‘হয় চিকিৎসা করো, নয় আমাকে মেরে ফেলো’ তীব্র যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠছে একরত্তি ধর্ষিতা শিশুটি, যাকে স্কুলের রাস্তায় ক্যাডবেরির লোভ দেখিয়ে বছর কুড়ির ইরফানের নেতৃত্বে তার সঙ্গীরা অপহরণ করে নিয়ে যায়, নির্মমতম যন্ত্রণার ধারাবাহিক ধর্ষণের শেষে ধারালো অস্ত্র দিয়ে সাত বছেরর শিশুটির গলা কেটে মেরে ফেলার চেষ্টা করে তারা। পরের দিন ক্ষতবিক্ষত মৃত্যুস্পর্শিত শিশুটিকে স্কুলের সাতশো মিটার দূরে এক ঝোপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। সাতদিন যমে মানুষে টানাটানির পর ইন্দোরের মন্দসৌরের শিশুটি আজ ১জুলাই ২০১৮, কথা বলতে পারল আবার। একটা দুটো কথায় সে জানিয়েছে সে আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না। সে আর বাঁচতে চায় না। তাকে যেন মেরে ফেলা হয়। তার এই আর্ত চিৎকারের পৃথিবী রুপোলি আর খুরের হরিণকে দেখে বিস্মিত দাবিয়াঙ্কার পৃথিবী আপাতভাবে হয়তো একই। কিন্তু…সত্যিই কি এক!
আলবেয়ার কার্মুর The Plague এর চতুর্থ পর্বে রোদের তেজে গরম হয়ে ওঠা হাসপাতালের লোহার বেডে মন্দসৌরের মেয়েটির বয়সী একটি ছেলে চিৎকার করছে রক্তাক্ত জন্তুর মত আর্তনাদ করছে। অদ্ভুতভাবে দুমড়ে মুচড়ে বেঁকে যাচ্ছে তার শরীর। অন্যরা যখন শান্তভাবে এই মৃত্যুযন্ত্রণার সামনে নতজানু হয়ে পরাজয় মেনে মারা যাচ্ছে, এই ছেলেটি তখন একা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করে যাচ্ছে তার ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া এই যন্ত্রণাকে। ‘বাঁচাতে না পারলে মরো! মেরে ফেল আমাকে!’ ইন্দোরের সেই ধর্ষিতা শিশুটির চিৎকার সুন্দর মানিয়ে গেছে তার মুখেও। আর আমরা সবাই যেন যাজক পানেলুর মতো হাজার হাজার বছর মাটিতে হাঁটু মুড়ে প্রার্থনা করে চলেছি ‘প্রভু, এই শিশুটিকে নিস্কৃতি দাও!’ যুক্তি দিয়ে নিজেদের বোঝাচ্ছি- ‘So, if he is to die, he will have suffered longer.’ ক্ষিপ্ত হিংস্র অসহনীয় যন্ত্রণায় ডাক্তার রিওর মতো প্রশ্ন করছে না কেউ- ‘ Ah! That child, Any how, was innocent- And you know It as well as I do!’
দাবিয়াঙ্কাদের জীবন এখন এরকম। এই পৃথিবীই তো তাদের দিয়েছি আমরা! সাত বছরের ঐ শিশুটি মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে অন্ধ চোখে চিৎকার করে গেছে- ‘বাঁচাতে না পারলে, মরো! মেরে ফেলো আমাকে’। যখন ও বড়ো হবে তখন জানবে যে যন্ত্রণাকে অসহ্য মনে করাটাও একধরনের অযোগ্যতা, ব্যর্থতার একটা দগদগে ছাপ। চিৎকার করে জানাতে নেই একে। বরং সহ্য করতে হয় দাঁত চেপে। কীভাবে তার জন্য তৈরি হবে দাবিয়াঙ্কা? তার ক্রমপ্রস্তুতির একটি দৃশ্যে যেতে হবে এবার। সেখানে তার নাম আর দাবিয়াঙ্কা নয়। ‘মেয়েটি’- এরকম একটি অচিহ্নিত অস্তিত্বই বহন করুক সে এই গল্পে।
৫।
