রিং টোনের কর্কশ আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেলো! সেলফোনটা সোচ্চারে জানিয়ে দিল ছটা বেজে গেছে। মিষ্টি গান বা মিউজিকে আমার ঘুম ভাঙেনা অগত্যা..
মনে হয়, সেই ছোটবেলায়, বাবার রেডিও তে গান বাজছে আর মা স্নান সেরে নিত্য পূজোয় বসে গুনগুনিয়ে শ্রী কৃষ্ণের শতনাম পড়ছে।
নাঃ! এখন বসে ছোটবেলার কথা ভেবে সময় নষ্ট করলে কপালে আছে! একেই শীতের সকাল সময়ের নাগাল পাওয়া দুষ্কর। আর মুস্তাক কাল শোয়ার আগে বলেই রেখেছে,সকাল আটটার মধ্যে বেরবে, জরুরী কাজ আছে।
আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি নিয়মিত। ওজু করে নিজের আসনটা পেতে নামাজ আদা করলাম, মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এলো।
এবার প্রাত্যহিক কাজ শুরু। গরম চাদরটা জড়িয়ে নিয়ে কিচেনের দিকে এগোলাম। দুধ,চিনি ছাড়া লিকার চা! এই সকালের চা আমার হাতেই খেতে পছন্দ করে মুস্তাক। বাসিমুখে চা খেয়ে বিছানা ছাড়বে এই এক বদভ্যাস!
এরপর নওয়াজ মানে আমার ছোটছেলেকে ওঠাতে হবে ঘুম থেকে! সে এক ঝকমারি! অনেক রাত পর্যন্ত পড়বে আর সকালে উঠতে চাইবেনা। মোটে বারো বছর বয়স ক্লাস সেভেনে পড়ে ইংলিশ মিডিয়াম। পড়ার খুব চাপ।
জানালার ভারী পর্দা সরাতেই পুবমুখী ঘরটা আলোয় ভরে গেলো, ছেলে বিরক্ত হলেও বিছানা ছাড়লো না, ওপাশ ফিরে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুলো। রোজ এই পর্ব চলে।
দশটা নাগাদ একটু ফাঁকা হলাম। মুস্তাক বেড়িয়ে গেছে আটটার আগেই। নওয়াজ সাড়ে নটার মধ্যে বের হয়ে গেলো। আজ স্কুল বাসেই যাবে বড় গাড়িটা নিয়ে ওর আব্বা বেড়িয়েছে। আজ ড্রাইভার আসেনি তাই ছোট গাড়িটা ও অকেজো ।আমি তো অকর্মার ঢেঁকি! কিছুই পারিনা। মুস্তাক কতদিন বলেছে ড্রাইভিং শিখতে, তাহলে এদিক ওদিক যেতে পারবো! আমার ইচ্ছে করেনা কোথাও যেতে। এই চার দেওয়ালের মধ্যে বেশ আছি।
আজকের রান্নার মেনুটা, রাধুঁনি আমিনাকে ভালো করে বুঝিয়ে ঘরে এলাম। অন্যদিন দু একটা ওদের পছন্দের পদ নিজে হাতে রাঁধি। আজ মুস্তাক ফিরবেনা, তাই আমিনা যা পারে রাঁধুক।
এগারোটা বেজে গেলো। আমার বড়ছেলে আকাশ এই সময় রোজ একবার ফোন করে। ও জানে আমি এসময় ফাঁকা থাকি। বুঝদার ছেলে। দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেলো। গত বৈশাখে বাইশে পা দিল। দুর্গাপুরে ইন্জিনিয়ারিং পড়ছে, এবার ফোর্থ ইয়ার।
ফোনটা বাজলো আমি ঘরে ঢুকতেই। নাঃ আকাশ নয় অচেনা নাম্বার! দোনোমোনো করে ফোনটা ধরেই ফেললাম। গলাটা চেনা লাগলো। ভবানীর গলা! ভবানী মানে আমার প্রাক্তন শাশুড়ী!
