শ্যামলী বলল, ঠিক তা কিন্তু নয়। খুব বেশি হলে ওটাকে মতান্তর বলা চলে। মনান্তর হয় নি।
করবী মিত্র বললেন, অন্তর থেকে বলছিস?
শ্যামলী হাসল।
করবী বললেন, কি বলেছিলি তুই ম্যাম কে?
শ্যামলী বলল, সে একটা পারসোনাল রিকোয়েস্ট। তা ওঁর অসুবিধাটাও আমি বুঝতে পেরেছি।
করবী বললেন, চ্যুইং গাম বুঝিস?
শ্যামলী বলল, হ্যাঁ, স্কুলে কতজন বেঞ্চে লাগিয়ে রাখত। তারপর দেখি স্কার্টে এঁটে রয়েছে।
করবী বললেন, তোর কথাগুলো সেই চ্যুইং গামের মতো। চিবিয়ে যাও, চিবিয়ে যাও, শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে! আসল কথাটা পেট থেকে কিছুতেই বেরোবে না।
শ্যামলী বলল, ওই কথাটাই আমি ম্যামকে একটু বলার চেষ্টা করেছি।
করবী বললেন, বলে উঠতে পেরেছিস্, না কি শুধু চেষ্টা করে গিয়েছিস?
শ্যামলী হেসে ফেলে বলল, উচ্চারণ তো করেছি। সহৃদয় মানুষ তো অনেক না বলা বাণীও শুনে ফেলে। আর যারা ঠিক ঠিক বলতে জানে, তারা কোনো কথাই না বলে অনেক কথা বলে যেতে পারে।
করবী বললেন, তা তোর পারসোনাল রিকোয়েস্ট উনি রাখলেন?
শ্যামলী বলল, ওঁর সমস্যা বা সীমাবদ্ধতার কথাটা বুঝিয়ে বললেন।
করবী হতাশা ব্যক্ত করে বললেন, শ্যামলী আমি বুঝতে পারলাম, ম্যামকে কি নিয়ে তুই রিকোয়েস্ট করেছিস, তা তুই আমাকে বলবি না। অ্যাম আই রাইট?
শ্যামলী বলল, না বলার মতো আহামরি কিছু একটা জিনিস নয়। আবার আমার প্রয়োজনটা অন্য পথেও মেটানোর উপায় যে নেই, তাও তো নয়।
করবী বললেন, যাক্, আসল কথাটা যখন আমার কাছে কিছুতেই ভাঙবি না ঠিক করে রেখেছিস্, তখন তোর কথা তোর কাছেই থাক। ও নিয়ে আমি কিছু নাই বা জানলাম!
শ্যামলী বলল, প্রিন্সিপাল ম্যামের সাথে কথা বলতে গিয়ে একটা বিষয় মনে পড়ে গিয়েছিল। সেই নিয়ে একটা দুটো কথা বলেছি।
করবী বললেন, কোন্ বিষয়টা মনে পড়েছিল?
শ্যামলী বলল, প্রাইভেসি। এই প্রাইভেসি জিনিসটা ব্যক্তি স্বাধীনতার একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সেট থিওরির ভাষায় প্রাইভেসি যেন লিবার্টির একটা সাবসেট। মানুষের সব রকম লিবার্টি যে প্রাইভেট স্পেসে কাজে লাগানো চলে তা নয়, কিন্তু কোনো কোনো লিবার্টি প্রয়োগ করতে গেলে প্রাইভেসিটুকু সুনিশ্চিত করতেই হবে। ব্যক্তি মানুষের শরীর ও মনের স্বায়ত্তশাসন বা অটোনমি বজায় রাখতে হলে, প্রাইভেসি একান্ত জরুরি শর্ত। জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেবার জন্য এই স্বায়ত্তশাসনটুকু দরকার হয়।
করবী বললেন, হ্যাঁরে, তোর এই বক্তৃতা শুনেই আজ ম্যাম তোর উপর এত খাপ্পা হয়েছিলেন, তাই না?
