গদ্যের পোডিয়ামে অনীশ ঘোষ

শীতের ম্যাজিক –‌ স্পর্শে নতুন প্রেমের
রোমাঞ্চ!

শীতের ম্যাজিক হরকিসিমের। তার ভাঁড়ারে অনেক তাস। সে ভাঁড়ারের ‘ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া’ কিছুতেই শেষ হয় না! সবটুকু উড়াড় করে ঢালামাত্র ফের অফুরান জলে ভরে ওঠে শীতের ঘড়া। সে ঘড়ায় হাজারটা মজা যেন জমিয়ে রাখা। গোটা শীতকালটা জুড়েই ছড়িয়ে থাকে এই মজার ম্যাজিক। সে এক আলাদা রোমাঞ্চ। সে রোমাঞ্চে জড়িয়ে থাকে নতুন প্রেমে পড়ার স্ফূর্তি। এই কয়েকটা লাইন পড়েই হয়ত অনেকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে!‌ তাঁরা বলবেন, আরে মশাই, শীত ভালোভাবে পড়তে না পড়তেই আপনি তার গাওনা শুরু করে দিলেন!‌
শীত কি আজকাল আর তেমনভাবে পড়ে, যে তার ম্যাজিক–মজায় দিব্য কাটবে কটা দিন!‌ হুম, এই অভিযোগ বা ক্ষোভ— পুরোপুরি অস্বীকার করার উপায় সত্যিই নেই! ঠিকই, ইদানীং শীতের আনাগোনা এ বঙ্গে বেশ কমেই গেছে। আসতে যথেষ্ট লেট, কিন্তু যেতে যেন বড্ড তাড়া! মানে, এই যে নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে প্রায় ফেব্রুয়ারির শুরুর সময়কালটা পর্যন্ত টানা মাস তিনেক শীতের মজা লুটবে আপামর জনতা, তার উপায় ইদানীং কমতে কমতে বড়জোর টেনেটুনে মাস খানেকে এসে ঠেকেছে!‌ গ্লোবাল ওয়ার্মিংই হয়ত এর গূঢ় কারণ, কিন্তু আমরা ভেতো বাঙালি ভাই অতশত বুঝি না, কী থেকে কী হয়, আমরা শুধু সেই জন্মতক দেখে এসেছি, শীতের সময় সে থাকবে রাজার মতো রাজ্যপাট বিস্তারের কাজে, যেমন গ্রীষ্ম বা বর্ষাও থাকে, কখনও কম কখনও বেশি— শরৎ বা হেমন্ত চিরকালই ফুস করে আসে আর যায়— কিন্তু শীতের এরকম চরিত্রবদল জাস্ট মেনে নেওয়া যায় না!‌ তুই বাবা আসবি, নিজের মেজাজে থাকবি, দেদার মজা বিলোবি— সে দায়িত্ব বা কর্তব্যবোধ একেবারে ভুলে মেরে দিয়েছিস!‌ ছিঃ ছিঃ!‌
এখন তিনি আসেন ঠিকই, ওই যে খানিক আগেই লিখলাম— মেরেকেটে হয়ত মাস খানেক!‌ মানে উড়ে আসতে আসতে নভেম্বর কাবাড়, আবার কোনওরকমে ডিসেম্বরটুকু শেষ করেই যেতে পারলে বাঁচি!‌ কিন্তু তাই বলে কি শীতের ম্যাজিককে অস্বীকার করার উপায় আছে আদৌ? উপায় আছে তার হরেক মজাকে একেবারে পাত্তা না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে থাকার? শীতকাতুরে বাঙালির সংখ্যা নেহাত কম নয়!