নিরুত্তাপ গলায় বললেন, “স্বপন আর নেই!” আজ ভোরে মারা গেছে! উনি আকাশকে জানিয়েছেন। গতবছর ও যখন জলপাইগুড়ি গিয়েছিল, তখনই উনি আমার আর আকাশের নাম্বার রেখেছিলেন।
লিভার ড্যামেজ হয়ে গিয়েছিল, কিডনির সমস্যা ছিল আরও অন্যান্য অনেক রোগ বাসা বেঁধেছিল স্বপনের শরীরে। দীর্ঘদিনের অত্যাচারের প্রতিশোধ শরীর, সুদেআসলে আদায় করেছে। কাজেই খবর টা অপ্রত্যাশিত ছিলনা, অপ্রত্যাশিত ছিল ভবানীর ব্যবহার! অবাক হয়ে ভাবছিলাম, একমাত্র ছেলের সদ্য মৃত্যুর পর মানুষ টা এতো কথা গুছিয়ে বলছেন কি করে! যদিও দুটি বিবাহিতা মেয়ে আছে তার। তাদের সাথেও বিশেষ সম্পর্ক নেই।
এই মানুষটিকে আমি বুঝে উঠতে পারিনি ন-দশ বছর একসাথে থেকেও। উনি বোধহয় নিজেকেই শুধু ভালোবাসেন।
স্বপনকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম। তখনও আমি রেহানা হইনি, আমি তখন সনকা মন্ডল। নিমাই মন্ডলের আদরের ছোট মেয়ে। তিনবোন দুভাইএর সক্কলের ছোট হওয়ায় আমার আদর একটু বেশিই ছিল। সেটাই কাল হয়েছিল।
ছোট থেকেই বাড়ন্ত গড়ন আমার, দেখতে শুনতেও মন্দ ছিলামনা। গায়ের রংটা দিদিদের তুলনায় কটাই ছিল। নাক,চোখ,এক ঢাল চুল সব মিলিয়ে আলগা চটক ছিল, নজরে পড়তাম সহজেই। দিদিদের বিয়ের সম্বন্ধ এলে,মা আমায় বেরোতে দিতেন না।
স্কুলেও ভর্তি হয়েছিলাম। ক্লাস সেভেনের বার দুয়েক ফেল করে পড়াশোনা তেমন না এগোলেও স্বপনের সাথে মন দেওয়া নেওয়া এগিয়েছিল যথেষ্টই।
শ্যামলা, ছিপছিপে টিকালো নাক,মোটামুটি সুদর্শন স্বপন তখন আমার চোখে সলমান খান! সাইকেলে চেপে স্কুলের সামনে আসতো। তখন সদ্য ‘ম্যায়নে প্যার কিয়া” দেখেছি, হিন্দি সিনেমার পোকা আমি। জীবনটা তখন রঙিন!
বাইশ-তেইশের স্বপন তখন কমলাপুর চা বাগানের মাল তোলার ছোট ট্রাকের ড্রাইভার! ওর তর সইছিল না,আমারও। একদিন এক কাপড়ে ঘর ছাড়লাম, বয়স তখন মাত্র ষোল! মন্দিরে বিয়ে করে সেদিনই ওর বাড়ীতে নিয়ে ওঠালো স্বপন।
ওর মা ভবানীকে দেখে সেদিন অবাক হয়েছিলাম,ভাবলেশহীন! এতোবড় কান্ড হল।অথচ কি নির্বিকার তিনি!
ছোট ছোট দুটো বেড়ার ঘর। মেঝেটা পাকা। তারই একটায় সংসার পাতলাম। শাশুড়ীর পুরোনো একটা শাড়ীতেই আমাদের প্রথম রাত কাটলো। না বধূবরণ হল,না মঙ্গল শঙ্খ বাজলো! সিনেমার সাথে মিললো না। ষোলতেই সারকথা বুঝলাম জীবনটা সিনেমা নয়!
