সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শাশ্বতী নন্দী (পর্ব – ১২)

নিশিভোর

পর্ব – ১২

(১৭)

 তখনও আলো ফোটেনি আকাশে, গৌরীর ঘুম ভেঙে গেল একটা ঝমঝম শব্দে। যেন একটা ট্রেন খুব কাছ দিয়ে চলে যাচ্ছে। তড়িঘড়ি উঠে বসে সে বিছানায়। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মুহূর্তের জন্য  ভুলে গেল সে এখন কোথায়? একটু ধাতস্থ হতেই নজরে পড়ল পাশে, বিছানা ফাঁকা।
প্রশ্নটা ঘাই মারল মাথায়। অনুভব কোথায়? ঘুম চোখেই খুঁজতে থাকে সে। হাতড়ে হাতড়ে বেড সুইচ টিপে দেয়। নাইট ল্যাম্প জ্বলে উঠল। ঘরের অন্ধকারটা খানিকটা সরে যেতেই দেখে একটা জানলার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে অনুভব, হাতে সিগারেট।
    আলো পড়তেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। -‘উঠে পড়েছ? শরীর কেমন লাগছে এখন?’- বলতে বলতে সিগারেটটাকে জানলার বাইরে ছুঁড়ে দেয় অনুভব।
    -‘ভালো। তুমি ঘুমোও নি সারা রাত?’
    আধো অন্ধকারেও গৌরী স্পষ্ট দেখতে পায় অনুভবের এক ধ্বস্ত চেহারা।
    -না, ঘুম আর এলো কই। কাল রাতে একের পর এক ফোন,  তারপর যখন শুতে গেলাম, দেখি ঘুম টাটা বাই বাই।
    -ওমা, আমার মোবাইলে কোনও কল আসি নি! দাও দেখি ফোন। কাল যা কুম্ভকর্ণের ঘুম ধরেছিল চোখে।
    অনুভব মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে তার মাথায় হাত রাখে, ‘সত্যিই, কাল তোমায় দেখে বড্ড মায়া হচ্ছিল। যুদ্ধ জয়ের পর  একটা নিশ্চিন্ত ঘুম ছিল তোমার চোখে’।
অবাক হয় গৌরী, অনুভবের দৃষ্টিতে মায়া মায়া ভাব। দেখে ভাল লাগল। এইটুকুই তো চাওয়া! সামান্য একটু সহমর্মিতা, একটু ভালবাসা।
-যাক, এখন অনেক ফ্রেস দেখাচ্ছে তোমায়। – অনুভবের ঠোঁটে মৃদু হাসি, -যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে! আরে কী দেখছ? হ্যাঁ, অন কর মোবাইল। কাল ওটাকেও ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলাম। ওরও বিশ্রাম দরকার।
    -কী সর্বনাশ! – গৌরী বিরক্ত। – তুমি সুইচ অফ করে রেখেছ? আজ পর্যন্ত আমার ফোন কখনই বন্ধ থাকে না।
    মোবাইল চালু হওয়ার সাথে সাথে ঝাঁকে ঝাঁকে মেসেজ যেন লাইন ভেঙে কে কার আগে ঢুকবে, হুড়োহুড়ি শুরু করে দিয়েছে। টিং টং, একটানা আওয়াজ। ঝুঁকে সে মেসেজগুলো পড়ে চলে। হঠাৎ ভ্রু দুটো কুঁচকে গেল। অনুভবের দিকে মোবাইল বাড়িয়ে দেয়, -‘খবরটা দেখেছ?’
    স্ত্রীর দিকে না তাকিয়েই অনুভব বলে, ‘বাবার ব্যাপারে বলছ কি?  হ্যাঁ, শুনেছি। কাল রাতেই। বাবাকে আজ বোধহয় পুলিশ অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে থানায়। – কথা বলতে বলতে ও ফিরে যায় জানলায়।  ওর চোখ দুটো যেন অনেক দূরে যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
    গৌরীর ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, ‘জীবনের শেষ কটা দিন … ছিঃ মানুষটা কেন যে এ পথ বেছে নিলেন?