‌ শীতে নানা রোগভোগে কাহিল হয়ে পড়েন এমন মানুষজনও যথেষ্ট আছেন, কিন্তু তাঁরাও কেউ শীতের মজা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন না কখনও— এমন প্রমাণ শীতের ঘোর প্রেমিক এই অধম লেখক কোনওদিন পাননি। বরং শীতে হাড়গোড়ে ঠকঠকানি লাগলে কী হবে, আপাদমস্তক গরম কাপড়ে ঢেকে— সে চুলাগ্র থেকে পদনখ পর্যন্ত— দিব্য প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে পড়ছেন, মানে শীতের সকাল চুটিয়েই উপভোগ করছেন, এমন অনেক মানুষকে আমার আশপাশেই দেখে আসছি, অত ঢাকাঢুকি দিয়ে আদতে শরীরের উপকার না হোক, মনের তো হচ্ছে!‌
মানেটা কী দাঁড়াল, শীতপ্রেমী থেকে শীতকাতুরে— কেউ কখনও বলে না, অনেক হয়েছে বাপু, এবার তুমি বিদেয় নাও তো! কী করেই বা বলবে!‌ ওই যে ম্যাজিক!‌ ‌প্যাচপেচে গরম বা জ্যাবজেবে বর্ষায় কখনও কি আশা করা যায়, পিকনিকের প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন! ভাবতে পারেন, সার্কাস বা মেলায় মেলায় নিজেকে মিলিয়ে দেওয়ার কথা? মোয়া, পাটালি, ঝোলা গুড়, নলেন গুড়ের পায়েস, পিঠে, মুড়কি চাখার কথা? এ সব ভাবা যায় গ্রীষ্ম–বর্ষায়? হ্যাঁ, ফুলকপি–বাঁধাকপি–বিট–গাজর বা মটরশুঁটির জোগানের ব্যাপারটা এখন সর্বঋতুকালীন!‌ সৌজন্যে, হিমঘর!‌ সওদাগরদের দৌলতে এখন প্রায় গোটা বছরই কপি, শুঁটি, গাজরের চালান অমিল নয় বাজারে! বিট বা পেঁয়াজকলি, শিম ইত্যাদি কিছু কিছু সবজি অবশ্য এখনও এই তালিকায় এন্ট্রি পায়নি। কিন্তু বাকিদের তো অনেক দিন হল নাম লেখানো হয়ে গেছে! ফলে, ভোজনরসিক বাঙালির রসনার সেবায় তাদের প্রাণ নিবেদনেও এতটুকু খামতি নেই বছরভর। ঠিকমতো পকেট উজাড় করতে পারলেই নিউমার্কেট থেকে নিউব্যারাকপুর, বালিগঞ্জ থেকে বারাসাত, টালা থেকে টালিগঞ্জ, মানিকতলা থেকে মানকুণ্ডু— সর্বত্রই বাজারে তাদের নিয়মিত আনাগোনা, আর সেখান থেকে ভোজনবিলাসীদের পাতে। শিশিতে ভরা অসময়ের মটরশুঁটি বাড়তি পুলক জোগায় সমর্থ পরিবারের ব্যঞ্জনে। তা দেখে অপারগদের ঈর্ষার টাটানি পাকিয়ে উঠলেই বা কী! ব্যবসার মগজকে গুরুত্ব দেবেন না মশাই! আর কতদিন ‘রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি’র প্যানপ্যানানি চলবে বলুন তো! করোনার আতঙ্ককে সপাটে ছক্কা মেরে মাঠের বাইরে উড়িয়ে দিয়ে লকডাউনের সময় বাজারঘাটে থলি বাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া বাঙালির সক্কলেই কি আপনার চোখ এড়িয়ে গেল মশাই!‌