শ্যামলী বলল, কি জানি, আমার ওইসব কথাগুলো মাথায় খুব ঘুরছিল। তাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতে খুব তৃপ্তি পেয়েছি। প্রাইভেসি না থাকলে আসলে ব্যক্তির চিন্তার স্বাধীনতাটাই বিঘ্নিত হয়।
করবী বললেন, এত গুরুগম্ভীর সব কথা শোনালি, তবুও আমি বুঝতে পারলাম না, যে ঠিক কি নিয়ে ওঁর সাথে মতান্তর হল! যাক্, একান্ত না বলতে চাস , তো না বললি।
শ্যামলী মাথা নিচু করে রইল। করবী বললেন, হ্যাঁ রে, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? যদি অবশ্য তোর প্রাইভেসিতে না লাগে!
শ্যামলী বলল, আপনি আমার শিক্ষক। আপনার কিছু মনে হলে নিশ্চয়ই বলবেন।
করবী বললেন, আচ্ছা, তুই না কি বলেছিস, ম্যারেজ ইজ় এ লিগালাইজড প্রসটিটিউশন?
শ্যামলী ঠোঁট টিপে হেসে বলল, না, এ কথা আমি বলি নি।
করবী বললেন, দ্যাখ্, তোর এই কথা বলার খবরটা আমি যার কাছে পেয়েছি, সে কিন্তু খুব দায়িত্বশীল আর রেপুটেড লোক।
শ্যামলী বলল, না না, অরিন্দম দাশগুপ্ত তো যথেষ্ট সংবেদনশীল মানুষ। তিনি আপনাকে ভুল খবর কিছু দেন নি।
শ্যামলী বলল, কথাটা আসলে বার্ট্রাণ্ড রাসেলের। আমার নয়। আমি তাঁর বলে যাওয়া কথাটা উচ্চারণ করেছি মাত্র।
করবী বললেন, তা খামোকা তুই এই কথাটা খুঁজে বের করলি বা কেন, আর উচ্চারণ বা করছিস কেন?
শ্যামলী বলল, এক ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে আমার কাছে বিয়ের ব্যাপারে প্রস্তাব করা হয়েছে। আমি বিয়ের প্রস্তাবটা বাতিল করে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখার পক্ষে। সেই ব্যাপারে রাসেলের ওই কথাটা এসে গেল। এই কথাটা যে রাসেলের বলা, এটাও তো আমি অরিন্দমবাবুর কাছে বিশেষ ভাবে বলি নি। তাই উনি ভেবে ফেলেছেন, আমিই বোধহয় এসব বলছি।
করবী বললেন, বিয়ে জিনিসটা কিন্তু আমাদের দেশের মেয়েদের কাছে খুবই পবিত্র সম্পর্ক। তা তুই খামোখা রাসেলের এই কথাটা প্রচার করছিস কেন?
শ্যামলী বলল, শকুন্তলাকে দেখে খুবই পছন্দ হয়েছিল দুষ্যন্তের। তিনি কামাবিষ্ট হয়ে সচেতন ভাবেই সম্পর্ক করেছিলেন শকুন্তলার সাথে। যৌনমিলন হয়েছিল। আমরা সবাই জানি, কণ্ব মুনি শকুন্তলা যৌনসঙ্গম করে গর্ভবতী হয়েছে জানতে পেরে তাকে মা গৌতমী আর শার্ঙ্গরব ও শারদ্বত, এই দুই আশ্রমতরুণের সাথে দুষ্যন্তের রাজসভায় পাঠিয়ে দেন। কোনো অভিজ্ঞান না থাকায় শকুন্তলা দুষ্যন্তের পরিবারে এণ্ট্রি পেলেন না। সভায় সকলের সামনে ব্যঙ্গ করে শকুন্তলাকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। এদিকে কণ্বমুনির আশ্রমে শকুন্তলা আর ফিরতে পারলেন না। প্রেমিকের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে গর্ভবতী মেয়েটি বাবার বাড়িতে না ফিরতে পারলে, আর কোথায় তার ঠাঁই হয় বলবেন?
করবী বললেন, সত্যি, কি দু়ঃখের গল্প!
