Bengali Story By সানি সরকার

নিঃশ্বাসের শব্দ
‘প্রতিটি গল্পের মধ্যে একটি গল্প থাকে। গল্পটির ভেতর আরও কিছু গল্প থাকে।’
‘হ্যাঁ কিন্তু আমার কোনও গল্প নেই।’
‘সুইসাইড করতে চেষ্টা করাও তো একটি গল্প, তাই না? তবে আমি সেই জায়গাটিতে যেতে চাইছি না এক্ষুনি।’ ডাঃ চট্টোপাধ্যায় তিতাসকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই বললেন, ‘আচ্ছা তিতাস, তোমার কোন সময় বেশি ভালোলাগে?’
‘সকালবেলা। অদ্ভুত রকম ভালো লাগে। আমি তো উড়ে যেতে চাই খোলা মাঠের দিকে। দুই হাত প্রসারিত করে দৌড়তে ইচ্ছে করে। কিন্তু কি অদ্ভুত, জানেন,আমি কোনওদিন সকালবেলা উঠতেই পারি না। কি যে অভিমান হয় নিজের-ই ওপর!’
‘কেন ভালো লাগে সকালবেলা? রাত্রির ভেতরেও তো কত সৌন্দর্য আছে?’
‘জানেন, আমি দীর্ঘদিন সকাল দেখিনি। অথচ একটি সময় ছিল, প্রতিটি সকালের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেতাম। প্রতিটি সকাল ধারণ করতাম নিজের ভেতর। প্রতিটি সকাল যেন আমাকে নতুন করে বাঁচতে শেখাতো।’
‘দীর্ঘদিন সকাল দেখনি, কেন?’
‘আমি রোজ ভাবি আজ ঘুমাবো না। রাত কি যে দ্রুত ফুরিয়ে আসে। আর একটু পরেই সকাল হয়ে যাবে। দু’একটি পাখি কিচিরমিচির করে। আমি আয়নার সামনে দাঁড়াই। খুব ভয় করে। তখন-ই গুটিসুটি মেরে প্রবেশ করি বিছানায়। তক্ষুনি গুটিয়ে যাই। আস্তে-আস্তে প্রবেশ করি নিজের মধ্যেই আবারও। আর কখন ঘুমিয়ে পড়ি। আমার আর স্বপ্ন দেখা হয় না। ঘুমের মধ্যে ঘামতে থাকি অবিরত…’।
‘ইসসসসসস! তিতাস, তুমি স্বপ্ন দেখ না?’
দেখি তো। তবে সুন্দর নয়। খুব ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। জানেন, আমার খুব সুন্দর স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে, জীবনকে ভেঙে ভেঙে দেখতে…’
‘তাহলে দেখ না কেন?’
‘দেখি তো। নিয়মিত দেখি। সবুজ চা বাগানের মাঝ-বরাবর দৌড়ে যাই। হলুদ ওড়না উড়িয়ে খলবল করে একটি পাখি। আমি ঠিক থাকতে পারি না তখন। সমগ্র শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। আমার ভেতর সেই পাখিটিও নড়ে-নড়ে ওঠে। আমায় মাথায় ঠোক্কর দেয় ক্রমাগত। আমি তখনই দুমড়ে-মুচড়ে যাই।’
‘হলুদ ওড়না পাখি…’
‘হ্যাঁ পাখিটি। আমি তো ওকে পাখি নামে-ই ডাকতাম। এত সুন্দর! ওর সমস্ত শরীর বেয়ে লাবণ্য ঠিকরে বেরিয়ে আসতো। ওকে খুব শক্ত করে দু’বাহুতে আগলে রাখতে চেষ্টা করলাম, স্যার। পারলাম না। ডুয়ার্সের ঢালু চা বাগানগুলির মাঝে হেমন্তের দুপুরে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়তো সবুজ চা পাতার ওপর। ও-আমাকে বলতো, হেমন্তের দূত। কেন বলতো, জানি না। এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষ লগ্নে দাঁড়িয়েও, আমরা প্রতি সপ্তাহে একটি করে চিঠি লিখতাম, পরস্পর পরস্পরকে। ওঁর চিঠির কি সুন্দর ভাষা-বাঁধুনি। শুধু অবাক হয়ে দেখলাম, ওর মুক্তোর মতো হাতের লেখা। বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতাম। পড়তাম। প্রতিটি শব্দ প্রতিটি বাক্য ঢেউ তুলতো আমার ভেতর।’
‘তারপর?’