এবার বোধহয় লিমিট ক্রস করা হয়ে যাচ্ছে, না?‌ ধান ভানতে শিবের গীতের মতো কান ভাঙাতে শীতের গীত বড্ড বেশি গাওয়া হয়ে যাচ্ছে!‌ সত্যিই কি?‌ মানে, শীতের ম্যাজিকের প্রসঙ্গ তুলে ডজ করতে করতে মাঠের বাইরে, মানে অন্য প্রসঙ্গে ঢুকে পড়া। সত্যি, এটা নেহাতই ফাউল!‌ ইয়োলো বা রেড কার্ড তুলে ধরতে পারেন কোনও রেফারি, থুড়ি, পাঠক–‌পাঠিকা! সরি, সরি, তোওবা তোওবা! এবার একটু সোজা বাংলায় ফিরি, মানে, শীতের ম্যাজিক বা মজা নিয়ে সত্যি সত্যিই কিছু দরকারি কথা সেরে নিই। কেননা, তিনি যখন এ বছর ইতিমধ্যে আসছি আসছি না— এমত দোটানায় থেকে শেষমেশ এসেই গেছেন সশরীরে— ভোর বা বেশি রাতের দিকে মাঝে মাঝে হামাগুড়ি দিয়ে বিছানায় সেঁধিয়েও যাচ্ছেন, গুঁটিসুঁটি মেরে হালকা হলেও একটা গরম ঢাকনা টেনে নেওয়া শুরু করে দিয়েছেন অনেকেই— তখন নিজেদের মধ্যে একটু শেয়ার করা যাক শীতবাসনা বা শীতোন্মাদনার ম্যাজিক প্রসঙ্গ।
হ্যাঁ, বাঙালি এখন গ্লোবাল হতে শিখেছে। ভরা শীতেও কনকনে শীতের দেশে বউকে বগলদাবা করে বাড়তি মজা লুটতে পাড়ি দিতে শিখেছে। সে শুধু শীতে হিট ন্যাশনাল পাহাড়ি এলাকা দার্জিলিং, গ্যাংটক, মুসৌরি, দেরাদুন বা সিমলা, শিলং নয়, উড়ানে চেপে সীমানা ছাড়িয়ে ইন্টারন্যাশনাল ডেস্টিনেশন মরিশাস, সিঙ্গাপুর, প্যারিস, এমনকি আল্পসের দেশেও! তবে অধিকাংশ বাঙালি এখনও খোলস ছেড়ে উঠতে শেখেনি, এটাও ঠিক। শীতে বড়জোর একবেলার পিকনিক, একটু বইমেলা, খানিকটা চিড়িয়াখানা, খুব বেশি হলে উইক এন্ডে কাছেপিঠে দীঘা, বকখালি বা মন্দারমণি— এর বেশি এগোতে কেমন যেন দ্বিধা দ্বিধা ভাব!‌ পাহাড়? উরি বাব্‌বা! সমুদ্র তবু ঠিক আছে, কিন্তু ঠান্ডায় পাহাড়! এমনিতেই শীত ঠিকমতো পড়ল কী পড়ল না, সামান্য উত্তুরে হাওয়ার আভাস পেলেই পুলওভার–মাফলার–মোজা–টুপিতে ঢেকে ফেলে স্বশরীর, রাত পড়তে না পড়তেই সোজা লেপের আড়ালে, সেই বাঙালি পোলাপান নাকি শীত কাটাতে যাবে পাহাড়ে! অমন জঙ্গিপনা বাঙালির ধাতে সয় না ভাই জানি! তাই ওতে আমরা নেই। তবে হ্যাঁ, অনেকেই আবার আছেনও। তাঁদের জন্য হাজারটা মজা নিয়ে, ম্যাজিক নিয়ে শীত অপেক্ষা করে সেখানে বরফপাতের উন্মাদনা নিয়ে। ক্রিসমাস কার্নিভালের মজা চুটিয়ে উপভোগ করতে তাঁরা সিমলা পাহাড়, শিলং পাহাড়েও চলে যান সব সব দ্বিধা কাটিয়ে। এই সাহস, এই তেজের জন্যে শীতও তাঁদের প্রাণ ভরে উপহার দেয় বরফছোঁয়ার মজায় মাখানো মেঘ–রোদের লুকোচুরি খেলায় শরীর ডুবিয়ে অবগাহন–‌ম্যাজিক!
