“এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো” বিশেষ সংখ্যায় গৌতম বাড়ই

ক্ষীরেরকোট

বাতাস যেখানে কথা বলে সেটা আমার বাড়ি
শব্দ যেখানে শিহরণ সেটা আমার দেশ——-
ঠিক এইভাবেই পরিচয় একটা আধপাগল এলোমেলো গোছের ছেলেটির সঙ্গে।পরিচয় ধূপগুড়ি হাটে। আগষ্ট মাস।বৃষ্টি থামতেই প্যাচপ্যাচে গরম।তখন জীবন আর জীবিকার জন্য ডুয়ার্স তরাই আর বাদবাকি উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন হাটে যেতে হতো আমাকে। ময়নাগুড়ির একজন ছিলেন আমার সঙ্গী এই ব্যবসায়ের।হাটে হাটে ঘুরে পাট কিনি।তারপর শিলিগুড়িতে নিয়ে এসে গুদামজাত করি।পরে দাম পেলে বেচে দেই।ট্রাকে করে চলে যায় কলকাতার কোন চটকলে।ব্যবসার ঐ পুরোনো মাদার পলিসি বা ট্যাকটিক্স কোথাও অল্প দামে কেনো আবার কোথাও সেটাই বেশি দামে বিক্রি করো।লাভটাই মুনাফা। এই ব্যবসার মুনাফা কমতে থাকে অস্তমিত পাটশিল্পের জন্য খুব দ্রুত। তবে এই ব্যবসায় নেমে যে রঙ-বেরঙের জনজীবন দেখেছিলাম যাদের ছোঁয়া পেয়েছিলাম কাছ থেকে সেটাই আমার এ জীবনের সম্পদ।এখন অবসরে ভাবতে বসি কতো মুখের কথা।মুখগুলো খুব মনে পড়ে।এই যেমন ছিদাম সরকার।পাটের কারবার করেন আবার কবিতা লেখেন গল্প লেখেন কত কী এলোমেলো কথা বলেন।তখন মনে হতো ওনার মাথায় একটু না অনেকটাই ক্ষ্যাপামো জায়গা দখল করে আছে।তবে এই ছিদাম সরকার ধীরে ধীরে আমার ভীষণ অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠে।ধূপগুড়ি হাটে গেলে ওনার বাড়িতে একটা রাতের অতিথি হবার জন্য বারবার আবেদন করতো আর আমি প্রত্যাখান করতাম ইনিয়ে বিনিয়ে এ কথা সে কথা বলে প্রতিবার।আর খুব খারাপ লাগতো নিজের মনেই এমন নিখাদ ভালোবাসা গ্রহণ না করে।
অবশেষে একদিন ধূপগুড়ির হাটবারে বেকায়দায় পরে তার আতিথেয়তা গ্রহণ করতেই হলো। যে ট্রাকে পাটবোঝাই হবে সে ট্রাকটি ময়নাগুড়ি থেকে আসবার পথে ঝাঝাঙ্গী তে উল্টে পড়লো।তিস্তা ব্রীজ আর জলঢাকা ব্রীজে প্রচন্ড জ্যাম।বোঝা গেলো কাল সকাল দশটার আগে ছাড়া আমরা এখান থেকে বেরোতে পারবো না।ছিদাম সরকার ব্যস এই মওকায় তার বাড়িতে বগলদাবা করে তার শখের মার্ক ফোর এম্বাসাডারে চাপিয়ে নিয়ে চললেন।এই মার্ক ফোর তার জীবনে নাকি এক জীবন্ত রহস্য।আগে কোনদিন এই গল্প শুনিনি।ছিদাম সরকারের বাড়িও ধূপগুড়ি থেকে খুব একটা কাছে না প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে ক্ষীরেরকোটে।আমি বললাম–ছিদাম তোমার বাতাসপুর কত দূরে?
