• Uncategorized
  • 0

গদ্যে বিপুল দাস

ব্রহ্মা-নারদ সংবাদ

হে চতুরানন, আপনি ত্রিকালদর্শী। কলিযুগের লক্ষণ কীরূপে প্রকট হইবে, সে বিষয়ে ঈষৎ ব্যক্ত করুন।

শ্রবণ কর দেবর্ষি, বিবিধ লক্ষণ দ্বারা বিবুধমন্ডলী বুঝিতে পারিবে ইহাই শাস্ত্রকথিত কলিকাল। অনেক রাজত্বের অবসানে তখন প্রোমোটার-রাজ নামক এক প্রকার রাজ বলবৎ হইবে। এই রাজত্বে রাজচক্রবর্তী, সামন্ত, নবাব, জমিদার, তহশিলদার প্রমুখ শাসকবৃন্দ জল, স্থল ও ব্যোম অধিকার করিবে। ক্রন্দনরত শিশুকে যেমন মৃৎশকট দ্বারা প্রশমিত করা হয়, সেইরূপ উহারাও স্থলভূমির প্রকৃত অধিকারীকে বিবিধ উপায়ে প্রশমিত করিয়া ভূমি গ্রাস করিবে। না পারিলে অস্ত্রবল প্রয়োগ করিবে, না পারিলে মহামাত্যের আদেশনামা সংগ্রহ করিবে। অর্থাৎ ছলনা, বল ও কৌশলে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিবে। গগনচুম্বী হর্ম্যরাজি আকাশ আচ্ছন্ন করিবে। ইহাই ব্যোমগ্রাস। আর যত দিঘি, বাপী, সরোবর, পুষ্করিনী, তড়াগ ও ক্ষুদ্র পল্বল – সব জলাভূমি ও জলাশয় নিরম্বু হইলে তত্র ইমারত প্রতিষ্ঠিত হইবে। ইহাই জলগ্রাস।

হে কমলযোনি, দেশস্থ শাসক, নগরপাল, উহারা কি নিশ্চুপ থাকিবে ?

অহো নির্বোধ ঋষি, কলহ ছাড়া জীবনে আর কিছুই শিখিলে না। অবধান কর, কলিযুগে এক কবি লিখিবে – “ এ কালের রাজত্বে রাজা থাকেন সামনে, পেছনে থাকে বেনে। যাকে বলে অর্ধবেনেরাজেশ্বর মূর্তি”। একটু এডিট করিয়া লইতে হইবে। কলিযুগে রাজা থাকেন সামনে, পেছনে থাকে প্রোমোটার। যাকে বলে অর্ধপ্রোমোটাররাজেশ্বর মূর্তি।

হে প্রজাপতি, আগে কহ আর।

শ্রবণ কর। কলিযুগে শিশুমেধ নামক একপ্রকার যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হইবে।

শিশুমেধ ? কতিপয় দুরন্ত শিশুকে বুঝি প্রান্তরে ছাড়িয়া দিবেন কোনও নৃপতি। উহারা অপ্রতিহত গতিতে মহাল, তালুক, পরগণা, পঞ্চায়েত, মহকুমা পরিষদ, নগরপালিকা, বিধানসভা ইত্যাদি নির্বিবাদে ঘুরিয়া আসিবে। অতঃপর নৃপতি আরও নৃপতি হইবার জন্য …

ওহে ঢেঁকিবাহন, বেশি বাচালতা করিও না। আমার এই কাষ্ঠপাদুকা বহুদিন যাবৎ ক্ষুধার্ত রহিয়াছে। সেই যখন মধুকৈটভ আমার পিছনে লাগিয়াছিল, বিষ্ণু তাহাদের বধ করিবার সময় আমিও দুইচারি ঘা দিয়াছিলাম। রসনা সম্বরন কর।

ইতরকে মার্জনা করুন, হে লোকপিতামহ। আমি ভাবিয়াছিলাম অশ্বমেধের ন্যায় কিছু হইবে।

অবধান কর। ঐ যজ্ঞের অপর নাম কলিযুগে হইবে অ্যাডমিশন টেস্ট।

অ্যা ?

অ্যাডমিশন। কর্ণমল কতদিন পরিষ্কার করা হয় নাই ? দূরে দাঁড়াও। তোমার শ্মশ্রু হইতে উৎকুন, জীর্ণবাস হইতে উৎকট বাস আসিতেছে। অবধান কর। পিতামাতা এই ভয়ানক যজ্ঞে শিশুকে উৎসর্গ করিবার নিমিত্ত বায়ুরোগগ্রস্ত প্রাণীর ন্যায় আচরণ করিবে। ভ্রমবশতঃ নাসিকাছিদ্রে অন্ন দিবে, আপন স্ত্রীকে মাতা সম্বোধন করিয়া ফেলিবে, শ্বশ্রূকে শ্যালক মনে করিবে। শিশুগণ বিনিদ্র রাত্রি যাপন করিয়া সিরাজউদ্দৌল্লার পিতার নাম কী আছিল, চন্দ্রের ওজন কত, অর্কপুষ্পের বৈজ্ঞানিক নাম কী, পেরিপ্লাস অফ দা ইরিথ্রিয়ান সি বলিতে কী বুঝায় – এবম্বিধ প্রশ্নের উত্তর শুকপক্ষীর ন্যায় স্মৃতিধার্য করিবে।

মহর্ষি, কোনও মুনিপ্রবর কি উপনিষদের নতুন খন্ড প্রকাশ করিয়াছে ? অ্যাডমিনোপনিষদ ?

