তারিখটা ছিল ১৪৩১ সালের মে মাসের ত্রিশ তারিখ। জোয়ান মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারার হুকুম ছিল। রুয়েঁ শহরের একটা লম্বা থামে জোয়ানকে বাঁধা হয়েছিল। মেয়েটা পুড়ে মরলে ইংরেজরা কয়লাগুলো সরিয়ে তার আংরা হয়ে যাওয়া শরীরটা নেড়েচেড়ে বের করে দেখায়। যাতে কেউ বলতে না পারে যে সে মরে নি আর জ্যান্ত অবস্থায় পালিয়েছে।
ইংরেজরা জোয়ানের ওই আংরা হয়ে যাওয়া দেহটা আরো দুবার পোড়ায়, যাতে দেহটা পুরোপুরি ছাই হয়ে যায়, আর কেউ যাতে সে মেয়ের ভস্মাবশেষ সংগ্রহ করতে না পারে, তার জন্যও কড়াকড়ি ব্যবস্থা ছিল। তারপর জোয়ানের ছাইটুকু সীন নদীর জলে ফেলা হয়েছিল।
সেদিন বিচারের নামে পুরো মাত্রায় অবিচার হয়েছিল ঊনিশ বছরের মেয়েটার উপর। জোয়ানের বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়াটি ছিল ভয়ঙ্কর ভাবে একচোখোমিতে ভরা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা ছিল যে জোয়ানকে যে কোনো ছলেই হোক মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। বিচারপতি র আসনে যে ধর্মনেতারা ছিলেন, তাঁরা সকলেই হয় ইংরেজ ছিলেন, নয় তো বার্গাণ্ডির লোক। জোয়ানের দেশ ফ্রান্সের কেউ ছিলেন না। অথচ সে যুগেও নিয়ম ছিল যে, কারো বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ উঠলে বিচারকের আসনে নিরপেক্ষ ধর্মনেতাদের রাখতে হবে। অন্ততপক্ষে একটা ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা থাকতে হবে।
আশ্চর্যের বিষয় যে জোয়ান, তখন মোটে ঊনিশ বছরের একটা একলা মেয়ে, সে প্রশ্ন তুলেছিল, বিচারকদের মধ্যে ফ্রান্সের কেউ নেই কেন? আইনের শাসন বজায় রাখতে ফ্রান্সের তরফের বিচারক আনানো জরুরি। তার যুক্তিসঙ্গত প্রশ্নকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছিল।
জোয়ানের মতো একজন তেজস্বিনী নির্ভীক বন্দীর হাত থেকে দ্রুত রেহাই পেতে চেয়েছিল ইংরেজরা। আর চটপট কঠিনতম শাস্তি মৃত্যুদণ্ড যতদূর হৃদয়হীনতার সাথে সম্পন্ন করে ফ্রান্সের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে নিশ্চিত করা যায়, তা ভেবে রেখেছিল। জোয়ানকে যে প্রাণদণ্ড দেওয়া হবে, তা বিচারের আগেই ঠিক করে রাখা ছিল। একটা নাটকবাজি করবার জন্য বিচার প্রক্রিয়া সাজানো হয়েছিল।
তুখোড় বুদ্ধিমান ধর্মনেতারা জোয়ানকে ফাঁদে ফেলবার জন্য কূট প্রশ্ন সাজিয়েছিল। তারা জোয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে, তুমি কি ঈশ্বরের করুণার ছত্রছায়ায় আছ?
এটা আসলে একটা জঘন্য ফাঁদ। সে যুগে চার্চের মত ছিল যে, কেউ স্থির নিশ্চিত হয়ে বলতে পারে না যে সে ঈশ্বরের ছত্রছায়ায় আছে। কেননা, তখনকার আইনে তেমন বলাটা ধর্মদ্রোহিতার নিদর্শন।
তাহলে জোয়ান যদি বলে, আমি ঈশ্বরের করুণার ছত্রছায়ায় আছি, তাহলেই ধর্মদ্রোহিতা প্রমাণিত হয়ে যায়।
আর যদি জোয়ান বলে যে, না, আমি ঈশ্বরের করুণার ছত্রছায়ায় নেই, তাহলে তার তরফে দোষ স্বীকার করা সম্পূর্ণ হয়ে যায়।
তখন তেমন দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া সহজ হয়ে যায়।
চাষীঘর থেকে উঠে আসা নিরক্ষর মেয়ে জোয়ান এই কূট তার্কিক প্রশ্নের মোক্ষম জবাব দিয়েছিল। জোয়ান বলেছিল, আমি যদি ঈশ্বরের কৃপাবৃষ্টির নিচে না থেকে থাকি, তাহলে করুণাপূর্বক তিনি আমাকে সেখানে রাখুন। আর যদি ঘটনাচক্রে আমি সেখানে থেকে থাকি, তাহলে ঈশ্বর আমাকে সেখানেই রাখুন।
একটা নিরক্ষর মেয়ে অবলীলায় এই কূট ফাঁদ এড়িয়ে যেতে পারল দেখে বিচারকেরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
রাস্তার ধারে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে গাছগুলি যেন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। আর শ্যামলী একা একা পথ হাঁটতে হাঁটতে বিশ্ব ইতিহাসের একটা কুৎসিত ঘটনাকে নষ্টামি ও ভণ্ডামির দায়ে সোপর্দ করছিল।