    -প্লিজ স্টপ দা ডিসকাশন। আমার কোনও কষ্ট হচ্ছে না কিন্তু। হি ইজ দা ক্রিয়েটর অফ হিজ অন ফেট। – বলতে বলতে হাঁপাতে থাকে অনুভব – আমি কোনদিন বাবাকে ক্ষমা করব না। মানুষটা চিরকালের জন্য আমাকে অপরাধী করে রেখে গেল’।
    এই প্রথম ওকে এতখানি ভেঙে পড়তে দেখল গৌরী। বিছানা থেকে আস্তে উঠে এসে অনুভবের পিঠে হাত রাখে, ‘কেন তুমি অপরাধী হবে? এরকম ভাবছ কেন?’
    -আমি ভাবা না ভাবার কে গৌরী? দুনিয়া ভাববে। আজকে সব কাগজের হেডলাইন হবে, জ্যোতিপ্রিয় সিনহা ইজ আ ক্রিমিনাল। সো, সো  …-অনুভবের গলাটা ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ, ‘সো, আই অ্যাম দা সন অফ আ ক্রিমিনাল। আ ভেরি ইজি ইকোয়েশন, ইজন’ট ইট? – অনুভব ডুকরে কেঁদে ওঠে।
    গৌরীর দিশেহারা লাগল। একটু জোর করেই সে বিছানায় টেনে এনে বসায় অনুভবকে। ছোট ছেলের কান্না যেমন করে সামলায় মা, ঠিক তেমনি করে সে, অনুভবের মাথাটা নিজের বুকে লেপ্টে রেখে ওর চোখের জল মোছায়।
তখনই জানতে পারে, অধিক রাতে ডি জি সাহেবও ফোন করেছিলেন অনুভবকে। কম কথার মানুষ তিনি, অল্প কথাতেই জোরালো কিছু কথা বক্তব্য শুনিয়ে দিয়েছিলেন। -আইন কিন্তু আইনের পথে চলবে। এ ব্যাপারে অনুভব, তুমি যেন বাধা হয়ে দাঁড়িয়ো না। তোমার বাবা যে এতবড় একটা হীন কাজে লিপ্ত হবে, আই কুডন’ট ইভেন ইমাজিন দ্যাট। ভাগ্যিস গৌরী তার সহজাত দক্ষতায় …
এরপরেই উনি ফোন ছেড়ে দেন। তবে সহকর্মীদের কাছ থেকে খবর আসে, জ্যোতিপ্রিয়র অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট তৈরি হচ্ছে। তাঁর গ্রেফতারের পেছনে অনেক চার্য বসানো হয়েছে। অন্যতম হল, গৌরী সিনহার খুনের চক্রান্তে শিব শম্ভুর সঙ্গে সহযোগীতা করা। তাঁর কুসুমপুরে  প্রাসাদোপম নির্জন বাড়িতেই হত্যার ছকটি কার্যকর করতে চেয়েছিলেন তিনি।
এসব থেকেই গৌরী বুঝতে পারে, গতকাল কুসুমপুরে তিনি আসেনই নি। যত কথা, যত ফোন, সব করে গেছেন কলকাতার বাড়ি বসেই।
ডিজি সাহেব লাইন ছাড়ার পর নাকি বারংবার জ্যোতিপ্রিয়র নম্বরও বেজে উঠেছিল। অনুভব রিসিভ করে নি। বুক মুচড়ে কান্না এসেছে, তবু সে কান্না মুছে নিয়ে ও নিজেকে শক্ত করে রাখে।
গৌরী অবাক, ‘সে কী ! এত সব কান্ড হল, আমি জানতে পারলাম না তো!’
-তুমি তখন ট্র্যাঙ্কুলাইজারের অ্যাকশনে অকাতরে ঘুমোচ্ছিলে। এক যুদ্ধ শেষে ক্লান্ত সেনাপতি। – বলতে বলতে গলা ধরে আসে অনুভবের। শুনতে শুনতে গৌরীর চোখেও জলপ্রপাত।
জানলার বাইরে ভোর তখন অল্প অল্প ফুটে উঠছে। দুটো হলুদ ল্যাজ ঝোলা পাখি থুপ থুপ করে হেঁটে বেরাচ্ছে সবুজ ঘাসে। ওদের গায়ে সূর্যের প্রথম আলো। ডানাগুলো মাঝে মাঝে ঝাপটে নিচ্ছে ওই গোলাপি আলোয়। পুরো গ্রামীণ পরিবেশ। দৃশ্যটা সুন্দর!