জানি না। অধুনাতম সংশোধিত ও পরিবর্ধিত উপনিষদের সূচী দেখি নাই। নিকটে আইস, একটি কথা বলিব।

বাপরে ! নিশ্চয়ই সর্জবৃক্ষের কাষ্ঠনির্মিত। কী কঠিন প্রহার।

স্মরণ রাখিও। আরও শ্রবণ কর। দূরদূরান্ত জনপদে শিশু অবাধ্য হইলে তাহার পিতামাতা বলিবে – শান্ত হও বাছা, ওই অ্যাডমিশন-জুজু আসিতেছে। শিশুর মুখমন্ডল আতঙ্কে নীল হইবে ও জড়পুত্তুলিবৎ হইবে। ত্রয়োবিংশ গুণাবলিযুক্ত খাদ্য গ্রহণে শিশু অনীহা প্রকাশ করিলে পিতামাতা তাহাকে উক্ত জুজুর ভয় দেখাইবে। অতঃপর শিশুর নিদ্রাকর্ষণ হইলে পিতামাতা আপন পাঠে মনোনিবেশ করিবে। ফরাসিদেশের সংবিধান, মহাবিষ্ফোরণ তত্ত্ব, ঔপনিবেশিকতা ও বৃহৎ পুঁজির সমস্যাবিষয়ে জ্ঞান অর্জন করিবে।

উহারা কী উদ্দেশ্যে জ্ঞান অর্জন করিবে ? অ্যাডমিশন জুজু তো শিশুদের খায়।

ঢেঁকি চড়িয়া তুমিও বুদ্ধির ঢেঁকি হইয়াছ। অগ্রে পিতামাতার জ্ঞানের পরীক্ষা, সফল হইলে শিশুর পরীক্ষা। অতঃপর উহারা বিখ্যাত শিশু-শিক্ষায়তনে প্রবেশ করিবার উপযুক্ত বিবেচিত হইবে।

হে হিরণ্যগর্ভ পদ্মপাণি, বড় সাধ হইতেছে এই যজ্ঞ আপন চক্ষে প্রত্যক্ষ করি।

যাও বৎস, এখন যজ্ঞ পূর্ণমাত্রায় ক্রিয়াশীল। দেখিয়া তোমার খঞ্জনি বাজাইয়া উহার মহিমা সংসারে কীর্তন কর। সাবধানে থাকিবে। গেরুয়া পোশাক না থাকিলেই ভালো। সম্ভব হইলে উর্ধাঙ্গে শ্বেত ও নিম্নাঙ্গে নীল বসন পরিও।

দেবর্ষি নারদ তাঁর ঢেঁকির ওপর বসে দু’বার পেডাল মারলেন। ফলস্‌ হ’ল। এবার ঢেঁকি একটু ডানদিকে কাত করে আবার সোজা করলেন। তারপর কিক করতেই কিছুটা মহাজাগতিক ধুলো উড়িয়ে সশব্দে ঢেঁকি সচল হ’ল। ফার্স্ট গিয়ারে ফেলে দেবর্ষি নারদ বেরিয়ে গেলেন।

স্থানঃ দক্ষিণ কলকাতা, কালঃ রাত্রি তিন ঘটিকা, পাত্রঃ অগণিত জনগণ। একটা চায়ের দোকানের সামনে খুব পুরনো মডেলের একটা স্কুটার দাঁড় করানো রয়েছে। তার পাশেই সাদা শার্ট ও নীল জিনস্‌-এর প্যান্টপরা একজন বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার দাড়ি চুলকোচ্ছে। বলা বাহুল্য ইনিই দেবর্ষি নারদ।

দাদু, দোকানের সামনে থেকে আপনার ওই পুরনো মালটা সরিয়ে রাখবেন। আচ্ছা, আপনি বেশি পুরনো, না আপনার এই গাড়িটা ?

দাদু শুনে মেজাজটা খচে গেল নারদের। তার ওপর তার গাড়ি নিয়ে খোঁটা। স্কুটারটা সরিয়ে রাখলেন বটে, কিন্তু ঝগড়া বাঁধানোর জন্য একটু দূরে দাঁড় করানো একটা বিশাল সাইজের বাইক যোগবলে ঠিক দোকানের মুখে দাঁড় করিয়ে সরে পড়লেন।
চলছেন তো চলছেন। পথের একপাশে মানুষের লাইন। নীচে মাদুর, চাদর, কাগজ, বিছানা পেতে লোকজন শুয়ে আছে। অনন্ত এক সরীসৃপের মত মানুষের সারি। কিছু বুঝলেন না দেবর্ষি। স্কুটার দাঁড় করিয়ে একজন দোকানির কাছে জানতে চাইলেন ব্যাপারটা কী।

আজ দুপুর দু’টো থেকে স্কুলে ভর্তির ফর্ম দেবে। তারপর লোকটা গলাটা নামিয়ে চোখ সরু করে তাকে জিজ্ঞেস করল – লাগবে ? মাল্লু কিন্তু অনেক বেশি পড়বে। দাদাদিদিদের দিয়ে থুয়ে আমার অল্পই থাকে।

তারপর ?

তারপর আপনার ইন্টারভিউ। পাশ করলে আপনার বাচ্চার ইন্টারভিউ। পাশ করলে অ্যাডমিশন। তখন অবিশ্যি অনেক টাকার খেলা।

তারপর ?

ধুর মশাই, আতাক্যালানের মত কথা বলবেন না তো। তারপর কী হয় জানেন না ? আপনার ছেলের গাড়িবাড়ি কনফার্ম।

শিক্ষা ?

কেন, বাড়িতে প্রাইভেট মাস্টার রাখবেন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।