বনভূমির ধারে নির্জন একটি টিলার পেছনে সৈনিকের পোশাকে একজন মাঝবয়সী পুরুষ বারো বছর বয়সের একটি মেয়ের কাঁধ সস্নেহে আলতো ছুঁয়ে আছে। কেউ কাউকে দেখেনি আগে। সৈনিকের কাঁধে ব্যান্ডেজ। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আহত রক্তাক্ত সে বাড়ি ফিরছে- যেখানে মাসকুলার ডিসট্রফি আক্রান্ত তার ছেলে আছে, যে এই মেয়েটির বয়সী। লোকটির স্নেহের স্পর্শে মেয়েটি হয়তো মনে পড়ছে দাদু ককভানিয়ার পাশে বসে গল্প শোনার দিনগুলো। অথবা কিছুই মনে পড়ছে না। সৈনিক ছেলের জন্য খাঁচায় একটা সুন্দর পাখি নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেকে সেরকমই কথা দেওয়া আছে তার অনেকদিন আগে। মেয়েটি পাখি হাতে তুলে নেয়। জানতে চায়, এত ছোট পাখি কতটুকু আর মাংস যোগাবে? বলে, সৈনিকের উচিত পাখি বদলে বড়ো কোনো পাখি নিয়ে আসা। কেননা মারবে বলেই ছেলেটা পাখি চেয়েছে। ছেলে অশক্ত না হলে, সৈনিক ছেলের হাতে ছুরি দিয়ে পরীক্ষা করে দেখুক পাখি নিয়ে তার ছেলে কি করে। বাবা হিসেবে সৈনিকের উচিত ছেলেকে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য তৈরি করে দেওয়া। রক্তপাতের জীবনের প্রাথমিক শিক্ষা না থাকলে বাঁচা যাবে না। হত্যাই যোগাযোগের ভাষা, আন্তরিক কোনো সম্পর্কের প্রথম ধাপ। যখন থকথকে রক্ত ছিটকে মাটিতে নেমে আসে, কেমন অদ্ভুত গন্ধ-মিষ্টি, সোঁদা, একটু ভেজা ভেজা। যেন কোন ছোট্ট বীজ খুলে গেল, আর নতুন আলোর দিকে ফুটে উঠলো ছোট্ট একটু পাতা।
চারবছর আগে মাকে সে দেখেছিল নগ্ন, লিপ্ত, মায়ের একজন বন্ধু পুরুষের সঙ্গে। মাঝে মাঝেই দৃশ্যটি দেখতে হতো তাকে আর পাগল পাগল লাগত তার। একদিন বাবার জন্মদিনে ছোট্ট উদযাপনে সে তার পোষা পাখিটাকে মেরে হাসি মুখে উপহার দেয় বাবাকে, একটা সুদৃশ্য পকেটে মুড়ে, সারপ্রাইজ গিফট হিসেবে। বিদ্যুৎ-এ যেন স্পর্শ করে ফেলেছে তার বাপ আর মা, এমন ভয় তাদের চোখে। প্রচুর ভালো সময় দেবার চেষ্টা করা হলো মেয়েটাকে। সৈনিকের পাশে বসে গল্পচ্ছলেই সে বলেছিল তার জীবনকাহিনী। বলছিল, এই বাড়াবাড়ি রকমের মনযোগ, এইসব ভালবাসা- অর্থহীন। পৃথিবী অনেক বিষ দিয়েছে তাকে, যে বিষ আসলে জ্ঞান, জীবন শৈলী। যুক্তির সপক্ষে এক ফাঁসির আসামীর কথা বলে সে।
ফাঁসুড়ের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাউকে। কয়েক মিনিট পরেই পাটাতন সরে যাবে তার পায়ের তলা থেকে। ছোট্ট ঘরের ভ্যাপসা গন্ধ, কুয়োর অদ্ভুত গন্ধ, মুখে বাঁধা কালো কাপড়ের গন্ধে বিষম কাশছে লোকটা। যদি সে কাশির ওষুধ চায় এরকম একটা সময়-মৃত্যুর সামনে অনেকেই বোকা হয়ে যায়-তাকে কাশির ওষুধ দেওয়া খুবই মানবিক একটা কাজ সন্দেহ নেই।
কিন্তু যে লোকটা আর দু’চার মিনিট মাত্র বেঁচে থাকছে তার ওষুধের প্রয়োজন নেই। শেষ দুয়েক মিনিট যদি কাশির সমস্যা নিয়ে সে ব্যস্ত থাকে, মৃত্যুভয় একটুও হয়তো কম অনুভব করবে সে। তাই তাকে ওষুধ না দেওয়াও সমান মানবিক।
আবার এই মানবিক অবস্থানেরও সমস্যা আছে একটা। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে যার একশোভাগ মনঃসংযোগ থাকবে মৃত্যুর দিকে, ভয় থেকে তাকে সরিয়ে আনার এই চেষ্টাও অর্থহীন।