দেশের বাড়িটা দুলে উঠল চোখের সামনে। বাবা হাত ধরে ধরে বাগানময় ঘুরে বেড়াত আর শিশিরে ভেজা ফল, ফুল চেনাত। কিন্তু বাবার মুখটা আজকাল স্পষ্ট মনে পড়ে না গৌরীর, কেমন আবছায়া হয়ে আসছে ক্রমশ। আশ্চর্য! ঝুপ করে জ্যোতিপ্রিয়র চেহারাটা চোখের ওপর ভেসে উঠল কেন? অজান্তেই যেন একটা বিষাদের ছায়া পড়ল তার মুখে। ওঁকেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল বাবার মতো একজন বলে। কিন্তু কী ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রকারী এক মানুষ!
তবে জ্যোতিপ্রিয়কে কি সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পেরেছিল? তাহলে কেন কুসুমপুর আসার আগে, নিজের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিজেই করে নিয়েছিল? লোডেড পিস্তল সঙ্গে নিয়েই সে বেরোয় ঘর থেকে।
অনুভব কিছু একটা প্রশ্ন করছে বোধহয়। অন্যমনস্ক ছিল, শোনা হয় নি। তাই জিজ্ঞাসা করে, ‘কিছু বললে তুমি?’
-হ্যাঁ। – অনুভব নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়েছে এখন। – একটা কথা জানতে চাই। তুমি কিছু স্মেল করতে পেরেছিলে বাবার ব্যাপারে?
গৌরী মনে মনে হাসে, ঠিক একই কথা সে ভাবছিল এইমাত্র।  মাথা নেড়ে তাই সায় দিল, ‘হ্যাঁ, আমার সিক্সথ সেন্স কিছু একটা সিগনাল পাচ্ছিল।
    -তারপরেও এত বড় রিস্ক নিলে? স্ট্রেঞ্জ! কী ভেবেছিলে, তোমার জীবনের কোনও পিছুটান নেই? তোমার কিছু হয়ে গেলে, কারোর কিছু এসে যায় না?
    আজ অনুভব যেন পার ভাঙা নদী। সব কিছু ভেঙেচুরে ভাসিয়ে দিতে চায়। বাবার ভালবাসা হারিয়ে ফেলার অভিমানে কি নিজেকে ও নিঃস্ব ভাবতে বসেছে?
    গৌরী বুঝতে পারে, এ সময় অনুভবকে সব জানানো দরকার। তাই কথাগুলো কীভাবে শুরু করবে, গোছাতে থাকে নিজের মধ্যে। এর মধ্যেই দরজায় টকটক। চা নিয়ে এসেছে একজন। ব্রেকফার্স্ট কখন লাগাবে, জানতে চাইছে?
    -সকাল আটটার মধ্যে আমরা বেরিয়ে পড়ব। – অনুভব জানিয়ে দেয়। – তার মধ্যে ব্রেকফার্স্ট হলে ভাল, নইলে রাস্তায় কোনও ধাবায় ঢুকে সেরে ফেলা যাবে।
লোকটি চলে গেল।
    এর মধ্যে আর একটা ফোন ঢুকল, আশ্রমপুরের বড়বাবু। অনুভব হাসল, -‘গুড মর্নিং’।
-গুড মর্নিং স্যার। বলছিলাম কী, আমরা কিন্তু কুসুমভিলাকে সম্পূর্ণ ঘিরে রেখেছি ফোর্স দিয়ে। আপনি কি একবার আসতে চান এখানে? ভেতরে কোনও অস্ত্রশস্ত্র  লুকোনো আছে কিনা, দেখা দরকার। যে ধরনের ক্রিমিনাল ব্যাকগ্রাউন্ড এদের, কোথাও কোনও এক্সপ্লোসিভ রেখে দিতেই পারে।
-না আমি আর কোথাও যাব না। সোজা ব্যাক টু আওয়ার অন প্লেস, কলকাতা। আটটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ব।
-ম্যাডাম কেমন আছেন স্যার?
-বেটার । থ্যাঙ্কস ফর ইওর কনসার্ন।
    -ইটস মাই ডিউটি স্যার। আমি কি একবার দেখা করে যাব আপনাদের সঙ্গে?
