• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে আরণ্যক বসু (পর্ব – ১২)

রূপকথা পৃথিবীর

কেউ ভালো নেই ?বলো কবি একবার?
সব চেনা রঙ,সুর হয়ে গেল ফিকে ?
মাটি ও শিকড় ,কোনো কিছু নেই আর ?
চিঠি লিখবে না আমাদের পৃথিবীকে ?
অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পরেই মনে হল , জানিস দিদি , আমার চেনা পৃথিবীটা কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিকই রয়েছে — আকাশে চাঁদ ,তারা ,সূর্য, মাটিতে ধান, ফসলের হাসি, সর্ষেক্ষেতের শোভা– তবু কী যেন নেই বলতো ! আচ্ছা , একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস যে , মা গত দুমাস ধরে তেমনভাবে আর গানের রেওয়াজে বসছে না। বাবার সঙ্গে কথায় কথায় তর্ক করছে, আর মাঝেমাঝে দেখছি বালিশে মুখ চেপে উপুড় হয়ে কাঁদছে । দিদি, তুই কি কিছু জানিস ? মা কেন ভালো নেই ?
আসলে , এই কথাগুলো আমি মনে মনে বলছি । আমার মন একটুও ভালো নেই। পাড়ায় আমাদের পরিবারটাকে নিয়ে চারিদিকে ফিসফাস । সবাই যেন কিছু একটা বলতে চাচ্ছে ,অথচ বলছে না । আমার দিকে আমার বন্ধুরা তেমন সহজ ভাবে আর তাকাচ্ছে না । এরই মধ্যে , মামার বাড়ির মাথার উপরে বট গাছের মতো থাকা ,আমাদের ভালোবাসার দাদুভাই চলে গেলেন‍। সবকিছু মিটলো , কিন্তু মামার বাড়িটাও যেন আশ্চর্যভাবে থমকে গেল । আমরা অনেকদিন মামার বাড়িতে যাইনি। পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল , রেজাল্ট বেরোলো ।আমার মাঝারি মানের রেজাল্ট নিয়ে কোনো সমালোচনা করলো না কেউ! কেন করলো না রে দিদি ? আমি যে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছি , এই যে, ক্লাস সিক্সে উঠতে সিক্সথ হয়ে গেলাম , এর জন্যে আমারই তো লজ্জা করছে । আমি কি অঙ্কে আটষট্টি পাওয়ার মত ছেলে ? অথচ অঙ্ক পরীক্ষার তিন দিন আগে থেকে মা হঠাৎ খাওয়া বন্ধ করে দিলো। যে হারমোনিয়াম ছিল মায়ের প্রাণ , তার দিকে চেয়েও দেখলো না । বাবাও কেমন চুপচাপ হয়ে গেল । আমাকে কাছে টেনে নিয়ে অঙ্ক কষাতে বসলো না। শুধু অফিস থেকে ফিরে, মাকে সারা সন্ধে কী যেন বোঝাচ্ছে ; আর মা শুধু না না না বলে মাথা নাড়ছে । তারপর অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন , ডিসেম্বরের তিন তারিখ , মাঝরাতে মা’র সে কী চিৎকার ! বাবা দৌড়ে ঘরে এসে মাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে , আর মা কতগুলো এমন কথা বলছে , তা আমার বুদ্ধিসুদ্ধির বাইরে । মা কখনও এমনভাবে কথা তো বলেনি। রাত দুটোর পর থেকে আমার আর ঘুম হলো না । এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিলাম । সকালবেলা বাবা শুনলাম তোকে বলছে , মাকে ডাক্তার দেখাতে হবে । কিসের ডাক্তার ? আমার মার কি হয়েছে ? সত্যি করে বলনা দিদি । মামার বাড়ি থেকে একদিন গম্ভীর মুখে বড়মামা ,