সৈনিক মেয়েটিকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে বলে তৈরি হচ্চে। মেয়েটি তাকে নিরস্ত করল। ঘুমে বুজে আসছে তার চোখ। মেয়েটির ঘুম জড়ানো মুখের দিকে তাকিয়ে সকালটির অবাস্তবতা নিয়ে ভাবছিল সৈনিক। জঙ্গলের রাস্তা ধরে ফেরার সময় একটা চিৎকার মেশানো কান্না শুনে সে দৌড়ে গিয়ে দেখেছিল একটা লোক জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটিকে। পরিস্থিতি মুহূর্তে বুঝে নিয়ে একটা বড়ো আর ভারী পাথর তুলে লোকটার মাথায় ছুঁড়ে মারে সে। মারাত্মক আঘাতে লোকটা পড়ে যায়। মারাও যায় কিছুক্ষনের মধ্যেই। মেয়েটি চুপ করে সেই মৃত স্তব্ধ মুখটিকে দেখে। কানের পাশ আর মাথার পেছন থেকে রক্ত গড়িয়ে নামছে। অসম্ভব শূন্য, সাদা ও সুদূর মুখ নিয়ে মেয়েটা ঝুঁকে পড়েছিল সেই রক্তে। ঘ্রাণ নিচ্ছিল চোখ বুজে। কিছুক্ষন পরে সৈনিকটি তাকে টেনে নিয়ে যায়। কথা বলে স্বভাবিক করার চেষ্টা করে। দুয়েকটি কথা খুব নিস্পৃহ অনিচ্ছুক গলায় বলেছিল মেয়েটি। তার মা-বাবার কথা, ফাঁসির সেই আসামির কথা, নিজের কথা সংক্ষিপ্ত ভাবে সৈনিকটি শুনেছিল তার মুখে।
বিকেল নেমে আসছে, অনেক দূরের রাস্তা যেতে হবে। মেয়েটিকে ঘুম থেকে তোলে সৈনিক। মেয়েটি বলে সে বাবার কাছে থাকতেই চায়। বাবাকে ছেড়ে যেতে চায় না। থেমে থেমে মেয়েটি বলে যে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে আছে গত দু’দিন। তার বাবা আজ খুঁজে পেয়েছিল তাকে। জোর করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। তখন সৈনিক এসে বাবাকে মেরে তাকে উদ্ধার করেছে।
যেন আকস্মিক কোনো প্রবল আঘাতে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ে সৈনিক। মেয়েটিকে জড়ানো গলায় বলে সে অন্য কিছু ভেবেছিল লোকটাকে, তাই-। মেয়েটি সান্ত্বনার হাত রাখে সৈনিকের পিঠে। বলে সৈনিকের দিক থেকে এই প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল। ঘটনাক্রমে এই মানুষটি তার বাবা এবং তার ক্ষেত্রে সে ধর্ষক নয়। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে সে যে ধর্ষক হবে না, এটা ধরে নেওয়া ভুল।
লোকটির হাতে ঝুলি থেকে ছিটকে পড়ে যাওয়া একটা টফিন কৌটো সে মেয়েটিকে দেয়। মেয়েটি জনায় এটা তার জন্যই বাবা নিয়ে এসেছিল। বাবা জানে দুদিন সে খায়নি। সৈনিকের কাছে সে কিছু খাবার আছে কিনা জানতে চায়, কেননা রক্ত লেগে এই খাবারটা নষ্ট হয়ে গেছে। বাবার রক্তের ঘ্রাণ সে নিচ্ছিল যখন, তার মনে হয়েছিল এই ঘ্রাণের মধ্যে কোথাও সে রয়েছে। রক্তের এই ঘ্রাণটুকু নিয়েই সে বাঁচবে।
সৈনিকটি খাবার দিলে সে নেয় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। সৈনিকের সাথে সে বাড়ি ফিরবে না। এখন থেকে সে নিজেকে খরচ করে নিজের মতো বাঁচবে। তার অপুষ্ট অপ্রস্তুত শরীর সে তৈরি করে নেবে মৃত্যু পর্যন্ত রক্তপাতের জন্য।
‘রুপোলি খুর’ গল্পে এই কাহিনী নেই। থাকার কথাও নয়। কিন্তু দাবিয়াঙ্কারা কোনদিন আর দৌড়ে জ্যোৎস্নায় নেমে হরিণের পা থেকে ছড়িয়ে পড়া রঙের ঝর্না দেখবে না। তাদের জন্য অন্য এক জীবন বরাদ্দ হয়েছে- যেখানে সবকিছুর জন্য ছাড় আছে, অনুমতি আছে, বিচারের গম্ভীর ঠাট্টাগুলি আছে। নিরুপায়ভাবে, অসহায়ভাবে, চোখে জল নিয়ে, যে অনুমতি, যে ছাড়, যে সংরক্ষণ, যে বিচার আমরা দিয়েছি।