শীতের দেশের কথা যখন উঠলই, চুপি চুপি জেনে রাখুন, ঠান্ডার দিনে ঠান্ডা এলাকায় আলাদা মস্তি। একটিবার অন্তত পরখ করে দেখার জন্য নিতান্ত ভদ্রলোকের মতোই সুপরামর্শ দিচ্ছি, অধিকাংশ বাঙালির মতো শীতকাতুরে স্বভাবটা আষ্টেপৃষ্টে শরীরে জড়িয়ে না রেখে সাহসে বুক বাঁধতে হবে। বরফে যুগলে স্কি, স্কেটিং, ট্রেকিং বা হোটেলের ঘরে ফায়ার প্লেসের সামনে রেড ওয়াইনের মাগ হাতে নীচু স্বরের বব ডিলান— জাস্ট ভাবা যায় না! তবে ওই যে, শীতের জুজুর ভয়ে জবুথবু হয়ে থাকা ব্যাপারস্যাপারগুলো থেকে আগে মন থেকে শত গজ দূরে তাড়াতে হবে। এও কিন্তু শীতের একটা বড় ম্যাজিক! আরও ম্যাজিক ঠাওর করবেন, হাফ দামে সুপার কোয়ালিটি হোটেল, ভাল খানাপিনা, অনেক কম ভাড়ার গাড়িতে সওয়ার হয়ে শীতের দেশ চষে বেড়ানোর সময় যখন পকেট যথেষ্ট সামলে দিতে পারবে!
তবে বিদেশফিদেশ নিয়ে বেশি কচকচানি ভাল নয়। স্বদেশপ্রেমের খামতি নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন উঠে যেতে পারে! আর এ দেশেই যখন কাশ্মীর আছে (‌ব্যথাও আছে ইদানীং)‌, হিমাচল আছে, আছে উত্তরাখণ্ড, মেঘালয়–‌অরুণাচলও আছে, এমনকি আছে উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং–কালিম্পং! এদের কেউই কিন্তু কম যায় না শীতের জমাটি গন্তব্য হিসেবে। ম্যাজিক–‌পাহাড় হিসেবে! আপনি ঠিক করুন ভাই, শীতে ঘরে বসে জুজুর গীত গাইবেন, নাকি পাহাড়ে চড়ে অচেনা–অজানা ম্যাজিক দেখতে দস্যি হবেন! আমরা বরং খানিক স্বভূমি, আরও স্পষ্ট করে বললে গ্রামমুখী হই এবার। গ্রাম দিয়েই এ দেশ, মানে বড় বড় শহর ঘেরা! গ্রামনির্ভর ভারতে গ্রামীণ সংস্কৃতি, গ্রামীণ অর্থনীতি, গ্রামের মানুষজনকে হেলাফেলা করলে চলে!‌ আর শীতকালের গ্রাম্য পরিবেশ নিয়ে কথা উঠলে অবশ্যই চলে আসবে এই সময়ে গ্রামে–গ্রামে অনুষ্ঠিত নানান প্রচলিত, ঐতিহ্যবাহিত উৎসব ও মেলার প্রসঙ্গ। পৌষ পড়তে না পড়তেই সেই সব মেলা–উৎসবের ঢল লেগে যায় এ দেশে, বিশেষত এই বঙ্গে। রাসমেলা, পৌষমেলা দিয়ে শুরু। তার পর একটার পর একটা— বাউল ফকির উৎসব, কেঁদুলি, গঙ্গাসাগর, বিষ্ণুপুর, টুসু থেকে নানাবিধ। শহরেও আছে— সিনেমা মেলা, বইমেলা। মেলা আর মেলা, নানা নামে, নানা স্থানে। গ্রামীণ বা আধা–শহর, গঞ্জের মেলায় বড় আকর্ষণ আবার মেরি গো রাউন্ড, সাদা বাংলায় নাগরদোলা, সঙ্গে কথা বলা পুতুল, ভিডিও শো, ম্যাজিক শো এবং অবশ্যই পাঁপড়, জিলিপি, চিনেবাদামের চিরন্তনী নস্টালজিক ম্যাজিক!
