অনুভব-কলমকথায় অনিন্দিতা শাসমল

একই অনুভবে মিশে..

বেডরুমের দেওয়াল ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা পঁচিশ।
কতদিন পর অন্ধকারের স্তব্ধতা ভেঙে ভেঙে ভেসে এল সেই পরিচিত শব্দ ; জানান দিলো শেষ লোকাল ট্রেনের স্টেশনে ঢোকার চূড়ান্ত শ্লথগতি।
সপ্তাহের ছ়দিন যে শব্দ শুনে ছুটে হাঁপাতে হাঁপাতে ,কখনো ওভারব্রিজ হয়ে আবার কখনো বা রেললাইনের ওপরেই লাফ দিয়ে উল্টো দিকের পাদানিতে পা রাখে মল্লিকা ।
একদিন তো সকলের চিৎকার শুনে সম্বিত ফিরে দেখে,যখন সে পাদানিতে পা দিয়েছে,ট্রেন তখন চলতে শুরু করেছে !
যাক বাবা ! স্কুলটা তো করা যাবে আজ !
সকাল থেকে এতো প্রস্তুতি ,তিনবেলার রান্না করে হটপটে গুছিয়ে রেখে ,এত কাণ্ড করে যদি বাড়ি ফিরে আসতে হত !
এই তার রোজনামচা।
রোজ ভাবে একটু আগে বেরোবে ,কী করে জানিনা ঠিক দেরি হয়ে যায় ।
তবু আর পাঁচজনের মতো স্বচ্ছন্দে গাড়িতে করে স্কুলে যায় না মল্লিকা।
কারণ একটাই..
ট্রেনের জানলায় চোখ রেখে যখন দেখে — সবুজ গাছপালা, প্রকৃতি সব কেমন সরে সরে যাচ্ছে —
জ্ঞান-বিজ্ঞান দূরে সরিয়ে ,শিশুর মতো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে !
প্রায় আট মাস হয়ে গেল—
সেই রেলপথ, ট্রেনের জানলা কিছুই ছিলনা ; গতিহীন জীবন।
আবার সেই চেনা ছন্দ,চেনা সুর…!
রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় ইথার তরঙ্গে ভেসে আসা ট্রেনের হর্ণ শুনে আনন্দে নেচে ওঠে তার মন !
“মা শুনছো ট্রেনের আওয়াজ !”
চমকে উঠে দেখে, ছেলের চোখে মুখেও এক আনন্দ, এক বিস্ময় !
আর ক’দিন পরেই রাত বারোটায় শিশু দিবসের কলকাকলি শেষ হলে, কৈশোর পেরিয়ে সদ্যযৌবনে পা রাখা সন্তানকে ‘হ্যাপি বার্থডে’ না বলে ,দু কলি সুকান্ত শুনিয়ে উইশ করার প্ল্যান করছিল মেয়ের সাথে —
“তবু আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি “….
এতদিন পর আবার ট্রেনের শব্দ শুনে, ছেলে ছুটে এসে জানালো তার অনুভবের কথা, ভালোলাগার কথা —
বাড়ির সামনের নির্জন রাস্তায় বাইকের হর্ণ, যাত্রীদের ফিসফাস ফিরিয়ে দিয়েছে কিছুটা হলেও আগের সেই সচল পৃথিবীকে ।
এক অনুভবে মিশে যাওয়া মল্লিকার দুচোখে তখন জলের ধারা।
মনে মনে বলে চলেছে বিশ্বকবির সেই লাইনগুলো–
” মা শুনে কয় হেসে কে়ঁদে
খোকারে তার বুকে বেঁধে
ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে ।”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।