– দাদা ওটা বাতাসপুর না।ভোলানাথপুর।
-আমি তো সেই তোমার কবিতার সাথে মিল রেখে বললাম।
হা হা অট্টহাসিতে এমন ফেটে পড়লো সেই ফাঁকা পিচ রাস্তায় অদ্ভুত শোনাচ্ছিলো।সত্যি বলছি পিশাচের মতন।হাতে স্টিয়ারিং।মার্ক ফোর গড়াচ্ছিলো কালো পিচের রাস্তায় বেশ জোরেই।
ভুটনীরঘাট এর পর গাড়িটা বাঁক নিতেই মুজনাই এর ব্রীজ পার করে ছিদাম দাঁড় করিয়ে দিলো।নিচে কাদা মাটির গন্ধ আর সারাদিনের প্যাঁচপেচে গরমের পর ব্রীজের কাঠের পাটাতন থেকে আলকাতরার গন্ধ বাতাসে মিশছিলো।তখন ঐ ধরনের একদম একরকম দেখতে কিছু ব্রীজ ডুয়ার্সের এখানে ওখানে ছিলো।লোহা আর কাঠের সংমিশ্রণে তৈরী।হয়তো তখন এখানে কাঠ খুব সহজলভ্য আর সুলভ ছিলো বলে।লাল সাদা কালোর সেই ব্রীজ এখনো চোখে ভাসে।নাকেও পাই সেদিনের ব্রীজের গন্ধ।স্মৃতি তার মন থেকে কিছু হারিয়ে যায়নি।অনেকক্ষণ সে হা করে আর নাক টেনে প্রকৃতির সৌরভ এ শরীরে মাখলো। আমারও ভালো লাগছিলো।নিচের ঝোঁপে বেশ কিছু জোনাকী পোকা জ্বলছিলো।ওখানটায় বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে।ব্রীজটা চওড়ায় একটা গাড়ি ভালো মতন যেতে পারে।তাই ব্রীজ পার করে রাখা গাড়িটা।হেঁটে আসতে আসতে গাড়ির ঠিক হাতপাচেঁক দূরে খপ করে আমার হাতটা ধরলো ছিদাম।
-এই দাদা দাঁড়াও!
আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। মনে হলো কালো মতন একটা কিছু সামনে দিয়ে রাস্তা পার করে চলে গেলো।
– গোমা সাপ আছে দাদা।এই ভাদ্দরের গরমে খুব ঘোরাঘুরি করে।আর খুব মারাত্মক এখন।
আমার ভেতরে শীতল স্রোত খেলে গেলো।ওটা বোধহয় মৃত্যু শীতলতা অনুভব করা‌।ঐ এক মুহূর্ত।তারপর গাড়িতে গিয়ে বসলাম।ছিদাম গাড়ি চালাতে শুরু করলো।ছিদাম আগে জীবিকার জন্য গাড়ি চালাতো।হাটে হাটে ওর এই মার্ক ফোর নিয়ে বিভিন্ন রকমারি জিনিস বিক্রি করতো।তারপর ময়নাগুড়ির যোগেনের সাথে কি রকম ভাবে যোগাযোগ হয়ে এই পাটের ব্যবসায় আসে।আর আমার সাথে ঐ যে বললাম ধূপগুড়ি হাটে যোগাযোগ।আমার ও ভেতরটা কেমন শব্দে নাড়াচাড়া করে ওঠে আর যেখানে যাই ওরকম আর একজন শব্দ নাচানি দেখলে তো বন্ধুত্ব হবেই।
যখন ক্ষীরেরকোটে এলাম।আবছা আলো অন্ধকার।গ্রামে গ্রামে তখনও বিদ্যুত পৌঁছায় নি।বড় রাজ্য সড়ক ছেড়ে এবারে পড়েছিলাম বালি পাথরের রাস্তায়। তারপর এক বড় গাছের তলায় ছিদামের গাড়ি দাঁড়ালো।মনে হলো যেন আশপাশে সবই বড় বড় মাদার গাছের সারি।মাদারগাছের প্রাচূর্য ছিলো বলেই মাদারীহাট বলে একটা জায়গাও রয়েছে সামনে।পূর্ণিমা মানে ভাদুড়ে পূর্ণিমা হয়তো সামনে।তাই আধো আলো ছায়া।গাড়ি থামিয়ে হাঁক পাড়লো আর বেড়ার ভেতরে একটা হালকা আলোর দিশা দেখতে পেলাম।সেই লন্ঠনের আলোয় মনে হলো এক আদিবাসী মহিলা।চা বাগানে যেমন দেখে থাকি।ছিদাম বললে- দাদা এসো।
আমি সেই আলোর অনুসারী হলাম।ভেতরে বোঝা গেলো এক প্রশস্ত প্রাঙ্গণ।দু-চারটে বড়ো বড়ো কাঠের চেয়ার পাতা।আমি একটায় বসলাম।গলাটা শুকিয়ে এসেছিলো।আমি জল চাইবার আগেই ছিদাম জোরে চেঁচিয়ে বললো–আরে এ তামিল দাদাকে ঠান্ডা জল খাওয়া কূয়া থেকে তুলে।তখন তরাই ডুয়ার্সের সব খানেই পাতকুয়ো অথবা চাপাকলের রেওয়াজ।আর সেই জলের কী স্বাদ আর জলপান করে কী শান্তি!যারা করেননি তারা কেউ বুঝবে না।এখনো গজলডোবায় গেলে কল্পনা হোটেলের টিউবওয়েলের জল পান করে ওরকম শান্তি কিছুটা পাবেন।
ছিদাম সরকারের বিরাট গৃহস্থ বাড়ি চারদিকেই অনেক ঘর।তবে ঘরের তুলনায় লোক কোথায়?দু তিনটে মহিলা আর দুজন পুরুষ মানুষ দেখলাম।ততক্ষণে আরো দুটো লন্ঠন আঙিনায় এসেছে।তাদের দেখবো কী!তারাই বোধহয় আমাকে জরিপ করে চলে গেলো।কোন বাচ্চাকাচ্চা পোলাপানের আওয়াজ নেই।এক রহস্যময়তা আমায় ঘিরে ধরলো।ছিদাম মামুলী দু একটা কথা বলছিলো।আমি হুম হুম করে পরিবেশটা বুঝে নিচ্ছিলাম।আর ছিদামের তো প্রতি কথায় পাগলামো লেগেই থাকে।
— দাদা এই ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আর জোনাক জ্বালানো রাত জীবনে কটা পেয়েছো?