প্রথম রাতেই ঝাঁপালো স্বপন! অসহায় শিকারের ওপর ললুপ শিকারীর মতো।
মিলন যে কেবল মধুর হয়না, যন্ত্রণারও হয় টের পেলাম প্রথম রাতেই! সিনেমায় সলমান, করিশ্মা কাপুরকে কেমন আলতো কিরে চুমু খেতো,দেখে ভালো লাগায় শিউরে উঠেছিলাম আর স্বপন দাঁত বসাতো গোটা শরীরে, যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠতাম! যাচ্ছেতাই গালি দিত বেশী আওয়াজ করলে! মতের অমিল হলেই চোরের মার মারতো। তখনো নতুন বিয়ের গন্ধ যায়নি শরীর থেকে।
দু মাসের মাথায় আকাশ পেটে এলো, তখনও রেহাই ছিলনা এক রাতের জন্যেও! চরম ভুল যে আমি করে ফেলেছি, বুঝেছিলাম বিয়ের কদিন পরেই।
শাশুড়ি মানুষ টি মোটেও সুবিধের নন। রাত হলেই পাশের ঘরে মদ-মাংসের মোচ্ছব লেগে যায়।শাশুড়ি নিজেই সব যোগান দেন। কেউ কেউ থেকেও যায় রাতে। পাশের ঘর থেকে শোনা যায় শিৎকারের শব্দ ! কানে আঙুল দিতে হয়।
শ্বশুর ! থাকা না থাকা সমান! আমি কখনো সজ্ঞানে দেখিনি তাকে। সারাদিন নেশা করে বারান্দায় এক কোনে পরে থাকেন, দুটো পেটে পড়লেই সন্তুষ্ট!
এ বাড়ীতে ঠাকুরঘরের অস্তিত্ব নেই! কেবল দেওয়ালে লটকানো মা কালীর ক্যালেন্ডার, বাড়ির হিন্দুত্ব জাহির করছে।
আমরা নমশূদ্র! আমার মা তিনবেলা নিষ্ঠা ভরে পূজো করতেন। বাল গোপাল প্রতিষ্ঠিত ছিল ঠাকুরের আসনে তাঁর। নাড়ু,মিষ্টি নানান ভোগ দিতেন মা নিজে হাতে। এছাড়াও বাৎসরিক বারপূজো, সত্যনারায়ণ, বিপত্তারিণী,মঙ্গলচন্ডী পূজো পুরোহিত ডেকে করাতেন। মাকে কখনো মাংস ছুঁতে দেখিনি। দীক্ষা নিয়ে কন্ঠী নেওয়ার পর ইদানিং মাছ, ডিমটাও ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাবাও মায়ের পথ অনুসরণ করেছিলেন নির্দ্বিধায়।
আকাশ হওয়ার পর সব অভিমান ভুলে বাবা-মা আমাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছিলেন। ভেবেছিলাম ফিরে যাবো। আকাশ তখন খুব ছোট, মুখ এঁটোও হয়নি,তখনই অজানা জ্বরে একসাথে চলে গেলেন বাবা-মা! আমার সুস্থ জীবনে ফেরার শেষ আশা নিভে গেলো বাবা-মায়ের চিতার আগুনের সাথে। দাদা-দিদিরা সম্পর্ক রাখেনি,আমিই বা কোন মুখে নিজের দাবি নিয়ে দাঁড়াবো?
তখনও বুঝিনি ইয়ে তো স্রেফ ট্রেলর হ্যায়,পিকচার আভি বাকি হ্যায়!