মেজমামা এলো , মাকে কত বোঝালো ; মা সেদিন পাথরের মত চুপ করে বসে থাকলো । বড়মামা বললো — বড়দি, স্টার থিয়েটারে সেতু নাটকটা খুব জনপ্রিয় হয়েছে, তৃপ্তি মিত্র অভিনয় করছেন। তাপস সেনের আলো । মঞ্চে আলোর মায়ায় সেতু ভেঙে ট্রেনের দুর্ঘটনা দেখানো হচ্ছে। যাবি বড়দি ? আমি এখানে এসে তোকে নাটক দেখাতে নিয়ে যাব । মা শুধু অসহায়ের মত তাকিয়ে বললো — আমার কিচ্ছু ভালো লাগছেনা রে খোকন। আমার আর বেঁচে থাকতেই ইচ্ছে করছেনা । শুধু মনে হচ্ছে, সবাই মিলে আমাদের এই পরিবারটাকে ধ্বংস করে দেবে । তোদের প্রিয় বড়ো-দাদাবাবুকে অপমান করবে । বলতে বলতে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল আমাদের সেই মা , যে কথায় কথায় গান গেয়ে ওঠে। মা এমন হয়ে গেল কেন রে দিদি ? আমি তোকে লুকিয়ে লুকিয়ে একটা চিঠি লিখবো , কেমন ? আমিতো , আমার মুখ দিয়ে এমন কথাগুলো জিজ্ঞাসা করতে পারবোনা তোকে , তাহলে জানব কি করে ? আমি তো আর ছোট নেই । আমাদের বাড়ি থেকে আলো হাসি গানগুলো মুছে গেল কেন ? বাবা কত সাধ্যসাধনা করছে –ওগো শুনছো, ভালো ভালো সিনেমা এসেছে জয়শ্রী, নিউ তোরুণে আর নারায়নীতে , যাবে ? তোমার প্রিয় সুচিত্রা-উত্তমের ছবি …..আবোল তাবোল না ভেবে আবার গানের জগতে মন লাগাও…. এ পাড়ার মানুষ অত্যন্ত সজ্জন, তাঁরা কেউ আমাদের কোনো ক্ষতি করতে যাবে কেন?
মা সরাসরি সকলের সামনেই বড়মামা মেজমামাকে স্তব্ধ করে, চেঁচিয়ে বাবাকে ধমকে উঠলো — আমার হারমোনিয়াম ফেলে দাও আস্তাকুঁড়ে। আমি আর গান গাইবো না । আমি আর সিনেমা দেখতে যাবো না ।আমি আর কারোর ধারেকাছেও যাবো‌ না। আমাকে তোমরা রেহাই দাও, আমার আর একটুও বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। ঘুমোলেই মনে হচ্ছে ,সবাই আমাদের বাড়িটাকে ঘিরে ধরছে। সবাই মিলে আমাদের বাড়িটাকে ধ্বংস করে দেবে ।
আচ্ছা দিদি , এসব কী কথা শুনছি ? মা যেদিন মাঝরাতে চিৎকার করলো, পরেরদিন পাড়ার বন্ধু বাচ্চু, আমাকে কেমন ভাবে যেন জিজ্ঞেস করলো — ঝন্টু শোন , তোর মায়ের কি মাথার রোগ হয়েছে ? স্কুলেও কিভাবে কথাটা রটে গেল জানিনা ; অভীক আমার ক্লাস টু থেকে একসঙ্গে পড়া বন্ধু , ওর নীল সোয়েটার থেকে ক্রিকেট মাঠে আমি চোরকাঁটা বেছে দিই , সেও কেমন অনায়াসে সবার সামনেই আমাকে বলে দিলো — পরিচয়, তোর মা নাকি মাথাপাগল ? দিদি বিশ্বাস কর , নতুন ক্লাসের নতুন বইগুলো হাতে পেয়েই আমি যে গোগ্রাসে আগে আদ্যোপান্ত পড়ে ফেলি… বাংলা-ইংরেজি-ইতিহাস- বিজ্ঞান সবকিছু … এমন কি অঙ্ক বইটাকেও নিয়ে বুকে জড়িয়ে বলি , ও মা সরস্বতী, আমাকে বাঁচাও । আমাকে দাদার মতন একশোয় একশো পাইয়ে দাও গো মা! এখন সেইসব নতুন বইগুলোকে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আমার স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না দিদি । আমার মাকে কোন ডাক্তার দেখবে ? বণিক ডাক্তার ? যিনি আমাদের বাড়ির ডাক্তার , নাকি পাগলের ডাক্তার দেখবে ? সত্যি করে বলতো দিদি , চলতে ফিরতে সারাক্ষণ গান গাওয়া আমাদের দারুণ সুইট মা কি সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেছে ! তোর মনে আছে দিদি,
এরই মাঝে একদিন খোলা জানলার শিক আঁকড়ে মা কেমন অবাক আর হতাশ গলায় গেয়ে যাচ্ছিলো প্রিয় শিল্পী সুমন কল্যাণপুরের একটা মন কেমন করা গান–আমার স্বপ্নদেখা দুটি নয়ন… হারিয়ে গেলো কোথায় কখন… কেউ তা জানে না গো… কেউ তা জানে না…..
সন্ধে পেরিয়ে রাত নামা, সেই
চোখের জলে ভেসে যাওয়া সময়টুকু তোর মনে আছে ? আমার ভীষণ ভয় করছে রে… আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবি দিদিভাই ?

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।