‘সবই ঠিকঠাক চলছিল। নিয়মিত দেখা হচ্ছিল। কথা হচ্ছিল। ওটা আমার জীবনের সেরা সময়। অথচ এখন যখন মেঘ করে আকাশে, আমি গুটিয়ে যাই। মনে পড়ে সেই দিন: ওই তো রোদ ঝলমল করল একটু আগে…। সেই সময় কলেজ শেষ করেছি মাত্র। চাকরি-বাকরির চেষ্টায় মগ্ন হয়ে আছি। বেকারত্ব খামচে ধরেছে দুটো বুক। এমনই একদিন ও-হঠাৎ জানালো, ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। জানেন, আমি পাগলের মত দুষ্টুমি করে খিলখিল করে হেসে বললাম, ‘বিয়ে? তোমার? কে বিয়ে করবে তোমাকে?’ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল ও। বুঝতে পারলাম, আমি ভুল করে ফেলেছি। ও-সিরিয়াস। ওঁর চিবুকে হাত রাখলাম। বললাম, আর কিছুদিন প্লিজ… একটু অপেক্ষা করো! ও-বলল, আমি আর পারছি না, তিতাস। বাবা বলেছেন, আমি যদি এই বিয়েতে মত না দিই তবে আত্মহত্যা করবেন। বাবা মা আমাকে ব্ল্যাকমেল করে চলেছেন অনবরত। স্যরি, তিতাস… ‘
ও-চলে গেল। আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে হল তারপর। পারলাম না। আমি দেখছি, ও-চলে যাচ্ছে। ওঁর ছায়াটিও চলে যাচ্ছে ক্রমশ। আমি চুপচাপ বসে থাকলাম। কতক্ষণ? জানি না। আকাশে মেঘ করল। বিকট শব্দ। সমস্ত আকাশ তখন তোলপাড়। অথচ বৃষ্টি নেই। জানি না, আমি কি খুব করে চাইছিলাম বৃষ্টি হোক? অন্তত একটিবারের জন্যে বৃষ্টি হোক? ‘
‘বৃষ্টি হল না, না?
‘না। হল না। কেবল মেঘের দাপাদাপি। আমার কাছে পৃথিবী তখন একটি বৃত্ত। বৃত্তটির মাঝ দিয়ে চলে যাচ্ছে অসংখ্য জ্যামিতিক রেখা। এইসব রেখার মধ্যিখানে একটিমাত্র মানুষ, আমি, আধখানা হয়ে পড়ে রয়েছি।’
‘আর তখনই ভাবলে, এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা অর্থহীন? ভাবলে, মৃত্যুই শেষ আশ্রয়?’
‘আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না।’
‘তুমি জানো, মানুষ একটিবারই জন্মায়? পৌরাণিক মতে অনেক অনেক পুণ্যের ফলে মানব জন্ম পাওয়া যায়। অথচ তুমি এই জীবন থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলে! অন্যায় করেছিলে। এটি ঠিক করনি, তিতাস।
‘আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে না সত্যিই।’
‘কেন? জানো ফুল একবারই ফোটে, একবার-ই ঝরে যায়। আবার নতুন কলি আসে। আবার ফোটে। আবার ঝরে যায়…। তবে ঝরে যাওয়া ফুল কখনও নতুন করে ফোটে না। ফুটবার জন্যে নতুন কলি চাই। সেই কলি থেকে প্রস্ফুটিত হয়ে বেরিয়ে আসে ফুল। আবার দেখ, এই যে, তোমার সামনে আলোটি জ্বলছে। ধীর। তুমি মগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছ ওই দিকে। ঠিক টেবিলটির উপরেই আলোর গতিপথ নির্ধারিত। চারদিকে অন্ধকার। এই আলোটি জ্বলছে বলেই তো এখানে অন্ধকার নেই। আবার অন্যদিকে আলো নেই বলে অন্ধকার। আলোর এক দিকে অন্ধকার থাকবে, এটিই নিয়ম। তিতাস দেখ, যে সুন্দর চলে যায়, সে কিন্তু সৌন্দর্য নিয়ে যায় না। আমি জানি, ও-খুব সুন্দর, মন ও মননে। সেই সুন্দর যে ও-তোমাকে ভিজিয়ে রাখতে পেরেছে। ও-আজ তোমার জীবনে নেই। অথচ আছে। না থেকেও আছে। মনে। ওর শরীরের খোলসটি ঘর করছে অন্যের সঙ্গে। তো? বেঁচে তো আছে। আর ও-তো বাধ্য হয়েছে বিয়েটা করতে, তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে? জীবন তো একটা ফুটবল আর বেঁচে থাকাটা একটি আদিগন্ত মাঠ, তিতাস। তুমি ওই বলটিকে যতটা মাঠের মধ্যে টেকনিক্যালি নিয়ে দৌড়োবে, তোমার জীবনও ততধিক সুন্দর হবে। আর ভুলে যেও না, ও-একটি বিয়ে করেছে, মানে তোমাকে ভুলে গেছে। হয়তো ও-ও তোমাকেও ততটা-ই ভালবাসে। তুমি কি জানো, প্রেম কখনও-ই মারা যায় না। সত্যিকারের প্রেমিক প্রেমিকারা কখনও মারা যান না। মৃত্যু মানে তো শেষ হয়ে যাওয়া। কিন্তু দুটি মনের প্রকৃত সংযোগ যুগ-যুগান্তরের।… ‘
‘তাহলে আমার কি করার ছিল?’