চা বাগান বন্ধ হয়ে গেলো। স্বপনের চাকরিটাও চলে গেল। আগে থেকেই নেশা করতো, বাড়িতে বসে গিয়ে , নেশার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল। নেশার জন্য আর বাইরে যাওয়ার দরকার কি? ততোদিনে ওর মা,শরীরের সাথে সাথে মদ-গাঁজাও বেচা শুরু করেছে।
বাড়িতে সারাদিনই নেশারুদের আনাগোনা। সন্ধ্যে হলেই নরক গুলজার! দুধের বাচ্চাটাকে বুকে চেপে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকতাম। বুঝেছিলাম এভাবে আর বেশিদিন চালানো যাবেনা! গেলোও না। লোলুপ হায়নার নজরে পড়তে দেরী হলনা! আধবুড়ির থেকে কচি মাংস অনেক বেশী সুস্বাদু!
সেই অভিশপ্ত রাতের কথা মনে পড়লে আজও শিউরে উঠি। দুদিন স্বপন বাড়ী ফিরছে না। ওর মা নির্বিকার হলেও আমার টেনশনে দমবন্ধ অবস্থা!
সেদিন সন্ধ্যাবেলা শাশুড়ী মা ঘরে এলেন।“কি হাল করেছো চেহারার”বলে নিজেই চুল বেঁধে, মুখে ফেয়ারনেস ক্রিম মাখিয়ে দিলেন, বললেন, বাচ্চা মেয়ে শাড়ী পড়ে থাকো কেন ঘরে? এখন থেকে নাইটি পড়বে।“ নিজেই জোর করে একটা পিঙ্ক কালারের স্লিভলেস নাইটি পড়িয়ে দিলেন।
আমি অনুভব করতে পারছিলাম, কি সর্বনাশ হতে চলেছে! কিন্তু এর থেকে বেরোবার পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মাত্র সতেরো বছরের কিশোরী তখন আমি।
একটু পরেই মাঝবয়েসী একটা লোক ঢুকলো! ঘিয়ে রঙের সাফারি পরনে। দুহাতে গ্রহরত্নের সঠিক ঠিকানা যুক্ত গোটা ছয়েক আংটি! হাতে আর শেকলের মতো সোনার রিস্টলেট, গলায়ও মোটা চেন। অনবরত গুটখা জাতীয় কিছু চিবোচ্ছে আর পিচিক পিচিক করে থুতু ফেলছে। গায়ের রং ঘোর কালো,লালচে চোখ নেশার সৌজন্যে রক্তবর্ণ! একেবারে হিন্দি সিনেমার নামী ভিলেন সদাশিব অম্রপুরাকরের কার্বনকপি!
আকাশকে আমার কোল থেকে জোর করে কেড়ে নিয়ে, লোকটিকে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেলেন উনি।
আকাশের কান্নায় আমার কান্নার আওয়াজ চাপা পড়ে গেলো।
লোকটি অজগরের মতো গ্রাস করলো। প্রবল পৌরুষে নির্মম ভাবে আমায় বিদ্ধ করতে করতে হিসহিসিয়ে বললো,-‘চুপ যা শালী,তোর মরদ আর শাশকে পুরা দশহাজার রুপিয়া দিয়েছি, স্রেফ দো ঘন্টে কে লিয়ে। মুঝে মস্তি করনে দে! অগর মুঝে খুশ করোগী তো বহত কুছ মিলেগা”!
তার মানে স্বপন সব জানে! বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন! আর প্রতিরোধ করিনি।
সেই শুরু।এরপর পুরোপুরি বেশ্যা বনে গেলাম। আর কোনো রাখঢাক ছিলোনা। ছেলের তখন বছর দুয়েক বয়স পেটে বাচ্চা এসেছিল। স্বপন নার্সিং হোমে নিয়ে গিয়ে খালাস করিয়ে আনলো। এখন আবার বাচ্চা হলে শরীর নষ্ট হয়ে যাবে যে! ব্যাবসায় ভাঁটা পড়বে। সেই শেষ কান্না কেঁদেছিলাম ও বাড়িতে! আর কাঁদিনি,দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গেছি সাত সাতটা বছর!