— এটাই প্রথম।
— নাও তবে উপভোগ করো।
আবার সেই অট্টহাসি।আর ওর ঐ হাসিটা শুনলে তখন ছিদামকে আমার মানুষ বলেই বোধ হচ্ছিলো না।
এবার হাতে একটা তিন ব্যাটারীর টর্চ লাইট নিয়ে এসেছে।এখানে এই ডুয়ার্সের গ্রামে রাত বিরেতে প্রত্যেকের হাতে তখন ছিলো ভরসা এই টর্চের আলো।সেই আলো একদিকে ফেলে বললো–ঐ যে ঘর ওখানে আমার মা থাকেন।
উনি কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?
-হাঁ।মস্ত ঘুমে।মারা গেছেন।ও ঘরেই কবর দিয়েছি রেখেছি।দাদা এসো দেখবে মায়ের ঘর।
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। হাঁ বলবো না না বলবো বুঝে উঠতে পারছি না।ততক্ষণে হাঁটা দিয়েছে ছিদাম। আমি ওর টর্চের আলো ধরে এগিয়ে চললাম।
একটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দাওয়ায় টিনের চালায় দর্মার বেড়া দেওয়া মাটির ঘর।বাইরের আগল খুলে ঘরে প্রবেশ করতেই গা টা ছমছম করে উঠলো।টর্চের আলোয় দেখলাম একটা সাদা ফটফটে বিছানার চাদর পাতা চৌকি।একটা টুলের ওপর এক মাঝবয়সী মহিলার সাদাকালো ফটো।ঘরের মাটির মেঝেয় এক জায়গায় কিছু ফুল ছেটানো।
—দাদা এর নিচেই রয়েছে মায়ের দেহ।
আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম—চলো বাইরে গিয়ে বসি এবার।বাইরের আকাশের তলায় পৃথিবীটা বেশি উপভোগ্য এখন।রাতের ঠান্ডা হাওয়া লাগছিলো বেশ।
— হাঁ দাদা এবারে হাতে মুখে জল দিয়ে চা খাবে চলো।
একটা খটকা আমার ছিলো।ছিদামের এই ক্ষীরেরকোটের ভোলানাথপুর গ্রামে এসেই পা দিয়ে লেগেছিলো।ঐ তামিল নামের মহিলাটি।
চা খেতে খেতে ছিদাম কে বললাম সে কথা।
ছিদাম আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো।তারপর বলতে শুরু করলো—–
তামিলকে আমি রংধামালী থেকে নিয়ে আসি বিয়ে করে।ও তো চা বাগানের মেয়ে।আমি ওকে তামিল নাম দেই।আমার আরো দুটো সঙ্গিনী আছে।
সে কী! আমি চমকে উঠি।
না দাদা চমকানোর কিছু নেই। ঐ অসহয়া
মেয়েগুলো আমার কাছে আমার এ বুকের মাঝে আশ্রয় না পেলে কবে এই পৃথিবীর ধূলোয় মিশে যেতো।তবে ভণ্ড বাবাজীদের মতন ঢং করবো না।আমি ওদের ভোগ করি,ওরাও আমায় ভোগ করে।ওদেরকে আমি বন্ধ্যা করে দিয়েছি।তাই আমার এই পৃথিবীতে,আমার এই দেশে বাতাসপুর বলছিলে না, বাচ্চাকাচ্চাদের আওয়াজ কলরোল নেই দাদা।
এবারে সত্যি সেদিন ঐ মুহূর্তে অনুভব করেছিলাম আমি বাস্তব জগতে যেন নেই।
আমাদের বাস্তব জগতটাই মিথ্যা।এটাই সত্যি।ওটা স্বপ্ন।এটাই ঘটমান।
আমি বললাম–তুমি তো কবি।শব্দকার।স্বভাব কবি।কবিরা তো ফুল চাঁদ আকাশ তারা আর অবশ্যই বাচ্চাদের ভালোবাসে।