মেলার মজার ফিরিস্তি অনেক লম্বা। সবই তো জানা আছে, বেশি বকবকানির দরকার কী! বরং শীতের অন্য মজায় ফেরা যাক। মানে, শীতের অন্যান্য ম্যাজিকে! আশপাশে একটা বেলা সদলবলে চড়ুইভাতি, সপরিবার উইক এন্ড একটু দূরে কোথাও, কিংবা বেশ কয়েকদিনের জন্য প্যাঁটরা গুটিয়ে খানিক দূরে ছুটি কাটাতে ছুটে যাওয়া— এ হল শীতের উপরি পাওনা, এ কথা কি আর নতুন করে লিখে বোঝাতে হবে! বিশেষ করে যখন অফিসের খাতায় কিছু সি এল/ই এল ডিউ থেকে গেছে, ছেলেমেয়েদের ফাইনাল এগজাম শেষ (‌এবার যদিও করোনা–‌আবহে সব কিছুই গোল্লা পাকিয়ে গেছে, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের উৎসবমুখর দিনগুলো এবার হয়ত সেভাবে দরজায় কড়া নাড়বে না, চারদিকে ফেস্ট ফেস্ট সুবাতাসে কেমন যেন পানপরাগের নোংরা দাগ লেগে গেছে, কিন্তু আমি বলতে চাইছি সাধারণার্থে অতীত–‌ভবিষ্যতের কথা‌)‌, তখন বাড়ি থেকে পালিয়ে (‌বেরিয়ে)‌ অন্য কোথাও অনেকে মিলে ক্যাম্প ফায়ারের ম্যাজিকে মেতে ওঠা আউটিংয়ের কথাখান!‌
আরও বাকি থাকল। মনের সুখে পেটপুজোর কথা!‌ শুঁটি কিংবা কপির কথা আগেই বলে ফেলেছি। চালানি ব্যবসার দৌলতে ওগুলো এখন বছরভর পাতে পড়তেই পারে। কিন্তু শীতের দিনে এদের সোয়াদ পাল্টে যায়, সোজা মাঠ থেকে বাজার হয়ে পাতে চলে আসে বলে। ফলে থলে ভরে নাও আর বাড়ি গিয়ে খাও! শীত কেটে পড়লে তো ফের সেই কুমড়ো–বেগুন–উচ্ছে–পটল!
মোয়ার কথা অন্তত একবার তোলা উচিত। জয়নগরের ব্র‌্যান্ড নেমের ফাটাফাটি গুডউইলের দৌলতে মেড ইন বনগাঁ–বারাসাত–শ্রীরামপুর–বর্ধমানও আজকাল দিব্যি ওই জয়নগর বনে যাচ্ছে যদিও! ‌তাতে বিকোয় ভাল। নলেন গুড় কথা, পাটালির কথাও বলি। একেবারে গাঁ–গঞ্জ থেকে সে সব সিজনাল ভোগ্যবস্তু হিসাবে কটা দিনের জন্য চলে আসে শহরের বাজারে। তার পরই ফুড়ুৎ। বাকি সময় কটা দিন তালপাটালি থেকে শেষ পর্যন্ত বছরের বাকি সময় তো শুধুই আখের আর ভেলি গুড় ভরসা। ইস, দুটো এক হল!
শীতের পৌষপাবনের জুটি হিসেবে পিঠেপুলিতেও কি কম ম্যাজিক! বাড়িতে ঝক্কি পোহাতে না চাইলেই বা কী, শহুরে মেলাতেও এখন দিব্যি মেলে পাটিসাপটা, রসপুলি, সরু চাকলি থেকে নানান পিঠে, তাদের ফিউশনও! এগুলো এখন হিট বিজনেস আইটেম। একক মালিকানা থেকে ফ্র‌্যাঞ্চাইজি মালিকানাতেও তাই এখন দিব্য মেলে মেলায় মেলায়, উৎসবের মাঠে, শহুরে স্টলে। এ সময়েই তার সোয়াদ চেখে নেওয়া যায়। শীত ফুরোলেই সব ভোঁ ভোঁ!