শ্যামলী বলল, ম্যাম, আজ যে মেয়েরা রেডলাইট এরিয়ায় নিজের মাংস বেচছে, জেনে রাখুন, তাদের অনেককেই বিয়ের নামে ফুসলে বের করে আনা হয়েছিল। বেশ্যা হয়ে একটা মেয়েও জন্মায় না ম্যাম, তাকে বাধ্য করা হয়।
করবী বললেন, মেয়েরা যে ইচ্ছে করে ওই পাড়ায় যায় না, তাদেরকে যেতে বাধ্য করা হয়, এ ব্যাপারে আমি তোর সাথে একমত। ওই মেয়েদের প্রতি আমার সহানুভূতিও আছে। কিন্তু, তা বলে গোটা বিয়ে ব্যাপারটাকেই নস্যাৎ করে দেবার মানে হয় না।
শ্যামলী বলল, আজ্ঞে, কিছু মনে করবেন না, খুব মানে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন নোবেল বিজয়ী ব্যক্তি। জগৎজোড়া খ্যাতি। সেই অবস্থায় মা মরা ছোট মেয়ে মীরা বরের হাতে মার খেতেন দেখে, কবি গোপনে চোখের জল ফেলতেন। কিছু করতে পারতেন না।
করবী বললেন, কিছু করতে পারার কথাও নয়, কেননা, সেই সব দিনে ডিভোর্স আইনটা চালু হয় নি।
শ্যামলী বলল, ম্যাম, আপনি একদম সঠিক জায়গাটা ধরেছেন। সেই সময় কবি জামাইয়ের হাতে ছোটমেয়েটার মারধোর খাওয়া দেখতে দেখতে বুক চাপড়ালেও স্রেফ ডিভোর্স আইনের অভাবে কিচ্ছুটি করতে পারেন নি। আজো অজস্র মেয়ে অনিচ্ছুক হয়ে, তিতিবিরক্ত হয়ে তবুও স্বামীর কামলালসা মেটাতে বাধ্য হয়। শুধু কোথাও গিয়ে দাঁড়াবার জায়গাটুকু নেই বলে, দুটো ভাত খেতে দেয় বলে, এই যে অনিচ্ছায় হলেও পাষণ্ড স্বামীর হাতে নিজের দেহ তুলে দেওয়ার এই বাস্তবতা আপনি অস্বীকার করতে পারেন?
শ্যামলীর ওজস্বিতার কাছে করবী চুপ করে থাকেন।
শ্যামলী বলে, বিয়েটা রেজিস্ট্রেশন করা দরকার। কিন্তু কটা বিয়ের রেজিস্ট্রেশন হয়ে ওঠে? কটা মেয়ে জানে যে, রেজিস্ট্রী না করলে কী সাংঘাতিক বিপদে তাকে পড়তে হতে পারে?
করবী তাকান শ্যামলীর দিকে। শ্যামলী বলে, যৌনমিলন করে দুষ্যন্ত একটা আঙটি দিয়েছিলেন শকুন্তলাকে। সেকালে তাঁর মতো রাজাদের হারেমে অনেক মেয়ে থাকত। দুষ্যন্ত এর আগে যে কত আঙটি কত মেয়ের কাছে বিলিয়েছেন, তার হিসাব নেই। গর্ভবতী শকুন্তলাকে তিনি বলেছিলেন, তুমি যে বলছ, আমি তোমার সঙ্গে শুয়েছি, তো তোমার কাছে ডকুমেন্ট কিছু আছে? দুষ্যন্ত অবশ্য ডকুমেন্ট বলেন নি, বলেছিলেন অভিজ্ঞান। শকুন্তলা প্রেমিকের দেওয়া আঙটিটা স্নান করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছিল। সে ভাবতেই পারে নি, তার প্রেমিক আঙটি দেখাতে না পারার দায়ে, তাকে ভরা রাজসভায় ব্যঙ্গ করে তাড়িয়ে দেবে।
করবী বললেন, জানি তো এ গল্প।
শ্যামলী বলল, আমরা সবাই সেই অসুখী বিবাহের সন্তান।
করবী ফুঁসে উঠে বললেন, সে কি কথা, আমরা সবাই সেই অসুখী বিবাহের সন্তান, একথা বলার যুক্তি কি?
শ্যামলী শান্ত গম্ভীর স্বরে বলল, ওঁদের সন্তানের নাম ছিল সর্বদমন ভরত। সেই ভরতের নাম থেকে ভারত শব্দটি এসেছে। আর বর্ষ মানে দেশ। আমরা ভারতীয়রা সেই সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর সর্বদমন ভরতের উত্তরপুরুষ।
করবী মাথা নিচু করেন। তাঁর চোখের কোণে একবিন্দু অশ্রু ঝিকিয়ে ওঠে।