—-কে বলেছে আমি কবি?আমি কখনো বলেছি?ঐ সব বিশেষণ লাগিয়ে নিজেকে বড়াই করা ছাড়া আর কিছু নয়।আমি শব্দের বিষটা অনুভব করি।আমি বিষাক্ত হয়ে উঠি।প্রত্যেকটা মানুষ তাই।সব উপর দেখানো মিথ্যা কথা।নাহলে পৃথিবী এতো নষ্ট হয়!তাহলে ভান না করে একদম সত্যি হই আমি।আমার সত্যি শুনে কেউ যদি ভালো হয়ে ওঠে।এতদিন তো মিথ্যের সত্যি শুনে খারাপ হয়ে উঠলো।আমি কবি নই।সবাই জানে এ তল্লাটে আমার তিন তিনটে বৌ।আমি জানি বেআইনি।কারো সাহস আছে আমাকে কিছু বলবার?ওরা জানে আমি কতটা মারাত্মক!ঘাড়ে চাপিয়ে দেবো।নে শালা দায়িত্ব নিয়ে স্ফূর্তি কর।আমার তিন বৌ আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না জানি।দাদা তোমায় আজ হাড়িয়ার সাথে কচি পাঁঠার মাংস খাওয়াবো।অনেক গল্প করবো।একটা আধো লালচে খাওয়া চাঁদ তখন রাতের আকাশে।ওরকম রহস্যময় চাঁদ আমি আর কোনদিন দেখিনি।
** ** ***
_____
ময়নাগুড়ির যোগেনকে বলেছিলাম—-চল এতো করে বলে।একদিন যাই ছিদামের বাড়ি।
ও খালি বলেছিলো—পাগল!মাথা খারাপ করি শেষে।ক্ষেপেছিস।তুই যা।রতনে রতনে তো চেনাজানা ভালোই হয়েছে।
আমার আবার সুস্থতার থেকে একটু পাগল হয়ে যেতেই ভালো লাগে।সেদিন ঐ মধ্য রাত্তিরে বসে হাড়িয়ার উপরের অংশ রসি আর পাঁঠার মাংস খেতে খেতে খেতে এই কথা ভাবছিলাম।এই হাড়িয়া ডুয়ার্সের চা বাগানে সস্তার নেশার পানীয় হিসেবে খুব জনপ্রিয়।ভাত পচিয়ে দু তিনদিনে করে। ছোট নাগপুরের আদিবাসীরা যেখানেই গেছে এই হাড়িয়া তাদের জীবন স্রোতে মিশে সেখানেই আছে।তাদের আদিম জীবনে যেমন দোল দেয় ঠিক তেমনি দোলে দুলছিলাম সেইরাতে।তার আগে দেখেছি ঐ রাতে ছিদামের বাড়িতে সব কিছু ভোজবাজির মতন যোগাড় করে রান্নার তোড়জোড়।ওর তিন বৌ আর ভাই সবাই মিলে লেগে গেলো রান্না বান্নায়।একটা রাতের পিকনিকে মশগুল হয়ে উঠেছিলাম যেন।তামিল, রত্না আর সাদিয়া।রাতের ফুটন্ত ফুল।দিস্তা দিস্তা কাগজ আর অসংখ্য লেখা ছিদামের ঘরে বিছানায় ছড়ানো।তিনটে বৌয়ের তিনটে ঘর পাশাপাশি।ওর ভাইয়ের ঘরে সুন্দর সুন্দর সব আঁকা টাঙানো পড়ে আছে।দিনের আলোয় পরে দেখেছিলাম এই অসাধারণ চিত্রশিল্পীর তারিফ করবার মতন সব আঁকা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠত্ব বলে তাই কিছু নেই। বাঁশ পাতায় গাছপাতায় লেগে থাকে আরো কিছু।ভাইটিও তার একদম সাধারণ মানুষের মতন আচরণ করেনা।একটাও শব্দ বা ভাষা নেই মুখে।ছিদামকে প্রশ্ন করে পরে জেনেছিলাম,ছিদামের ভাইটি কথা বলে এবং ভীষণ প্রগলভ সেদিন, তবে প্রতিদিন নয়। হঠাৎ কোন একদিন।আমি তো ভেবেছিলাম বোবা।চোখ মুখের চাহনি দেখে।