    -থ্যাঙ্কু ভেরি মাচ। আসতে হবে না, আমরা ঠিক আছি।
    ফোন ছেড়ে অনুভব তাকায় গৌরীর দিকে, ‘তুমি কিছু বলতে যাচ্ছিলে অ্যাবাউট মাই ফাদার?’
    -হ্যাঁ – সামান্য দম নেয় গৌরী। -তোমাকে আগেই জানিয়েছিলাম  তোমার বাবা এবার কীরকম ডেসপারেটলি মেতে উঠেছিলেন  দুর্গাপুজা করার ব্যাপারে। এবং পুজোর দায়িত্ব সব নাকি আমার।  ওঁকে হার্ট করতে চাইনি, তাই সম্মত হয়েছি। কারণ এটা তাঁর জীবনের অন্তিম ইচ্ছে। তবে মনে একটা খটকা লেগেছিল। যে তুমি বাবার যে কোনও কথাকে আদেশ বলে মানো, সেই তুমিই ছিলে পুরোপুরি এই পুজোর বিরুদ্ধে। দুটো মানুষের এমন ইচ্ছার অমিল, সত্যি আমায় ভাবাচ্ছিল।
    অনুভব জানলার দিকে মুখ করে কথা শুনে চলেছে।
    গৌরী বলতে থাকে, ‘আমার মধ্যে দুটো সত্তা সব সময় কাজ করে। প্রয়োজনে আমি যেমন কঠোর, তেমনি কিছু বিষয়ে আই লিসন টু মাই হার্ট। মস্তিষ্কের চাইতে হৃদয়ের কথা বেশি শুনি। -বলেই, একটু বিরতি নেয় সে কথার মাঝখানে। -তোমার বাবার একটা কথাই বার বার কানে বাজত, বাড়িতে এই পুজো করার পরেই নাকি এক অশুভ শক্তির বিনাশ হবে, তাতেই ওঁর পরিবারের কল্যাণ। একটা ইঙ্গিত থাকত কথায়। অনেকবার কাটাছেঁড়া করেও ইঙ্গিতটা ধরতে পারতাম  না। তবে ক্রমে একটা বিষয় ক্লিয়ার হচ্ছিল, উনি নিজেও কোনও ব্যাপারে, আন্ডার থ্রেট। এমন কিছু তার সামনে এসেছে, যার জন্য তিনি ভীত, আতঙ্কিত। এবং এই ভীতিটা তাঁর ছেলের জন্যই বেশি। রিপিটেডলি বলে যেতেন, বেঁচে থাকতে থাকতে তিনি একটা ধবংসের বীজ উপড়ে ফেলে দিয়ে যেতে চান।
    অনুভব হাত তুলে গৌরীকে থামিয়ে দেয়, ‘তার মানে, তুমি বলতে চাইছ, বাবাকে এই ষড়যন্ত্রে সামিল হতে বাধ্য করা হয়েছে? কে? বাবাজী?’
    -অবশ্যই। তবে আমার ধারণা যে অমূলক নয়, তার প্রমাণ পেয়ে গেলাম যখন …
    -যখন সুমনার খামটি পেলে। রাইট? – অনুভব অন্যদিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
    অবাক হয় গৌরী, ‘রাইট। বাট হাউ ডিড ইউ নো? সুমনার খামের ব্যাপারে তুমি জানলে কীভাবে?
    -সিম্পল গেসওয়ার্ক। প্লিজ ক্যারি অন।
-সুমনা এমন কিছু ফটোগ্রাফ আমায় পাঠিয়েছিল, যেখানে বাবাজীর সঙ্গে তোমার বাবার ঘনিষ্ঠতার বেশ কিছু ছবি হাতে পেলাম।  বহু অনুষ্ঠানে দুজনকে পাশাপাশি বসতে দেখা যায়, কখনও বা আড্ডায় মশগুল কোনও ক্লাব পার্টিতে। এরপরেও আমার জানার প্রয়োজন ছিল, ঘনিষ্ঠতাটা এখনও অটুট কিনা। দেখলাম তার প্রমাণও  সুমনা পাঠিয়ে দিয়েছে কয়েকটা ফোন কল লিস্টে এবং সেগুলো অথেনটিক।
    -মাই গুডনেস! এত কিছু জেনেও একা হাতে ফিল্ডে নেমে পড়েছিলে, আর ইউ ম্যাড?