আকাশ বড় হচ্ছে, ওই নরকের পরিবেশে থেকে, আর একটা স্বপন তৈরি হচ্ছে! ওর ভবিষ্যৎ ভাবলেই বুকটা ভেঙে যেতো যন্ত্রণায়! তখনই একমাত্র টের পেতাম পুরোপুরি যন্ত্র হয়ে যাইনি আমি। মুক্তির পথ খুঁজে পেতামনা।
ততোদিনে স্বপন আমায় হোটেলে নিয়ে যেতে শুরু করেছে। বিউটি পার্লারের নিয়মিত চর্চায় রূপ ফেটে পড়ছে আমার তখন। কাস্টমার ভালো মালের ভালো দাম দেয়। কয়েকটা হোটেল ঠিক করাই ছিল, খদ্দের এলে ফোন চলে আসতো। তখন একাধিক মোবাইলের মালিক স্বপন। হাতে সোনার আংটি, গলায় চেন,আটাচ বাথরুম সহ দুটো পাকা ঘর! বৌ ভাঙিয়ে দুহাতে পয়সা ওড়াচ্ছে ও!
আমার শরীর বেচা পয়সায় যদিও আমার অধিকার ছিলনা। বিউটি পার্লারে নিয়ে যাওয়া আর হালফ্যাশনের দামী ড্রেস কিনে দিত মা -বেটায়। প্রোডাক্ট আকর্ষণীয় না হলে বিকোবে না যে!
এমনই এক বিড়ম্বিত সময়ে মুস্তাকের সাথে প্রথম দেখা আমার।
মুস্তাক আহমেদ! বয়স চল্লিশের কোঠায় হলেও ওর মেদ হীন পেটানো শরীর, প্রায় ছফুট লম্বা অত্যন্ত সুদর্শন, শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য নয় ওর অন্তর ও সৌন্দর্যের খনি বুঝেছিলাম ওর সান্নিধ্যে এসে।
ওর বাড়ী বর্ধমানে। ব্যাবসার কাজেই আসতো ডুয়ার্সে। এতো মানুষের(?) ভীড়ে ওকে মনে থাকার কারণ হয়তো, আমার সাতবছরের শরীর বেচা অভিজ্ঞতায় এতো ভালোমানুষ আমি আগে পাইনি।
শারীরিক মিলন আমার কাছে প্রথম থেকেই যন্ত্রণাদায়ক। স্বপন শুরু করেছিল নির্মম ভাবে, তার পরবর্তীরা ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। ঘরের বউয়ের কাছে তারা মার্জিত বাধ্য স্বামী! আমরা তো পয়সায় কেনা মেয়েমানুষ! পয়সা উসুলের চেষ্টায় কত যন্ত্রণা পেয়েছি, তাদের বিকৃত কামনা মেটাতে, মনে পড়লে আজও শিউরে উঠি। পশুর চেয়ে বেশী মর্যাদা পাইনি কখনো! হায় আল্লাহ! একেই বোধহয় জাহান্নাম বলে।
ভাবিনি জাহান্নাম থেকে কখনো মুক্তি পাব। মুস্তকের কাছে, প্রথম মানুষের মতো ব্যবহার পেলাম। প্রথম দিন গল্প করেই কাটলো। আমার শরীর সবাই রগড়েছে, মনের খবর নেয়নি কেউ!ও সেই অবহেলিত, ভুলে যাওয়া মনের কথা মনে করিয়ে দিল।
ওকে অকপটে বললাম আমার দূর্ভাগ্যের কাহিনী! “আত্মহত্যা মহাপাপ” জানি, রোজ যে পাপ করছি তার কাছে সে পাপ তুচ্ছ! মরতে পারিনি শুধু ছেলের কথা ভেবে। এখানেই মাতৃত্বের কাছে হার মেনেছে নারীত্ব!
কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, এখানে থাকলে ছেলে মানুষ হবেনা! ওই পরিবেশে আজেবাজে কথা শিখছে, স্কুলেও যায়না ঠিকমতো।
মুস্তাকের চোখেও যন্ত্রণা দেখেছিলাম। ডুয়ার্সে এলেই ও আমার সাথে যোগাযোগ করতো। যে কদিন থাকতো আমি ওর সফর সঙ্গিনী হতাম। এজন্য অবশ্য ওকে মোটা টাকা পে করতে হতো।স্বপনও খুশী মোটা দাঁও মারতে পেরে।
মুস্তাক বলেছিল, ওর মর্মস্পর্শী কাহিনী। মুর্শিদাবাদের এক ছোট্ট গ্রামে ওর বাড়ী ছিল।খুব ছোটবেলায় মাকে হারায় তারপর আব্বা যখন মারা যান তখন ও মাত্র পনেরো বছরের কিশোর। দুঃসম্পর্কের এক চাচার কাছে আশ্রয় পায়। বর্ধমানে চাচার বিশাল অবস্থা। চাচার একটাই মেয়ে নাজনীন। পরমা সুন্দরী সে, কিন্তু ওর হৃদয়ের অসুন্দরতা পীড়া দিত মুস্তাককে।
অতিরিক্ত আদর দিয়ে যত্ন করে মেয়েকে বরবাদ করেছেন চাচা-চাচী! হিজাব, বোরখা তো দূর অশালীন পোশাকে ঘুরে বেড়ানো, বিভিন্ন নৈশ পার্টিতে নিত্য যাতায়াত ছিল ওর।
নাজনীন, ঘটনাচক্রে ওর স্ত্রী হলেও, স্বামীর মর্যাদা কখনো পায়নি ও। ওকে বাড়ীর চাকর-বাকরের নজরে দেখতো নাজনীন। ওর বিছানায় ওঠার সৌভাগ্য হয়নি কখনো মুস্তাকের। অবশ্য তা বলে নিত্যনতুন শয্যাসঙ্গীর অভাব হতো না, সুন্দরী, রইস নাজনীনের! আব্বার কষ্টার্জিত টাকা ওড়াতে ওর বিন্দুমাত্র কুন্ঠা ছিলনা।
বিগড়ে যাওয়া মেয়েকে কন্ট্রোল করার জন্য হয়তো হাতে ধরে মুস্তাককে তৈরী করে, একমাত্র মেয়ের দায়িত্বভার তুলে দিয়েছিলেন ওর হাতে।
বলাবাহুল্য মেয়ে রাজী ছিলনা এ বিয়েতে। কিন্তু এবার ওর আব্বা আব্দুল করিম কঠোর হলেন। সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করবার ভয় দেখাতেই বাধ্য হয়ে মেয়ে শাদী কবুল করলো। কিন্তু ওই নামেই শাদী!যার অপর নাম শান্তি পূর্ণ সহাবস্থান! শান্তি মাঝেমধ্যে বিঘ্নিত হলেও আব্বার ভয়ে সহাবস্থান আপাতদৃষ্টিতে বজায় রাখতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে।
জওয়ান মরদ মুস্তাক। শারীরিক চাহিদা খুব স্বাভাবিক। আমার কাছে শুধু শরীর নয়, মনের খোরাকও মতো মিটতো। এভাবে পরস্পরের কাছাকাছি এলাম আমরা মানষিক ভাবেই।
ততোদিনে নাজ মা হয়েছে কন্যাসন্তানের। স্ত্রীকে একদিনের জন্য স্পর্শ না করেও ওর সন্তানের পিতৃত্ব স্বীকারে বাধ্য হল মুস্তাক। চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে। আজ ও কোথায় থাকতো যদি এই মানুষটা সেদিন আশ্রয় না দিতেন! চাচা হয়তো সবই বুঝতেন , তবুও অন্ধ অপত্য স্নেহ!
