগে ছিল আঠার মতো। একবেলা খাওয়া বাদ দেয়ার উপায় ছিল না মেহেরবানুর। সামান্য অনিয়ম করলেই টিকটিক শুরু করত ছেড়ি। খবর চলে যেত কণার কাছে। কণা ফোনে বকে, ধমকে হাঁফ ধরিয়ে দিত একদম। কণাকে কিছু বলতে না পারায় মেহারবানুর সব রাগ আর ক্ষোভ গিয়ে জমা হতো বিউটির ওপর। মুখে যা আসত বলত তাকে। তবু সেদিন শেষতক মওকা পেয়ে পালিয়ে আসার পর থেকে মনটা ভারি খারাপ মেহেরবানুর। না পালিয়ে উপায়ই বা কী তার! তার হল চরে খাওয়া শরীর। হাজী বক্কর আলীর বাসায় শুয়ে-বসে থেকে শরীরে মেদ জমে যাচ্ছিল তার। ভারী হয়ে উঠছিল শরীর। কাঁহাতক আর সহ্য হয় ওসব! এই বয়সে শরীর ভারী হওয়া কোনো কাজের কথা নয়। অসুস্থ হলে, বিছানায় পড়ে থাকলে কেউ মুখ ভরে মুতবে না তার, জানে মেহেরবানু। এখন স্রেফ কণার চাপে পড়ে তাকে ঘরে জায়গা দেয় বক্কর আলী আর তার বউ বেনু। অসুস্থ হলে, বিছানায় পড়লে তাকে লাত্থি দিয়ে বের করে দেবে রাস্তায়, কোনো চাপেই আর চিড়ে ভিজবে না সেদিন, সেটুকু পরিষ্কার বোঝে সে। সে কারণেই বিউটির ওপর ক্ষেপে যেত মেহেরবানু। কথায় কথায় বকে ভুতছাড়া করত তাকে। বলত, আমি না খালি তোর কী লো লটিমাগি! আমি চইলে গেলিই বে তোর কী? বোতেল ছেড়ি কোনেকার! সারাদিন আমার পাচে অবা টিকটিক হরে বেড়াস হ্যা? আর কামকাইজ নাই লো তোর?
বিউটি কিছুই বলত না উত্তরে। উল্টে হাসত বেহায়ার মতো। দেখে রাগ আরও বাড়ত মেহেরবানুর। সেদিনও এমনই রাজ্যের সব বকাঝকা বিউটির ওপর উগড়ে দিয়ে মাত্রই শান্তিতে কণার নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল মেহেরবানু। হঠাৎ কাটা কলাগাছের মতো তার কাছে এসে আছড়ে পড়ল বিউটি। কাঁদতে থাকল ডুকরে। প্রথমটায় বুঝতে পারেনি মেহেরবানু। বিউটির মতো অমন হাসি-খুশি, সাত চড়ে রা না করা মেয়েও যে কোনো কারণে এত আকুল হয়ে কাঁদতে পারে সেটা ভেবে বরং রীতিমতো বিস্মিত হল মেহেরবানু। কাছে গিয়ে তার পিঠে সান্ত্বনার হাত রেখে, কণ্ঠে সত্যিকারের দরদ ঢেলে বলল, কী অয়চে তোর, ও বু? অবা কাঁদিস হ্যা?
সান্ত্বনায় বিউটির কান্নার বেগ বাড়ল আরো। ফুলে ফুলে কাঁদতে কাঁদতে জানাল, তার মা আর ধরাধামে নাই। শুনে স্তব্ধ হয়ে খানিকক্ষণ বসে থাকল মেহেরবানু। কী বলবে ভেবে পেল না। সাতকূলে কেউ না থাকা বিউটির মা-ই ছিল একমাত্র আপনার জন। পঙ্গু হয়ে পড়ে ছিল বিছানায়। এখানে কাজ করে যে টাকাটা পেত বিউটি, সেটুকুই ছিল তার মায়ের অবলম্বন। সেই মাকে হারিয়ে বিউটির আহাজারি তাই জল এনে দিয়েছিল মেহেরবানুর চোখেও। কাঁদতে কাঁদতে বিউটি চলে গেছিল তার মরা মায়ের মুখটা শেষবারের মতো দেখতে। বিউটি চলে যেতেই রাজ্যের ভাবনা এসে ছেঁকে ধরেছিল মেহেরবানুকে। দিনটা কেমন অর্থহীন আর ফাঁকা হয়ে উঠেছিল সেদিন। ওবাড়িতে আর মন বসছিল না কিছুতেই। বিউটি চলে গেছিল, বক্কর আলী আর বেনু মশলাঘরে আর কণা তো সেই কবেই চলে গেছিল হোস্টেলে। একা অতবড় বাড়িটায় তখন কী করে মেহেরবানু! কেমন গা ছমছম করতে লাগল তার। পা কুটকুট। স্টেশনের কোণার দিকে তার সেই বিছানাটার কথা মনে পড়ল ভীষণ। মনটা কেমন খা-খা করে উঠল। ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, এই-ই মওকা রে মেহেরবানু! পালা! শিগগির পালা!