    গৌরী হাসে, ‘আসলে নিজেকে নিজের কাছে প্রমাণের দায় মাথায়  চেপে বসেছিল। চারিদিকে তখন আমার অসফলতার সেলিব্রেশন চলছে, প্রথমে ব্লু হেভেন মিশন, তারপর কমপালসারি ওয়েটিং, আমায় কোণঠাসা করে দিতে সবাই যেন মাঠে নেমে পড়েছে, ইনক্লুডিং ইউ। হ্যাঁ, তুমিও।
    বলেই গৌরী মাথা নামিয়ে নেয়। কথাগুলো এ সময় হয়তো কর্কশ, অপ্রিয় শুনতে তবু সোজাসাপটা কথায় সে অভ্যস্ত।
    অনুভব হাসছে, ‘আমায় তো চিরকালই তুমি অপোনেন্ট ভেবে গেলে, আ রাইভ্যাল। রাইট?- হাসিটা বড্ড করুণ দেখাল।
    গৌরী নীরব।
-আসলে, তুমি কোনদিনই আমায় চিনতে পারো নি, হয়তো চাও-ও নি। একটা অদৃশ্য প্রতিযোগীতায় সব সময় তোমার পাশে আমায় দাঁড় করিয়েছ। – আর একটা সিগারেট ধরাল অনুভব। -শোন, আজ যখন দুজনের কথা আর কাজের চুলচেরা হিসেব চলছেই, আমিও না হয়, আমার খেরোর খাতাটা খুলে দিই সামনে।
    অনুভব পেছনে হাত মুঠো করে ঘরের এ কোণ থেকে ও কোণে পায়চারি শুরু করল। -‘ব্লু হেভেন মিশনের লিড রোলে তোমার নাম ঘোষণা হতেই বাবাজী তোমার মাথার দাম ধার্য করে ফেলল। অঙ্কটা খুব কম নয়, বেশ কয়েক লক্ষ টাকা। এবং সোর্স খাটিয়ে জানা গেল, শুধু তোমারই নয়, তোমার ঘনিষ্ঠ সবারই নাম ধাম ওদের খাতায় উঠে গেছে। কিন্তু তোমাকে আটকাবার ক্ষমতা তো আমার নেই। তুমি উচ্চাকাঙ্খী, খানিকটা ক্ষমতা ও যশ লোভী। সো, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না ভেবেই আঙুল বাঁকাতে হল। আমি দার্জিলিং পোস্টিংয়ের জন্য অ্যাপ্লাই করলাম। এই সময় দার্জিলিং জ্বলছে। মানুষ বাঁচতে দূরে সরে যেতে চাইছে। সেখানে আমি স্বেচ্ছায় … অতএব প্রপোজাল অ্যাকসেপটেড।
-দার্জিলিং গিয়েই আমার প্রথম কাজ হল, আরও কিছু সোর্স হান্ট করা। এবং জানলাম খবর সত্যি, তোমার নাম বাবাজীর হিট লিস্টে। এরপর আমাকে একটা অনৈতিক কাজে নামতে হল। অরিন্দম পালকে হাত করা। কিছুতেই যাতে তোমাকে ব্লু হেভেনে ছাড়া না হয়। অরিন্দম নিজের স্বভাব অনুযায়ী ভেবে নিল, এটা আমাদের হাজব্যান্ড ওয়াইফের ইগো ফাইট। সুতরাং সঙ্গে সঙ্গে ও ময়দানে নেমে পড়ে। এমনিতেই তোমার ওপর ওর বিষ দৃষ্টি ছিল। সুতরাং দুইয়ে দুইয়ে চার।
গৌরী হতবাক। ব্লু হেভেনে তার পথ আটকাবার পেছনে অরিন্দম এবং অনুভব, দুজনেরই হাত আছে, এমন সন্দেহ আগেই দানা বেঁধেছিল। কিন্তু কারণটা এই, ভাবতেই ভেতরটা কুঁকড়ে গেল।
-সত্যটা জেনে তুমি কি কষ্ট পাচ্ছো গৌরী? – অনুভব হাসে। – এখানেই কিন্তু গল্প শেষ নয়। আরও আছে। মিশন অসফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অরিন্দম অতি উৎসাহে এক কদম এগিয়ে মিডিয়া এবং আরও কিছু কিছু জায়গায় তোমার নামে অপপ্রচার চালিয়ে গেল।  এবং কাজটায় হানড্রেড পারসেন্ট সফলও হল। সঙ্গে সঙ্গে হেডকোয়ার্টার তোমায় কমপালসারি ওয়েটিংয়ে পাঠিয়ে দিল।