অনেকক্ষণ খাওয়াদাওয়া নিয়ে হেজিয়ে গেলাম। ম্যাজিকের অন্য দিকগুলোও একবার দেখে নেওয়া যাক। যতই সারা বছর দরজা খোলা থাক, ভাবুন তো একবার, গরমে বা বর্ষায় চিড়িয়াখানা, ইকো পার্ক, নিকো পার্ক, সায়েন্স সিটি, ভিক্টোরিয়া, বোটানিক্যাল গার্ডেন একটুও জমে? কিন্তু শীত পড়লে? জাস্ট ফাটাফাটি! দু–চারবার ঘুরে আসলেও নো এনার্জি লস!‌ ছেলেপুলেদের নিয়ে ফুল ফ্যামিলি মস্তি যাকে বলে! আর কাছেদূরের হাজারটা পিকনিক স্পট তো আছেই। শীত সিজনে ফ্যামিলি, পাড়াতুতো ক্লাব, অফিসের রিক্রিয়েশন ক্লাব বা বিজনেস রিলেশন মিলিয়ে–টিলিয়ে একাধিক চড়ুইভাতি অনায়াসে হয়েই যেতে পারে। আরও আছে। সার্কাস। টালা কিংবা সিঁথি বা পার্ক সার্কাসের মাঠে ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে এ সময়েই কোথাও একটা সার্কাসের তাঁবু পড়তেও পারে। যদিও সেই রমরমা আর নেই সার্কাসের। বাঘ–সিংহের বিদেয় ঘটেছে, প্রাণিকুলকে নিয়ে বিজনেস করতে গেলে বন দপ্তর কেস ঠুকে দেবে, কিন্তু জোকাররা তো আছে, আছে সুন্দরীদের মনোরম ট্রাপিজ–‌ঝাঁপ, জরিদার পোশাকের ছেলেমেয়েরাও আছে নানান শারীরিক কারুকাজ নিয়ে। কেউ ফ্যালনা নয়। ফলে সার্কাসের তাঁবু পড়লে শীতের একটা সন্ধেয় স্ফূর্তির ঠিকানা তো সেটা হতেই পারে। গোটা সন্ধেটাই ফুরফুরে মজা সাপ্লাইয়ে ওদের জুড়ি নেই। এ সবই তো বাহারি শীতের ম্যাজিকের এক–একটা পার্ট! বারো মাসের তেরো পার্বণের মতো যে কোনও মেলাকেও দিব্যি ফিট করে দেওয়া যায় এই শীতের সময়— সে বইমেলা থেকে টেক্সপো–লেক্সপো–হস্তশিল্প থেকে বিদ্যাসাগর, গঙ্গাসাগর সব! সব মিলিয়ে দিনগুলো এ সময় যেন সোনার খাঁচাতেই ফিট হয়ে থাকে! সোনার খাঁচা কেন বাবা? না, আসলে তো আমরা কর্তব্য পালনের নামে এক প্রকার খাঁচায় বন্দী জীবনযাপনের দাসানুদাস, তো এর মধ্যে বছরের অন্য ঋতু হল লোহার খাঁচা, আর এই শীতকালটা হল সোনার খাঁচা, তাই আর কী!