‘কিছু না? অনেক কিছু। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা। যথার্থ প্রেম সবসময় পূর্ণতা পাবে এটি ভেবে নেওয়া ঠিক নয়। পূর্ণতা পেলে ভালো। নইলেও খারাপ কিছু নয়। দেখ, আজ তুমি যেভাবে ওঁকে মনের মধ্যে ধারণ করেছ, এটিই কিন্তু প্রেমের পরিণতি ও পূর্ণতা। এটিই যথার্থ প্রেম। তোমার যদি বাইচান্স কিছু হয়ে যেত, তবে তোমার প্রেমেরও মৃত্যু হত।’
ডাঃ চট্টোপাধ্যায় দেখলেন, হঠাৎ তিতাসের চোখ গড়িয়ে নেমে এল অশ্রু। নিজের চেয়ারে বসে ডাঃ চট্টোপাধ্যায় হাসলেন মনে মনে। প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ তিতাসকে কাঁদতে দিলেন। তিতাস ভেতরে জমে থাকা সমস্ত পাথর গলিয়ে বের করে দিচ্ছে চোখ দিয়ে। ডক্টর টেবিলের ওপর জ্বলতে থাকা হালকা আলোটি নিভিয়ে দিলেন। জ্বেলে দিলেন ঘরের সব টিউবলাইটগুলি। আলোয়-আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ঘরটি। তারপর তিতাসের কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন, এই নাও তিতাস, তোমার একটি চিঠি আছে। তিতাস খামটি দেখে চমকে উঠল, চিঠি? মুহূর্ত অপেক্ষা না করে ও-ছিঁড়ে ফেলল, বাদামী রঙের খামটি। সাদা কাগজের ওপর নীল ডট পেনের লেখা অক্ষরগুচ্ছ প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল ওর সামনে :
হেমন্তের দূত,
একজন স্বার্থপর নারীর জন্যে জীবন শেষ করে দেবে? আমি এমন দুর্বল মানুষটিকে ভালবাসিনি গো। আমি জানতাম, আমার প্রিয় মানুষটি গ্রীক যোদ্ধার মতো। যে যে-কোনও পরিস্থিতিতে নিজেকে শক্ত করে ধরে রাখতে পারেন।
বৈবাহিক সম্পর্ক-ই প্রেমের শেষ পরিণতি নয়। বৈবাহিক সম্পর্ক ও প্রেম সম্পূর্ণ আলাদা দু’টি অধ্যায়। দু’টি বিন্দু। আমি জানতাম না, তুমি তা জানতে না। হয়তো সেটি আমার-ই অক্ষমতা! তোমাকে বোঝাতে পারিনি। প্রেম ঐশ্বরিক। আগলে রাখতে হয়। বিয়ে তো দু’টি মানুষের মধ্যে হয়। তাঁদের ভেতরে কি সবসময় প্রেম থাকে? আমাকে বলো।
বাঁচো। নিজের জন্যে বাঁচো। বাঁচতে হবে তোমাকে। আমাদের অপূর্ণ স্বপ্নগুলিকে পূরণ করতে হবে তো। আমি দূর থেকে দেখব সেইসব কিছু। তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাসের শব্দ অনুভব করব। আর তোমার নিঃশ্বাস ওঠাপড়ায় আমি প্রাণবন্ত হয়ে থাকব প্রতি মুহূর্তে। হয়ত দূর থেকে। হ্যাঁ, দূর থে-কে-ই। তাতে কী? ভালবাসার তো মৃত্যু নেই। দূরত্ব নেই। মনে আছে, সে-ই কবির কবিতার লাইনগুলি? ‘দু’টি গাছ দু’দিকে নিঃশ্বাস ফেলছে/ আর ক্রমশ নদীর ঢেউগুলি/হাসছে খিল খিল করে…/গাছের যেহেতু প্রাণ আছে/তাহলে অনুমান করতে-ই পারি, মনও আছে/ এখন দু’টি গাছ একে অপরকে ছুঁতে পারছে না/তার জন্যে প্রেম শুকিয়ে যাবে না/ওদের নদীটিও শুকিয়ে যাবে না/তাঁদের মনখারাপ হবে খুব /সারাটি জীবন মনখারাপ হবে খুব…/পরস্পর ছটফট করবে তুমুলভাবে।’
বাঁচো। তোমাকে বাঁচতে হবে…
তোমার-ই,
পাখিটি
ও দেখল, ঘরটি ফাঁকা। তখন ওর শরীরের ভেতর যেন কেউ বৈদ্যুতিন শক দিল হঠাৎ। তুমুলভাবে নড়ে উঠল ও। তারপর বামহাত দিয়ে ঘাম মুছল। চিঠিটি বুকের মাঝখানে চেপে রাখল, অনেক অনেক্ষণ…