আজকে গ্যারেজে ঢোকার সময় নজরে এলো ব্যাপারটা।
জয়ন্ত একটা মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির টপ্ বস হলে কি হবে,গল্পের বই এর নেশা এখনো ছাড়তে পারেনি।কাল অফিস ফেরত কলেজস্ট্রীট থেকে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ” শ্রীকৃষ্ণের শেষ কটা দিন” কিনে ঘরে ঢুকেছিল,অবশ্য ঘরে বলাটা ভুল, তা হলে তো ল্যাঠা চুকেই যেতো,ঢুকেছিলো গ্যারেজে গাড়ি রাখতে।বইটা বের করে সেই যে গাড়ির বনেটের ওপর রেখেছিল, তারপর বেমালুম ভুলে গেছিল।
জয়ন্ত আজীবন বইপাগল,বিশেষ করে বাংলা বইএর পোকা।ইংরাজি বা অন্য বিদেশী বইএর ইংরাজি অনুবাদ যে পড়েনি তা নয়।পুরোনো ক্লাসিক ইংরাজি বই তার প্রায় সবই পড়া,ইদানীং বিশেষ পড়া হয়না।তবে হ্যাঁ বাংলা বই বলতে গেলে কি পুরোনো কি নুতন ভালো ভালো বই সব গুলে খাওয়া।সে উপন্যাসই হোক্ বা অন্য কিছু।
আজ ছুটির দিন, গাড়িটা একটু পরিষ্কার করবে বলে গ্যারেজে ঢুকে দ্যাখে বইটা বনেটের ওপর শুয়ে আছে পরম নিশ্চিন্তে।তখনই মনে পড়লো বইটার কথা,অথচ কাল অফিস থেকে আসার সময় আরতি অর্থাৎ তার বৌকে স্প্ল্যানেডের একটা পার্লার থেকে পিক আপ করে এনেছিলো।দু দু জোড়া চোখকে ফাঁকি দিয়ে বইটা সারারাত ঘুমিয়ে রইলো গাড়ির বনেটের ওপর,একবারের জন্যও কাল রাতে মনে পরলো না?
কাজে কাজেই জয়ন্তর সব কাজ শিকেয় উঠলো,বইটা নিয়ে ঘরে ঢুকেই হাঁক ছাড়ে – “আরতি,আরতি,দেখো বইটা কাল সারারাত গ্যারেজেই পরে ছিলো,একদম ভুলে গেছিলাম। তুমিও খেয়াল করনি? বইটা ফেলে এসেছিলাম?দেখতে পাওনি?”
” আমার দেখার কথা?আর দেখলে তো নিয়েই আসতাম।তাছাড়া তোমার পার্সোনাল লাইব্রেরির যত বই আছে সে সবে আমাকে হাত দিতে দাও?কি না,আমি বই উল্টো পাল্টা করে রেখে দেবো! মাঝেমধ্যে এটা সেটা তোমাকে বলে নিয়ে পড়ি ঠিকই,কিন্তু ঐ পর্যন্তই।মনে নেই একবার সেই ‘পাঞ্চজন্য’ বইটা পড়ে বিছানায় রেখে ঘুমিয়ে গেছিলাম বলে,প্রায় মাঝরাতে আমার ঘুম ভাঙিয়ে বইটা লাইব্রেরিতে রাখতে পাঠিয়েছিলে? মনে নেই? যাক্ পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই।কি বই ওটা?”
“সঞ্জীব বাবুর ‘ শ্রীকৃষ্ণের শেষ কটা দিন’।ভালো বই,পড়ে দেখো।”
বইটা আরতির দিকে বাড়াতে গিয়ে বই থেকে একটা চিরকুট টুক্ করে মেঝেতে খসে পড়ে যায়।জয়ন্ত চিরকুটটা কুড়িয়ে নিয়ে দ্যাখে তাতে লেখা – ‘ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি’। অপ্রস্তুত আটান্ন বছরের জয়ন্ত ভট্টাচার্য একটু ঘাবড়ে গেলো,একটু রক্তিম মুখ করে বলে ” এ এ এটা কি আরতি? আর বইএর মধ্যে এলোই বা কি করে,আর কেই বা লিখেছে? আমি তো মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতেই পারছিনা।কি যে সব কান্ড।” বলে চিরকুটটা আরতির দিকে এগিয়ে দ্যায়।
অদ্ভুত একটা হাসি হাসি মুখ করে
আরতি চিরকুটটা নেয় তারপর বলে” তোমার ভয় নেই,ওটা আমারই লেখা।”
” তোমার?” অবাক চোখে জয়ন্ত তাকিয়ে থাকে তার সাতান্ন বছরের স্ত্রীর দিকে।” কিন্তু কেনো?”
” তুমি তো এই ক’ বছরে আমার অনেক কিছুই ভুলে গ্যাছো দেখছি অথচ কলেজ লাইফে আমার থেকে আমার হাতের লেখার প্রেমে তো তুমি বেশী পড়েছিলে।মনে নেই? না কি তাও ভুলে মেরে দিয়েছো? ”
এবার একটু ধাতস্থ হয়ে জয়ন্ত বলে ” বেশ করো তুমি,মুখে বললেই তো হোতো,তা না করে এতো নাটকীয়তার কি দরকার ছিলো? যেই আমি বইটা ভুলে গেছি ওমনি টুক্ করে চিরকুটটা চালান করে দিলে?”
” কি করবো বলো? আমাকে ভুলতে পারে,কিন্তু বইকে ভুলতে পারো? লেখাটা আমি ব্যাগে নিয়েই ঘুরছি ক’ দিন।তবে দিতে কেমন সংকোচ হচ্ছিল” আরক্ত আরতি বলে।” তবপ কাল যখন বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লোই তখন একটু নাটক করার লোভ সামলাতে পারলাম না।চিরকুটটা চালান করে দিলাম বইএর মধ্যে, তোমার ঘাবড়ে যাওয়া মুখ দেখবো বলে।ভেবেছিলাম আমার হাতের লেখাটা অন্ততঃ ধরতে পারবে।ও হরি,দেখি সবই ভুলে মেরে দিয়েছো।মুখে যে বলবো,তা কখন বলবো শুনি? তোমার শোনার সময় কোথায়?কতটুকু কথা হয় আজকাল আমাদের মধ্যে সারাদিনে? দেখাই বা হয় কতটুকু? দিনের বেলায় ছেলে, বৌমার কান এড়িয়ে বলা যায়না,আর রাতে তো বইমুখেই বসে থাকো।তখন কোনো কতা কানে ঢোকে তোমার?”
মুখে একটু প্রশান্তির হাসি নিয়ে জয়ন্ত বলে” কিছুক্ষণের জন্য হলেও বেশ ঘাবড়ে দিয়েছিলে আমাকে।তবে তুমি পারোও বাপু।একেই বলে বুড়ো বয়সের ভীমরতি।”
” না না কি বলছো? আমিও একটু আধটু বাংলা জানি মশাই।আরে বাবা জয়ন্ত তো ভীমেরই আর এক নাম,আর আমি আ বাদ দিয়ে রতি।কাজেই ভীম- রতি তো এখন ধরেনি,সেই কলেজ লাইফ থেকেই তো আমাদের ভীম- রতি র শুরু।কি বলো গুরু?”
দুজনেই চাপা হাসিতে ফেটে পড়ে।।