শীত নিয়ে এটা কি খুব বড় কমপ্লিমেন্টারি হয়ে গেল? মনে হয় না! কবিরা যদিও শীতের থেকে বর্ষা আর ফাল্গুন, মানে বসন্তকে নিয়ে বেশি শব্দ খরচ করেছেন, কিন্তু শীতকে পুরো অবহেলা করে গেছেন, তা তো বলা যাবে না। ‘শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আম্‌লকির এই ডালে ডালে।/পাতাগুলি শির্‌শিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে।।/উড়িয়ে দেবার মাতন এসে কাঙাল তারে করল শেষে,/তখন তাহার ফলের বাহার রইল না আর অন্তরালে।।/শূন্য করে ভরে দেওয়া যাহার খেলা/তারি লাগি রইনু বসে সকল বেলা।।/শীতের পরশ থেকে থেকে যায় বুঝি ওই ডেকে ডেকে,/সব খোওয়াবার সময় আমার হবে কখন কোন্‌ সকালে।।’ রবি ঠাকুরই বলে গেছেন শীতরহস্যের কথা। যে শীত শূন্য করেও ভরে দিয়ে যায় প্রাণ, তার ম্যাজিক দিয়ে। ‘হিমের বাহু বাঁধন টুটি পাগ্‌লাঝোরা পাবে ছুটি,/উত্তরে এই হাওয়া তোমার বইবে উজান কুঞ্জ ঘেরি।।/আর নাই যে দেরি নাই যে দেরি।/শুনছ না কি জলে স্থলে জাদুকরের বাজল ভেরী।’ তিনি পৌষের ডাক শুনতে পান, শুনতে পান ম্যাজিক মাদল। আমরা তো সকলেই মনে মনে কবিই, আমরাও তাই কবিগুরুর এই অনুভূতিকে নিজের মতো করে স্পর্শ করি। শীতের মজার সঙ্গে একাত্ম হই। ছক বাঁধা জীবন ছেড়ে কটা দিন, কিছু সময়, কয়েকটা মুহূর্ত একটু অন্যরকম হয়ে ওঠার চেষ্টায় মন দিই। এটাই তো শীতের আসল ম্যাজিক! বর্ষা নিয়ে কাব্য লিখি, আর মজায় মাতি শীত নিয়ে। আমরা অপেক্ষায় থাকি, শীতই পথ দেখিয়ে নিয়ে আসবে বসন্তকে… প্রেমের রঙমশাল, জয় হো! বসন্তের হাত ধরেই একে একে এসে যাবে ভ্যালেন্টাইনস ডে, সরস্বতী পুজো, দোল… সে এক তুমুল মজার লং জার্নি! তার পর আবার তো সেই খোঁয়াড়ে ঢুকে পড়া!
যাক, বসন্তের গল্প পরে হবে। আজ তার গল্প নয়, আজকের গল্পে শুধু শীত। কিন্তু এই গল্পে আততায়ীর মতো ঢুকে পড়েছে করোনা বা কোভিড ১৯!‌ সে তো নিশ্চয় একদিন হার মানবেই, তাকে তেপান্তরের মাঠ পার করে দিয়ে আমরা বরং চলুন, কোনও সার্কাসের তাঁবু বা মেলার মাঠে ঢুকে পড়ি, হাতে থাক মোলায়েম মোয়ার ঠোঙা, বাড়ি ফিরে সবাই মিলে ডিনার টেবিলে আজ শুধুই পাটিসাপটা, পুলি পিঠে! নতুন গুড়ের সন্দেশ, রসগোল্লা!‌ জম্পেশ খানার পাশাপাশি একটা প্ল্যান হয়ে যাক না হয়, কটা দিন আউটিংয়ের— ডেস্টিনেশন সম্পূর্ণত আপনাদের পছন্দের!‌ পাহাড়‌ একটু বাড়াবাড়ি মনে হলে না হয় সমুদ্রই হয়ে যাক! এই শীতে তাতেও ম্যাজিক।‌ বাড়তি পাওনাও কিন্তু আছে!‌ ভেবে দেখবেন, প্যাচপেচে গরম বা জ্যাবজেবে বর্ষা নয়, শীতকালটাই কিন্তু দীর্ঘদিনের দাম্পত্য বা পুরনো প্রেমে নতুন রঙ লাগানো আবহাওয়াগতভাবে বেশি উপাদেয়!‌ প্রথম প্রেমের রোমাঞ্চর মতোই যা ‌অনুরাগপুষ্ট, স্পর্শকাতর, উন্মাদনাময়!
শীতকাল দীর্ঘজীবী হোক।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।