• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিশ্বজিৎ লায়েক (পর্ব – ৫)

জন্মস্থান – পুরুলিয়া পেশা – সরকারি চাকরি প্রকাশিত কবিতা বই :- ১) ডানায় সে চুম্বকত্ব আছে ২) উন্মাদ অন্ধকারের ভিতর ৩) ভিতরে বাইরে ৪) পোড়া নক্ষত্রের কাঙাল ৫) মুসলপর্বের স্বরলিপি ৬) কৃষ্ণগহ্বর ৭) শরীরে সরীসৃপ ৮) প্রেমের কবিতা ৯) পোড়ামাটির ঈশ্বর ১০) ঈর্ষা ক্রোমোজোম উপন্যাস ১) কৃষ্ণগহ্বর

পূর্ব প্রকাশিতের পর…

রাকা পড়াশোনায় তেমন আহামরি না হলেও একেবারে ফেলনা ছিল না। ক্লাস নাইন টপকে টেনে উঠল রাকা। বাবা সরকারি অফিসের গ্রুপ ডি কর্মচারী।  সুখেই চলছিল দিনগুলি। কিন্তু সুখ কী আর সহ্য হয় রাকাদের! বাপটা মরে গেল বাইক অ্যাক্সিডেন্টে। তারপর ব্যাংকের পাশবুক হাতড়ে যখন জানতে পারল রেখে যায়নি একটা টাকাও। তখন রাগ হয়েছিল খুব। নিশুতি রাতে জোনাকির আলো টুকুই ভরসা। সেটুকুই আশা ছিল যে ফ্যামিলি পেনশন দিয়েই রাকাকে দুপায়ে দাঁড় করিয়ে দেবে। তাও তো হল না। কোন একটা মহিলাকে নমিনি করে গেছে বাপ। সার্ভিস বুকে নাম নেই মায়ের। অফিসের বড়বাবু বললেন, ‘কোর্টে গেলে একটা উপায় হবে। অফিস আপনাকে সাহায্য করবে। আমরা সবাই আপনার পাশে আছি।’
মাকে সেদিন হাপুস নয়নে কাঁদতে দেখেছিল রাকা। ‘তার আর দরকার হবে না বড়বাবু। যে লোকটাকে ভালবেসে বাড়ি ছাড়লাম। সংসার পাতলাম। সে যে এত ছোটোলোক কখনও টের পাইনি। ওর টাকায় বেঁচে থাকতে আমার দংশন হবে। বরং ওই মেয়েটিকেই সব দিয়ে দিন। আমার কোনো দাবী-দাওয়া নেই।’ যে বাবা তাকে এত ভালবাসত, আদর করত সেই বাবা এমন নিষ্ঠুর, লম্পট, চরিত্রহীন! রাকা কিছুই মেলাতে পারছে না। কয়েক দিন আগের জীবনের সঙ্গে এখনকার এই ঘটনা ক্রম কিছুতেই মিলছে না।
ভাড়াবাড়ি ছেড়ে রাকারা উঠে এল বস্তিতে। বস্তির ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের টিউশন পড়াতে শুরু করলেন রাকার মা। কিন্তু এখানে সবার অবস্থা তো দিন আনি দিন খাই। ছয় সাত বছর হলেই বাড়ির ছেলেমেয়েদের কাজে লাগিয়ে দেয় বাবুদের বাড়িতে। অভাব এদের চোখে মুখে ফুটে আছে সাদা কাশ ফুলের মতো। রুগ্ন জীবনের অন্ধকার কালো করে দিয়েছে সামনের পথ।আলো ক্রমশ দূরে দূরে গিয়ে নিভে গিয়েছে। বাবুদের বাড়ি বাড়ি কাজ করে। কেউ কেউ রেলস্টেশনে ভিক্ষা করে। সন্ধ্যা হলেই ডেনড্রাইট কিনে ডেরায় ফিরে আসে। রুমালে ঘষে নেশায় বুঁদ হয়ে ওঠে পবিত্র শৈশব। এইসব দেখে রাকা জীবনকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চায়। কিন্তু সহজ নয় জেনেই ভালবেসে ফেলে নিজেকে, মাকে, সুনয়দাকে, তুলিকে।
টিউশনির পাশাপাশি মা ঠোঙা বানাত। সংসার চালাতে তো টাকা চাই। বাজারের এক মুদির দোকানদার সব ঠোঙা কিনে নিত। দুজনের পেট চলে যেত। একদিন কী হল কে জানে!  সব ঠোঙা ফেরত এনে মা জ্বালিয়ে দিল। আগুনের শিখার মতো মা’রও মুখেও গোলাপী আভা। রাগে কথা সরছে না মুখে।  রাকা যত বলছে, ‘মা বলবে তো কী হয়েছে! বলো!’
