নেমিনাথ রহস্য দুই বন্ধু সাবির আর সুবীর । পড়ে ক্লাস সেভেনে। একজনের ক্রিকেটের শখ, আর এক জনের ব্যাডমিন্টনের নেশা। এক জন বিজ্ঞানের প্রতি টান আর এক জনের ইতিহাসের প্রতি টান।কলকাতার কাছেই মফসোলে তাদের বাড়ি। দুই জন এক সাথে স্কুল যায় আবার এক সাথেই ফেরে । দুজনের দুটো সাইকেল আছে। সাইকেলটা তাদের প্রাণাধিক প্রিয় । আর প্রিয় হবে নাই বা কেনো? স্কুল, টিউসান, আড্ডা দেওয়া, বে পাড়ার অল্প চেনা বান্ধবীর বাড়ির সামনে চক্কর কাটা, সবই তো সাইকেলের সাহায্যেই হয়।
এখন বাজে বিকেল চারটে। আজ শনি বার হাফ ডে। দুপুরে বাড়িতে এসে ভাত খেয়ে, একটু জিরিয়ে, ওরা সাইকেল নিয়ে এলাকা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছে। জায়গাটা ওদের গ্রাম থেকে আরো দুটো গ্রাম পেরিয়ে যেতে হয়। এদিক টা একটু নির্জন। লোক জন কম। এখন ভরা বসন্ত কাল। বাদায় এখনও পাকা ধান তোলা বাকি। তবে কোনো কোনো চাষী ধান তুলে নিয়ে মাথায় করে বাড়ি ফিরছে। এই জায়গাটা সোনারপুর এর চন্দন ইট খোলা অঞ্চল। ইট তৈরির বিশাল চিমনি টা আছে। তবে লোক জন নেই। এখন আর ইট তৈরি হয়না! পাশেই আছে পুরনো আমলের একটা পুকুর। জমিদারি আমলের মত শান বাঁধানো। তবে ভেঙে গেছে। আসে পাসে ঝোপ ঝাড়ে ভর্তি। ওই বললাম এলাকা টা শুনশান। ইটের কারখানা যখন চালু ছিল শ্রমিকরা ছিল তবুও এখানে, লোকজন তখন ছিল। এখন তারা নেই।
দুই বন্ধু সাবির আর সুবীর। সাইকেল দুই খানা স্ট্যান্ড করে রেখে হাত পা ধুয়ে, চটি গুলো খুলে রেখে গল্প করছে। সাবির বলল। ওর বাবার কাছে থেকে শোনা। এখানে এক কালে ঢিবি ছিল। সে কোন কালের কেউ বলতে পারতো না।এখন সেই ঢিবি গুলো আর নেই। সাবিরের বাড়ি বেনেবৌ গ্রামে আর সুবীরের বাড়ি সাউথ গরিয়া গ্রামে। দুটোই আসে পাশের গ্রাম।
সাউথ গরিয়া গ্রামে একটা একটা চা এর দোকান আছে।দিব্যেন্দু কাকা সেখানে আসে। কাকার একটা বইএর দোকান আছে কলেজ স্ট্রীটে। সাবির – সুবীর দুজনেই দিব্যেন্দু কাকা কে চেনেন। দিব্যেন্দু কাকা এলাকার ইতিহাস টুক টাক লেখেন , কখনো দেওয়াল পত্রিকায় কখনো কোনো এলাকার লিটিল ম্যাগাজিনে। দুই বিচ্ছুকে দেখে দিব্যেন্দু কাকা ডেকে চা আর বিস্কুট খাওয়ালেন। দুজনের খোঁজ খবর নিলেন। কথায় কথায় সাবির বললো আমরা আজ চন্দন ইট খোলায় বেড়াতে গেছিলাম। দিব্যেন্দু কাকা বললেন ।তোমার জানো কি ওখানে এক কালে মানে প্রাচীন ভারতের বসতি ছিল। সাবির বলে উঠলো কাকু আমার বাবার কাছে থেকে শুনেছি ওখানে এক কালে ঢিবি ছিল। হুম এই ঢিবি প্রাচীন ভারতের জানা যায়! বিচ্ছুদের একজন বললো ওমা সে কি! বাড়ির কাছেই প্রাচীন ইতিহাস! তাহলে তো ভালো করে জায়গাটা ঘুরতে হয়। দিব্যেন্দু কাকা উৎসাহ দিয়ে বললেন এই বয়েসেই তো তোমরা ঘোরা ঘুরি করবে।
যেমন কথা তেমনি কাজ আজ রবিবার। ছুটির দিন। সাবির সুবীর প্ল্যান করেছে, আজ চন্দন ইট খোলার কাছে যে পুকুরটা আছে সেখানে সাঁতার দিয়ে স্নান করবে। সুবীর বললো আমি সাঁতার ভালো জানিনা, ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্নান করবে। আর সাবির তো এক্সপার্ট সাঁতারু। দুজনেই স্নান করতে এসেছে সম্বল বলতে দুজনের দুটো গামছা আর সাইকেলটা ত কমন।