কাল-বিলম্ব না করে অতঃপর তল্পিতল্পা নিয়ে হাপিস হয়েছিল মেহেরবানু। কিন্তু তারপর থেকেই কেমন একটা অপরাধবোধ, খারাপ লাগা, ছেয়ে আছে মনে। বিউটি ফিরে এসে যখন দেখবে তার অমন বিপদের সুযোগ নিয়ে পালিয়ে গেছে মেহেরবানু, না জানি কতটা কষ্ট পাবে মেয়েটা! বিউটি মেহেরবানুকে ভালোবাসে খুব। যত্ন করে ভালোবেসেই, স্রেফ দায়িত্ব থেকে নয়। সেটা টের পায় মেহেরবানু। সে নিজেও মুখে বিউটিকে যতই বকাঝকা, শাপশাপান্ত করুক, মনে মনে মেয়েটাকে ভীষণই ভালোবাসে আদতে। সে কারণেই তার অমন দুঃসময়ের সুযোগ নিয়ে পালিয়ে আসাটা কেমন এক কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে মেহেরবানুর গলার কাছে। মনটা খারাপ হয়ে আছে ভীষণ। বিরিয়ানির অমন মনোলোভা গন্ধও তাই টানেনি তাকে সকালে। গ্যাঁট হয়ে বসেছিল নিজের জায়গাতেই। একটা ছেলে খেয়াল করল তাকে। ডাকল হাত ইশারায়। মুখ ফিরিয়ে নিল মেহেরবানু। উদাস তাকিয়ে থাকল আরেকদিকে। আজকাল আর ছুটতে পারে না মেহেরবানু। বাতের ব্যথা শরীরে। গিঁটে গিঁটে যন্ত্রণা। তাছাড়া বক্কর আলীর ওখানে শুয়ে-বসে থাকতে থাকতে শরীর ভারী। ইচ্ছে হলেই ছুট লাগাতে পারে না এখন। বিরিয়ানির প্যাকেট পাওয়ার দৌড়ে তাই শামিল হওয়ার ইচ্ছেটা দমন করল সে। ছেলেটা নাছোড়। দৌড়ে এসে মেহেরবানুর পায়ের কাছে বিরিয়ানির দুটো প্যাকেট নামিয়ে রেখেই ছুট লাগাল আবার।
দুপুরে তারই এক প্যাকেট খেয়েছে মেহেরবানু। অহেতুক রান্নার ঝামেলায় না গিয়ে সোনামুখ করে খেয়ে নিয়েছে তখনই। কিন্তু বেলা যত গড়াচ্ছে ততই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তার মনখারাপের বাও। বিউটির জন্য মনটা তার কাঁদছে ভীষণ। কী করবে, প্রথমটায় ভেবে পেল না মেহেরবানু। আহা রে! মাও মরা এতিম ছেড়িডা! ইটু দেহে আসার দরকার।
-মনে মনেই বলল মেহেরবানু। মাথা নাড়ল বারকতক। তারপর সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূরে সরিয়ে উঠে পড়ল এক সময়। আঁচলের আড়ালে না খাওয়া বিরিয়ানির প্যাকেটটা নিয়ে নিল চুপিসারে। যা হয় হবে। সাপ নয় ও বাড়ির মানুষ। বাঘও নয়। না হয় বকা-ঝকা করবে খানিকটা। ধমক-ধামক দেবে। দিক। তার জীবন গেল মানুষের বকা-ঝকা খেয়ে, ধমক-ধামক শুনে। সেখানে ও বাড়ির সামান্য একটু বকা-ঝকা আর বেশি কী এমন! ভাবতেই স্বস্তি ছড়াল মনে। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে হাঁটা ধরল ও বাড়ি লক্ষ্য করে। বিউটির জন্য মনটা ভারি উতলা হয়েছে মেহেরবানুর। পুড়ছে ভীষণ।