মাস ছয়েক বাদেই মুস্তাক আমায় শাদীর প্রস্তাব দিল সাথে আকাশের যাবতীয় দায়িত্ব নেবার অঙ্গীকার! স্বর্গ পেলাম হাতে! নিজেকে চিমকি কেটে দেখছি,স্বপ্ন নয়তো? এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
স্বপনকেকে মোটা টাকা দিয়ে রফা হল।
রক্ষিতা নয় স্ত্রীর মর্যাদা দিল মুস্তাক আমায়। রীতিমতো কাজীর তত্বাবধানে শাদী হল আমাদের। তার আগে অবশ্য আমি স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হলাম। আমার মনে হয়েছিল ধর্মের চেয়ে সম্মান বড়!
ছেলে বড় হয়ে সিদ্ধান্ত নেবে, এখনই কোনো ধর্ম চাপালাম না ওর ওপর।
চাচার বাড়ীতে নয় মুস্তাক আমাদের তুলল ওর নিজস্ব ফ্ল্যাটে। চাচার ব্যবসা দেখাশোনার সাথে সাথে ওর নিজের ব্যবসা যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত!
আকাশকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে, বোর্ডিং এ রেখেছিল। ছুটিছাটায় আসতো। খুব দ্রুত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়েছিল ছেলে।
আমি কখনো চাচার বাড়ীতে যাইনি।ও যেতো নিয়মিত। ওর কর্তব্যে গাফিলতি ছিলনা।
চাচা জানতেন সব। অনাথ ছেলেটির জীবন নষ্ট করে দেওয়ার অপরাধ বোধ ছিল ধর্মপ্রাণ,সৎ মানুষটির!
বছর দুই বাদে নওয়াজ হল। মুস্তাক সেদিন আনন্দে যেন পাগল হয়ে গিয়েছিল। অস্বীকার করবো না,ও আকাশকেও খুব ভালো বাসতো!
নওয়াজ হওয়ার ওর চাচা এ বাড়ীতে এসে ওকে আশীর্বাদ করে গিয়েছিলেন।
এরপর কেটে গেছে দশটি বছর।খুব ভালো আছি আমি মুস্তাক খুব যত্নে রেখেছে আমাকে। এতো ভালো থাকবো, কখনো কল্পনা করিনি আমি।
আবার ফোনটা বাজছে।এবারে আকাশ। বললো,”মা, আম জলপাইগুড়ি যাচ্ছি, শেষ দেখা দেখে আসি”! শুধু ই দেখা ও মুখাগ্নি করবে না। বড় হওয়ার পর ও স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েছে। আমরা কেউ বাধ্য করিনি। এটাই হয়তো স্বপনের প্রাপ্য ছিল, ছেলের হাতে শেষকৃত্য ওর ভাগ্যে হলনা। বড় হওয়ার পর ও মাঝেমধ্যে যেত স্বপনের ওখানে, আমি বাধা দিইনি কখনো।
মাস দুয়েক আগে জলপাইগুড়ি থেকে এসে আকাশ বলেছিল,-“মা, বাবা অনেক বদলে গেছে। হয়তো মৃত্যুর করাল ছায়া ওকে দাঁড় করিয়েছিল নির্লজ্জ সত্যির মুখোমুখি! ওকে নাকি আমার কথাও জিজ্ঞেস করছিল! জীবনের শেষপর্বে এসে অনুতাপ ওকে বিব্রত করছিল হয়তো!
ইশ্বর ওর আত্মাকে শান্তি দাও! আমি বিধর্মী, জানিনা ইশ্বর আমার কথা শুনবেন কিনা! যখন স্বধর্মে ছিলাম তখনও অবশ্য শোনেননি, তবুও…!
অবাক হলাম আমার দুচোখে ধারা নেমেছে আবিস্কার করে!
এ কান্না কি স্বপনের জন্য নাকি সেই হারিয়ে যাওয়া অপাপবিদ্ধ কিশোরীর প্রথম প্রেমের অপমৃত্যুর শোকযাপন! এ কান্না ঠকে যাওয়ার নাকি একটা পরিচিত মানুষের চলে যাওয়ার শোক! বুঝে উঠতে পারলামনা! মানুষ নিজেকেই বোধহয় সবচেয়ে কম চেনে, অনুভব করলাম আরেকবার।