সুবীর ঘাটের কাছেই গলা ডুবিয়ে আছে। আর সাবির কখনো ডুব সাঁতার কখনো চিৎ সাঁতার। মাঝ পুকুরে গিয়ে সাঁতারের কেরামতি দেখাচ্ছে।পুকুর টা খুব গভীর নয় তবে জায়গাটা বেশ নির্জন এই পুকুরে গ্রামের লোকেরাও বিশেষ আসেনা। এমন সময় ঘাটের কাছে সবিরের পায়ে একটা শক্ত মতন কি একটা ঠেকলো! কৌতূহল বেড়ে গেলো। সাঁতার অবস্থায় মনে হলো এটা পাথরের মতন। তবে একটা পাথর নয় দুটো পাথর। একটা দেড় ফুট মতন আর একটা ছোট্ট ইটের ডেলার মতন। ইটের ডেলা ডুব সাঁতার দিয়ে তুলে ফেললো। ওমা এত ইট নয়! বেশ পালিশ করা কালো পাথর। সাবির আবারো ডুব সাঁতার দিয়ে বাকি পাথরটা তুলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুতেই পারলো না। শেষে একটা গামছা দিয়ে তোলার চেষ্টা করলো। অনেক টা ঘাটের কাছে এলো। এবার দুজনের গামছা আরো লম্বা করে দুজনেই চেষ্টা করে তুলে ফেললো। এটা একটা মূর্তি। জলের প্লবতা থাকায় তখন মূর্তিটা এতো টা ভারী মনে হয় নি। এখন বেশ ভারী মনে হচ্ছে। দুজনে জম্পেশ করে গামছা দিয়ে সাইকেল কেরিয়ারের সাথে
মূর্তিটা বাঁধলো। দুজনে প্রথমে ভেবেছিল মূর্তিটা যেখানে ছিল সেখানেই ফেলে রেখে চলে যাবে। এমন সময় এক কাঠ কুড়ানি বুড়ি এলো।সে দুর থেকে দেখেছিল দুই বিচ্ছু শানের ঘাট থেকে কি একটা ধরা ধরি করে সাইকেলে বাঁধছে। কাছে এসেই প্রণাম। কাঠ কুড়ানি বুড়ি বলে উঠলো এতো শিব ঠাকুর!
মূর্তি টা সাবিরের বাড়িতেই এনেছে। এদিকে লোক জানাজানি হয়ে গেছে। প্রায় সবাই বলছে এটা শিব ঠাকুর। কেউ কেউ বলছে পুলিশে খবর দেওয়া দরকার। কেউ কেউ বলছে এতো দেশের সম্পত্তি। বাড়িতে রাখা যায় না।এমন সময় দিব্যেন্দু কাকা এসে হাজির। তিনি এসে বললেন এটা শিবের মূর্তি হতেই পারেনা। এমন কি কোন হিন্দু দেব দেবীর মূর্তিও না! সাধারণ মানুষ তো শুনে অবাক হলো। দিব্যেন্দু কাকু কলকাতা বিশ্ববদ্যালয়ের এক বন্ধু অধ্যাপকের কাছে মূর্তিটির হোয়াটস অ্যাপ করে পাঠালেন। কথা হলো সাবির ,সুবীর এই দুই বিচ্ছু ও তাদের স্কুলের ইতিহাসের মাস্টার মসাই আর দিব্যেন্দু কাকু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলিপুর ক্যাম্পাসের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে মূর্তিটা জমা দিতে যাবে।
সেই মত ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলো।জীবনের প্রথম কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে ওরা পা দিলো! পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম।। গবেষকরা সিদ্ধান্ত নিলেন এই মূর্তি নেমিনাথের। আর এই মূর্তি আদি মধ্য যুগের।এই আদি মধ্যযুগ হলো ছয়শ পঞ্চাশ থেকে বারোশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তখন দেশে কোনো বড় সাম্রাজ্য ছিল না। একেই রমশরণ শর্মা বলেন সমন্ততন্ত্রের যুগ।কিন্তু কে এই নামিনাথ? ইনি হলেন বাইস তম জৈন তীর্থঙ্কর! প্রধান গবেষক বিচ্ছু দুটিকে পাশে বসিয়ে সংবাদ মাধ্যম কে বিবৃতি দিচ্ছিলেন। গবেষক এর কথায় : এই মূর্তি হলো অত্যন্ত বিরল। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগর অঞ্চলে একটা বনেদি বাড়িতে এই এরকমই একটা মূর্তি শিব ঠাকুরে/ কুলদেবতা হিসাবেই পূজিত হন। আসলে ওটাও নেমিনাথের ই মূর্তি। এক কালে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা বৌদ্ধ ,জৈন সংস্কৃতির প্রভাব ছিল, প্রাপ্ত মূর্তিটি তারই প্রমাণ। আর হ্যাঁ , ওই বিভাগীয় প্রধান এই মূর্তির আবিষ্কর্তা হিসাবে দুজনকেই কৃতিত্ব দিলেন।
পরের দিন সকালে খবরের কাগজের বিচ্ছু দুটোর খবর বেরিয়েছে।আগের দিন টিভিতেও দুজনের খবর দেখা গেছিলো। ওরা এখন পাড়া আর স্কুলের হিরো!