আজ যৌনকর্মীদের উপর শারীরিক মানসিক অত‍্যাচারের প্রতিবিধানের দিন

মেয়েরা আওয়াজ তুলেছিলেন, গতর খাটিয়ে খাই, শ্রমিকের অধিকার চাই।
আমি যৌনকর্মীদের কথা বলছি। সাহিত‍্যে রকমারি শব্দে তাঁদের পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। জনপদবধূ বোধহয় এরমধ‍্যে দীর্ঘতম শব্দ। এছাড়া বারবধূ, বারাঙ্গনা, পণ‍্যাঙ্গনা, নটী, এমন অনেক শব্দ রয়েছে। সবচেয়ে কুৎসিত বোধহয় বেশ‍্যা আর পতিতা। আমি এর পুংলিঙ্গ শব্দ পাইনি। জিগোলো বললে হবে না। সতীর যেমন পুংলিঙ্গ হয় না, খানকি মাগীর তেমনি পুংলিঙ্গ হয় না। পুরুষদের ওসব হয় না বুঝলেন। এমনকি যাঁরা নারীমাংসের সন্ধানে সোনাগাছি বা হাড়কাটার তস‍্য তস‍্য গলিতে ঘোরাফেরা করেন, সেইসব পুরুষ দের কি বলে আমি জানি না। তাঁরা সব অবশ্যই ভদ্রলোক। ধোয়া তুলসীপাতা।
বেশ‍্যাবৃত্তিকে বলা হয় বিশ্বের আদিমতম পেশা। আমাদের ধর্মপুত্রের জুয়া খেলার নেশা ছিল এবং জুয়াতে তিনি ঘরের বৌকে পর্যন্ত বাজি রাখতে জানতেন। প্রকাশ‍্যে গুণ্ডারা সেই মেয়ের কাপড় খুলে নিলে তিনি ভাগ‍্যকে দুষতেন। গুণ্ডাদের কিছু বলতেন না। মহাভারতের গৃহবধূর যখন এই অবস্থা, তখন আদিমতম পেশায় লিপ্ত বারবধূর অবস্থা অবশ‍্য‌ই শোচনীয়।
আমি কৈশোর শেষ হবার আগেই এই মেয়েদের দেখেছি। আমার পড়াশুনা মধ‍্য কলকাতার অন‍্যতম সেরা বাণিজ্য মহাবিদ‍্যালয়ে।  পাশেই ছিল হাড়কাটা গলি। ভাল ভাষায় প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট। ক্লাসরুম থেকেই স্নানসিক্তা ললনাদের ছাতে উঠে রৌদ্রে চুল শুকানো দেখতে পেতাম। ওই গলিতে গিয়ে দেখেছি, কোনো কোনো বাড়ির দরজায় লেখা আছে, “এটা ভদ্রবাড়ি”।
অথচ এমন নয় যে এই মেয়েরা কিছু আকাশ থেকে পড়েছেন। এঁরা রীতিমতো মায়ের কোলে বাপের ঔরসে জন্মেছেন। এঁদের কাছে গিয়েছি। এঁদের পুজোর প্রসাদ আমি কাঠনাস্তিক লোকটা অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে গ্রহণ করেছি।
তাহলে এই পতিতাপল্লীতে এঁরা এলেন কি করে?
সেটা জানতে গেলে এঁদের গল্প আপনাকে শুনতে হবে। আমি কোনোদিন এঁদের সেই বুকফাটা গল্প শুনতে চাই নি। আমি এঁদের বন্ধু ও আত্মীয় ভেবেছি, আর সেই কারণে এঁদের গভীর ব‍্যথার জায়গায় খোঁচা দেওয়ার কথা ভাবতে পারি নি।
দিনহাটায় থাকতে পনের আগস্টে নিজের অফিসে জাতীয় পতাকা তোলার পর আমি এঁদের পল্লীতে গিয়ে পতাকা তুলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করেছি, পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
এই মেয়েদের ছেলেমেয়ে হয়। তাদের পিতৃপরিচয় থাকে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় জবালা হয়ে উঠে এঁরা বলেন বহুপরিচর্যা করে পেয়েছিনু তোরে, গোত্র তোর নাহি জানি তাত।
এই মেয়েদের ব‍্যাঙ্কে টাকা জমাবার ক্ষেত্রে বাধা ছিল এই কয়েকটি বছর আগেও। তারপর এঁরা নিজেদের ব‍্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করলেন। সেই প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে আমার নিমন্ত্রণ জুটেছিল।
যে সভ‍্য সমাজ এঁদের পতিতা বলে দাগিয়ে, যারা তাঁকে এই জীবনে ঠেলে দিয়েছে, তাদেরকে চিহ্নিত করে না, সেই সমাজের ভালমানুষিকে আমি ধিক্কার দিই।
এই মেয়েরা নানাভাবে ঠকে। নানাভাবে বঞ্চিত হয়। এদের ওপর নানাবিধ শারীরিক অত‍্যাচারের কথা আমি জানি। পুলিশের কাছে, আদালতের কাছে এদের প্রতিবিধান পাবার অধিকার আছে। অথচ সেই নিয়ে গণতান্ত্রিক দেশটি বহু দোলাচলে ভোগে।  ধরেই নেওয়া হয় এই মেয়েরা বেআইনি পেশায় যুক্ত এবং সেইজন্য ক্রিমিনাল।
অথচ বেশ‍্যাবাড়ি যারা যায়, তারা ভালমানুষের মতো ভোরে বাড়ি ফেরে। তাঁদেরকে পুলিশ তেমন কিছু বলে না। তাঁরা সব অবশ্যই ভদ্রলোক। ধোয়া তুলসীপাতা।
আজও এই মেয়েদের উপর লাঞ্ছনা আর আক্রমণ অব‍্যাহত। সারা পৃথিবী জুড়ে এইসব দ্বিচারিতা চলছে। অনেক মেয়ের গতরবেচা পয়সা স্বামী এসে হাত পেতে নিয়ে যায়। অনেক বাপ প্রতি সন্ধ‍্যায় মেয়েকে সাজিয়ে দিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে বলে। খানকিপাড়ায় ঘুরে ঘুরে আমি এসব অনেক দিন থেকে জানি।
আজ সতেরোই ডিসেম্বর। এঁদের উপর শারীরিক অত‍্যাচারের প্রতিবিধান চাইবার দিন। বিশ্বজুড়ে যৌনকর্মী মেয়েরা এই দিবস পালন করেন।
আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই পাগল ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস স্টার থিয়েটারে চৈতন‍্যলীলা দেখে ভাবে বিভোর হয়ে বলছেন তোদের চৈতন‍্য হোক। না, বিনোদিনীকে নয়, তিনি এই মেকি সমাজের সমাজপতিদের বলছেন, তোদের চৈতন‍্য হোক।
আমাদের সকলের চৈতন‍্য হোক।
মৃদুল শ্রীমানী
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।