অরিন্দম সিগারেটের ধোঁয়া এবার রিং করে ছুঁড়ে দিতে থাকে বাইরে,-মিথ্যে বলব না, আমি খানিকটা নিশ্চিন্ত হলাম। যাক, তোমার ফাঁড়া আপাতত কেটেছে, বাবাজী এবার অন্তত ব্যাক গিয়ার টানবে। ঠিক তখনই একটা কথা হাওয়ায় ভেসে এল। গৌরী সিনহা চাকরি থেকে রিজাইন দিচ্ছে। আমি জানি না, সত্যিই এমন কোনও সিদ্ধান্ত তুমি নিয়েছিলে কিনা। কিন্তু বিশ্বাস কর, মনে মনে চাইছিলাম, তুমি এভাবে পরাজিত হয়ে লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ো না। একদিন চাকা ঘুরবেই।
গৌরীর ভেতরে যে অভিমানের চারা-গাছটা জন্ম নিয়েছিল, সে আবার মাথা তুলতে চাইছে। এমন করে কোনও ভরসার কথা কি আগে কখনও বলেছে অনুভব? নাকি বলেছে, সে বুঝতে পারে নি। তবে এটা সত্যিই, লড়াই করতে করতে গৌরী যখন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, বার বার আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে নির্ভরশীল একটা হাত, পায় নি তেমন কোনও হাত।
    একবার চাকরি ছাড়ার কথাও তার মাথাতে চেপে বসেছিল। কিন্তু বাধা দিয়েছে তিনটি মানুষ। রোহিত, হরিবাবু আর সুমনা। সুমনাই বলেছিল, এই ভন্ড সাধকের কাছে শেষে হার মানবে তুমি? জানো এর ফল কী? শত শত ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দেওয়া।  তারা এ ধরনের ভন্ড সাধকদের দেখে ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলবে। নির্ভরশীলতা কমে আসবে। কথাটা মনে লেগেছিল। রেজিগনেশন লেটার লিখেও সে ছিঁড়ে ফেলে কুটি কুটি করে।
    অনুভব আবার বলতে শুরু করেছে, ‘আমার কাছে হঠাৎ খবর এল, পুজোর আগেই বাবাজী কলকাতায় চলে আসছে। এবং খুব বড় একটা নাশকতার ছক নিয়েই সে আসছে’।
    এটা কীভাবে সম্ভব? গৌরী হঠাৎ যেন ধাক্কা খায়। বাবাজীর এত ভেতরের খবর অনুভবের পক্ষে জানা কীভাবে সম্ভব? তাহলে কি ওই আশ্রমের কারোর সঙ্গে ওর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ যোগাযোগ আছে?
       -গৌরী, এ কারণেই আমি পুজোটা এবার দেশের বাইরে কাটাতে চেয়েছিলাম। কোনরকম রিস্ক নিতে চাইনি। জানতাম, বাবাজীর টার্গেট কখনও মিস হয় না। আমার মন বলছিল, ও তোমার খোঁজেই এবার কলকাতায় পাড়ি দিচ্ছে। ওদিকে বাবাও অ্যাডামেন্ট, ঘটা করে এবার দুর্গাপুজো করবেই এই কুসুমপুরের বাড়িতে। তুমিও তাতে সায় দিয়েছ। বুঝলাম তোমাদের আটকানো যাবে না। উপায় না দেখে ছুটি চাইলাম অথরিটির কাছে, গ্র্যান্ট হল না ছুটি। এমন কী বাইরে যাওয়ার প্রোগ্রামটাও ক্যানসেল করতে বলা হল। তখন একমাত্র ভরসা আমাদের ডিজি সাহেব। আদ্যোপান্ত সব ওঁকে  জানালাম। শুধু বাবার কথাটা সাবধানে এড়িয়ে গেলাম। হাজার হলেও আমার বাবা যে।
    এবার অঙ্কটা ধীরে ধীরে সরল হতে থাকে গৌরীর কাছে। অনুভব আগেই কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছিল। এবং ডিজির অনুমতি পেয়েই সে ফোর্স সঙ্গে নিয়ে কুসুমপুরে তৈরি হয়ে আসে। ওদিকে রোহিতের কাছেও কুসুমপুরের রুট ম্যাপ থাকায় তার পৌঁছতে কোনও অসুবিধা হয় না।
    -বাবাজীকে চেজ করতে করতে তুমি জায়গা মতো পৌঁছে গেলে,  চাইলে তো তুমি নিজেই পারতে ওকে গ্রেফতার করতে। করলে না কেন?