ছিদাম আঙিনায় মাদুর পেতে বলে আমায়–দাদা বাবা-মা আমার নাম রেখেছিলেন শ্রীদাম কিন্তু কেমন করে যেন ছিদাম হয়ে গেছি নিজেও জানিনা।আমি কলকাতায় একটি কলেজ থেকে বি.এস.সি.পাশ।তারপর আর পড়িনি। হাটে হাটে সুদের কারবার করা বাপ একদিন সুদ আসল সহ আকাশে মিশে গেলো।আমি ঘরের ছেলে ঘরে।বুঝলাম সব ঐ ঝাটের পড়া।আর প্রথা মেনে গড়পড়তা চাকরি সংসার জীবন আমার ধাতে নেই।আমি ভীষণ বন্য আর আদিম।এই ঘর সংসার ছেড়েও ডুব মারি যেদিন মন মর্জি চায়।
আমি বললাম –ছিদাম তুমি যে ছুপা রুস্তম আমি প্রথম দিনের আলাপেই বুঝেছি।তুমি যে গড়পড়তা নও সেদিনই জেনেছি।
তারপর মাঝরাতে আমার হাত ধরে বলে তুমি বুড়াবুড়ির স্থান দেখবে চলো দাদা।তারপাশে ঐ যে নদী,দেখবে এই রাতে চান করে কতো মজা!আমি না করতে পারলাম না।দেখি আমাদের সাথে সাথে ঐ রাতে সাদিয়াও চলেছে নদীর দিকে।সাদিয়ারাও হাড়িয়া খেয়েছে।কোমর ধরে নেচেছে ওরা।এই সাদিয়াকে মোহরগাঁও গুলমা টি এস্টেট থেকে ছিদাম নিয়ে আসে।না হলে মেয়েটি দালালের খপ্পরে পড়ে বোম্বেতে পতিতালয়ে চালান হয়ে যেতো।বুড়াবুড়ি হরপার্বতী।একটা টিনের চালাঘরে ষাঁড়ের পিঠে বসে আছেন।সাদিয়া হাসতে হাসতে আবদারে ছিদামের পিঠে।ছিদাম বুড়াবুড়ি তলার দিকে হাত দেখিয়ে বললো-দাদা হুমমম খুব জাগ্রত!যাহা চাইবে তাহাই পাইবে।আমি ছিদামের দিকে তাকিয়ে বললাম–যদি পাঁচটি বৌ চাই!আবার সেই হাসি।এবার সেই হাসিতে এক মানবীর হাসিও মিশ্রিত হলো।
নুড়ি বালির পথ।ঘাস জঙ্গলে কিছু সড়সড় সরে গেলো অন্ধকারে।একটা পেঁচা বা রাতচরা পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ গাছের উপর থেকে এলো।সবুজ বন পাতার আর পাহাড়ি নদীর জলের মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লেগেছিলো।এখনো জীবন্ত।
সেই মাঝরাতে খলখল আওয়াজ ডুয়ার্সের জল থেকে ভেসে আসছিলো।একটা সোমত্ত পুরুষ আর একটা আদিম নারী জলকেলিতে মেতে উঠলো।এ রকম দৃশ্য এ জীবনে চর্মচক্ষুতে দেখা দুর্লভ।আকাশের হাল্কা আলোর চাঁদ হেলে পড়েছে।আমার আজও সেই রাতের দৃশ্য মনে পড়লে এখনো মনে হয় আমার এই জগত কি মিথ্যা!আমরা কিছু কৃত্রিম বোধ দিয়ে গড়ে তুলি এই পৃথিবী।আসলে পৃথিবী বড়ই রহস্যময়!তাই হারিয়ে যায়নি ছিদাম সরকার আজও।
শ্লীলতা বা অশ্লীলতা বলে কিছু নেই আসলে।ওটা সত্যির ওপর সাজানো মিথ্যে বোধ।না হলে নগরে প্রান্তরে বন্দরে ব্রথেলের জন্ম হতো না।আমাদের কোষে কোষে বিষ।সেই বিষ নৃশংস! পৃথিবীর জল কাদা মাটি লেগে থাকে তাতে।আমরা সেই বিষে বিষাক্ত হই আরো।—-ইতি মানুষ।ছিদাম সরকার।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।