সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে দেবদাস কুণ্ডু (পর্ব – ১)

লড়াইয়ের মিছিল

পর্ব – ১

রাতের কলকাতা। কোথাও আলো আছে, কোথাও নেই। একটা এমব্যাস্যাডারের হেড লাইট জ্বলছে। তীব্র গতিতে ছুটছে গাড়িটি অরবিন্দ সরনি ধরে।
নিদ্রামগ্ন রাত। চারদিকে চারটি চারতলা বাড়ি। মাঝখানে একটা বড় মাঠ। প্রতিটি ঘরের দরজা বন্ধ। আলো নেভানো। 9/38 নম্বরের ঘরের দরজা খোলা। আলো জ্বলছে। সেই আলো বারান্দা টপকে কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার মাঠে একফালি চাঁদের মতো শুয়ে আছে।
অন্যদিন এই ঘরের আলো নিভে যায়। রাত এগারোটার পর। শেষ খবর শুনে হরিদাস পাল শুয়ে পড়েন। শুয়ে পড়েন তার স্ত্রী বেলারানিও। ভোর চারটেতে উঠে পড়েন হরিদাস পাল। মানে ঘুম ভেঙ্গে যায়। বয়স হলে এই পৃথিবী যেমন অনেক কিছু কেড়ে নেয়, তার মধ্যে সবচেয়ে দামী হলো ঘুম।
শুধু যে ঘুম পালালো, তা তো নয়। সময় তখন ভারি হয়ে চেপে বসে বুকে। নানা চিন্তার স্রোত বইতে থাকে রক্তে। তার গতি বাড়ে। সেটা আবার জীবনকে গাঢ় বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়। তাই স্ত্রী শুয়ে থাকলেও তিনি উঠে পড়েন। তখনও পৃথিবীর বুকে হালকা অন্ধকারের একটা চাঁদোয়া থাকে। ব্যস্ত কাক ডেকে ডেকে রাতের ঘুম ভাঙায়। আগের মতো এক গ্লাস জল খেলে বেগ পাবে আর তিনি বাথরুমে ছুটে যাবেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে নেমে আসবে অপার শান্তি। তা কিন্তু নয়। সেই সুখের দিন হারানো সুরের মতো উধাও। বয়স ঐ স্ব্রর্নযুগের অনুভূতিটা কেড়ে নিয়েছে। সময় তার শরীরের ঘড়িটা উল্টে দিয়েছে। এখন কোন কোন দিন বাথরুম হয়না। নানা ভেসজ উপাদান পান করলেও কোন ফল নেই। ডানপাশে পাঁচটা, বাঁ পাশে পাঁচটা পর পর ঘর। মাঝখানে চওড়া সিঁড়ি। 40 ফুট লম্বা বারান্দা তিনি হাঁটেন। ভুড়ি তো ছিল, আছে। সেই সংগে গ্যাস। মাঝে মাঝে বুকে উঠে আসে। তিনি অনেক প্রাকৃতিক ওষুধ খান। তার টেবিলে তাকালে মনে হবে একটা ছোটো খাটো ওষুধের দোকান। তিনি হাঁটতে থাকেন আর বাইরের অন্ধকার তরল হতে থাকে। কুসুমের মতো একটা আলো পৃথিবীর বুকে উঁকি মারে। এক একটা ঘরের দরজা খুলতে থাকে।
38 নম্বর ঘর থেকে আশি বছরের বয়স্কা বেলারানি বেরিয়ে আসেন। 39 নম্বর রুমের দরজার ওপর তিনি ধাক্কা দিতে থাকেন। ঘরের তিনটে মানুষের কেউ সাড়া দেয়না। তার হাতের মুঠো অস্থির ভাবে দরজায় পড়তে থাকে ঘন ঘন। তবু খুলছে না। লেখাপড়া না জানা মানুষের এই বিপদ হয়। তিনি চিৎকার করে ডাকেন – – – তোতন তোতন
পৃথিবী এখন ধ্যনমগ্ন। চারপাশে এতটুকু শব্দ নেই। বেলারানির হাতে একটা পুরনো ছোট ডাইরী। তাতে ছেলে সুদর্শনের ফোন, ভাসুরের, দেওয়ের ছেলেদের ফোন। আর আছে জামাইদের ফোন। আবার ধাক্কা দিতে যাচ্ছিলেন—
এইবার দরজা খোলে। ঘরের আলো জ্বলে।
তোতন বলে-কি ব্যাপার?
—সুদর্শনকে একটা ফোন ধরে দে বাবা।
—এতো রাতে ফোন করছেন কেন?
–ওর বাবার বুকে ব্যথা হচ্ছে।
তোতন সুদর্শন পালের নম্বরে ফোন লাগিয়ে দেন। কথা বলতে গেলে জড়িয়ে যাচ্ছে। তবু মনে জোর এনে বেলারানি বললেন—তোর বাবার – – আবার কথা আটকে যাচ্ছে। মনে বেশি করে জোর এনে বললেন—তোর বাবার বুকে ব্যাথা হচ্ছে খুব।
—ডান না বাঁ?
–বাঁ। আমি তেল মেখে দিয়েছি। কমেনি এতটুকু।
– – ঠিক আছে। তুমি টেনশেন করোনা। আমি গাড়ি নিয়ে এখনই বের হচ্ছি।
–গৌর ডাক্তারকে সংগে করে নিয়ে আয় তোর
গাড়িতে।
–হ্যাঁ। তাই যাচ্ছি।
এমব্যাস্যাডার কলেজ স্ট্রিট পার করে কলকাতা উনিভার্সিটি ডানদিকে রেখে মেডিকেল কলেজের এমাজেন্সি বিল্ডিংর নিচে এসে দাঁড়াল।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।