    অনুভব হাসল । -‘তোমাকে যে উইনার দেখতে চেয়েছি। এত বড় ফাইটার তুমি, যুদ্ধে তোমার জিত হতেই হবে’।
গৌরীর মাথাটা এবার ঝুঁকে আসে বুকের কাছে। নিজেকে সত্যিই তার অপরাধী লাগছে।
-তবে জানো গৌরী, বাবাজীর মতো অমন ধূর্ত একজন লোক যে এমন একটা সহজ খেলায় মাতবে, বিশ্বাস হচ্ছিল না প্রথমে। তাই আমি আগে থেকেই অনেক সাবধানতা নিয়ে রেখেছিলাম। তুমি কুসুমভিলায় পৌঁছনোর আগেই আমার লোকেরা চারিদিক ঘিরে রেখেছিল। তবু তুমি যেভাবে ওর সঙ্গে লড়ে গেছো সামনা সামনি, – কুর্নিসের ভঙ্গীতে একটা হাত তোলে অনুভব,- আই স্যালুট ইউ। তুমি সত্যি আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন যোগ্য অফিসার।
    বাইরের দরজায় আবার শব্দ। -ব্রেকফার্স্ট তৈরি হয়ে গেছে স্যার। আমি কি টেবিল লাগাব?
    গৌরী মোবাইলের দিকে তাকায়, ‘ওমা, এত বেলা হয়ে গেল। আমি যে ফ্রেসই হই নি এখনও। আধ ঘন্টা বাদে খাবার লাগাও ভাই,  আমরা ডাইনিংয়ে আসছি।
    আশ্রমপুর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে আসতে বেলা গড়িয়ে গেল। রাস্তাতেও টুকটাক কথা চলছিল ওদের মধ্যে। বেশ নির্ভার লাগছে। অনেকদিন পর যেন একটা স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে এসেছে।
    হঠাৎ ডিজি সাহেবের ফোন, গৌরীর মোবাইলে।
    -কনগ্র্যাচুলেশন গৌরী। ইউ হ্যাভ ডান আ ওয়ান্ডারফুল জব। চেয়েছিলাম আমার রিটায়ারমেন্টের আগেই এই রাজ্য থেকে বাবাজীর এপিসোডটা শেষ হোক। ইউ মেড ইট। আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ।
    গৌরী আপ্লুত, ‘থ্যাঙ্কু ইউ স্যার’।
    -শোন, আগেই অ্যানাউন্সমেন্ট করে দিচ্ছি, রাজ্য পুলিশের তরফ থেকে তোমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে তোমার এই আউটস্ট্যান্ডিং কাজের জন্য। রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রী সবাই থাকবেন ওই অনুষ্ঠানে।
    গৌরী যেন কথা হারিয়ে ফেলেছে, দু চোখে ভরে উঠছে নোনা জল। -‘আই অ্যাম অনার্ড স্যার’।
    ডিজি সাহেব একটু থামলেন, ‘এবার একটা দুঃসংবাদ তোমাকে শুনতে হবে। প্লিজ ভেঙে পড় না যেন। জ্যোতিপ্রিয় সিনহা কমিটেড সুইসাইড। একটা সুইসাইড নোট তিনি রেখে গেছেন। অনুভবকে ফেস করতে আমার কষ্ট হচ্ছে, তাই তোমাকেই জানালাম’।
    হাত দুটো কেঁপে ওঠে গৌরীর। ফোন ছেড়ে অনুভবের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কিছু আঁচ করতে পারে বোধহয় ও। বলে, -কী, কিছু হয়েছে নাকি কারোর?
    গৌরী নির্বাক। অনুভব ঝাঁকুনি দিতে থাকে, ‘অ্যাই, কী হল? বাবার কোনও খবর? কী হয়েছে বাবার?’

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।