মা’র চোখে জল চিকচিক করছে। মা কাঁদলে রাকারও কান্না পায়। সে দিনের ঘটনা কোনোদিন ভুলবে না রাকা। মা তাকে কখনো বলেনি সেদিন কী ঘটেছিল। বস্তির ছেলেরা নাকি জানতে পেরেছিল। একটা হেস্ত নেস্ত হয়ে যেত মা চায়নি তাই। মানুষ যে কত রকমের হয় ভেবে কুল পায় না রাকা! কত মানুষ বিচিত্র সব ধান্দা নিয়ে দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে। রাকা ভাবে, এই যে নোংরা চিন্তার ভেতর মানুষ সেঁধিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বেঁচে থাকছে কেন এই অন্ধকারের ভেতর তাদের যাত্রা, কেন তারা বেরিয়ে এসে আলোর দিকে বেঁকে যায় না! এই যে জানালায় রাখা গাছটি আলোর দিকে বেঁকে গেছে বেঁচে থাকার নিমিত্তে, মানুষ কেন পারে না! মানুষ কেন অন্ধকার পুঁতি গন্ধময় জীবনের রসায়নে জারিত হতে চায়, কেন কেন! রাকা চিৎকার করে ওঠে। সারা আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। রাকা ছুটতে থাকে পিচ ঢালা রাস্তায় একাকী এক নির্জন গানের মতো।
আর কিছুদিন পরেই মাধ্যমিক। রাকা ঠিক করল মাধ্যমিক দেবে না। কটা লোক চাকরি পায় মাধ্যমিক পাশে। বাবা কিন্তু এইট পাশেই চাকরি পেয়েছিল। বাবার কথা মনে পড়ছে কেন বুঝতে পারল না রাকা। তবে কি সে বাবাকে ভুলে যায়নি। বাবাকে ভুলে যাওয়া এত সহজ নয়, রাকা এটা অনেক আগেই বুঝেছিল। কেমন যেন লতায়-পাতায় জড়িয়ে থাকার মতোই সে জড়িয়ে থাকে বাবার অজস্র স্মৃতির ভেতর। সেখান থেকে নিজেকে বের করে একদম খোলা রাস্তায় এনে তুলতে চেয়েছে নিজেকে, পারেনি বরং আরো আরো জড়িয়ে গেছে সম্পর্কের উদযাপনে।
তার একটা কাজ দরকার। বড় কালিতলায় অর্ণবদার গ্যারেজ। ওরা একটা ছেলে চাইছে। সকালে উঠেই রাকা সাইকেল নিয়ে বেরোল। মা বলল, ‘কোথায় যাবি এত সকালে! তোর মামা আসবে।’
-‘এক্ষনি আসছি। চপ আনবো মা? মুড়ি মেখে খাবে। ধনে পাতা নেই মনে হয়! আচ্ছা ধনেপাতা, পেঁয়াজও নিয়ে আসব।’
তারপরই এই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল রাকা। ডবল ডিমের ওমলেট আর রুটি, ঘুঘনি খেয়ে পেট যখন শান্ত হল ঠিক তখনই মায়ের কথা মনে পড়ল। চপ, ধনেপাতা আর পেঁয়াজ নিয়ে যাওয়ার কথা। মা যে এখনও কিছুই খায়নি। রাকা যতবার রাত করে ফিরেছে,  দেখেছে মা খাবার বেড়ে বসে আছে। তার খাওয়া হলে সেই থালাতেই দুটো রুটি আর তরকারি নিয়ে বসেছে। কিন্তু কোথাকার জল কোথায় গড়াল! নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছে।
বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সুনয়দাকে বলল, দাদা আমি উঠলাম। বাড়ি যেতে হবে।
দু’মিনিট দাঁড়া। আমি তোকে পৌঁছে দিচ্ছি।
রাজুদা রাকার পিঠ চাপড়ে বলল, আয় তাহলে। পরে আবার কথা হবে। মাঝে মাঝে আসিস। এলে ফোন করিস। সুনয়ের কাছে আমার নাম্বারটা নিয়ে নিবি।
রাজুদার ব্যবহারে বাচ্চু একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। কী হচ্ছে কী এই সব! অন্য পাড়ার একটা ছেলে এসে তাকে মেরে যাচ্ছে অথচ নিজের পাড়ার রাজুদার সাপোর্ট পাচ্ছে অন্য পাড়ার সেই ছেলেটা। রাগে দাঁত কিড়বিড় করছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। রাগ পুষে রাখছে। কোনোদিন সুযোগ পেলে সুদে-মূলে শোধ দেবে। কিন্তু সেই সুযোগ কী আর আসবে, মনে হয় না। শালা, সারা জীবন এই মারের দাগ তাকে বয়ে বেড়াতে হবে ভাবলেই কেমন যেন গা গুলিয়ে আসছে বাচ্চুর।
পাড়া থেকে মস্তানি শুরু করে একদিন ডন হয়ে উঠবে এই মফস্বল শহরের এমন ইচ্ছার মুখে আজ নুড়ি জ্বেলে দিল রাজুদা। রাজুদার প্রতি আর শ্রদ্ধা আসছে না। রাগ হচ্ছে। প্রবল বেয়াদপ রাগ।
ক্রমশ…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।