• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় অলোক মুখোপাধ্যায়

ঘুমের ঘোরে

মাঝ রাতে ঘুম কেন ভাঙিয়ে দিচ্ছ বলতো?এই নিয়ে দুদিন হ’ল।না আজ আমি তোমার ছবির সামনে কিছুতেই দাঁড়াব না।আগের দিন কনফেস করলাম তাতেও হচ্ছে না।এবছর তোমার মৃত্যু তিথিতে মালা না দিই গাছের টগরফুল তো দিয়েছি।তোমার বৌমা যত্ন করে ভাগ্যিস গাছটা লাগিয়েছিল।সতেরই কার্তিক তোমার জন্মদিনে ভুল হবেনা,ভালো মালা এনে ছবিতে পরাবো।প্লীজ এবার ঘুমোতে দাও।
-বুবুন কে তোরা কেউ দেখলি না রূপক।তোদের সবার ছোট ভাই।ভাব-ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে পারলি না।অকালে ঝরে গেল।
সব দায় কি আমার একার?
-তোর একার কেন, তোদের সবার।তবে কর্মক্ষেত্রে এবং প্রশাসনে তোর যথেষ্ট প্রভাব ছিল। তুই কিন্তু পারতি বুবুন কে কোথাও ঢুকিয়ে দিতে।
ওহ, ঘুরে ফিরে সেই এক কথা।ওর কোনো চেষ্টাই ছিল না।আজ এখানে তো কাল ওখানে।ইন্সিওরেন্স এজেন্ট হয়ে ভালোই কাজ করছিল,দুম করে ছেড়ে দিল।চাকরির পরীক্ষার ফর্ম এনে দিয়েছি। মেজদি স্টাডি মেটিরিয়াল এবং বই কিনে দিয়েছে।কোন দিন খুলেও দেখেনি।পরীক্ষার কল-লেটার আসলে তখন হুটোপাটা লাগিয়ে দিত।সাতদিন রাত জেগে পড়লাম আর সারাবছর কোন পারফরমেন্স অথবা প্র্যাক্টিস নেই। এভাবে হয় না।
-কিভাবে কি হয় তোর কাছে শিখব না রূপক। আমার সময় টেলিফোনে জাস্ট একটা সুপারিশ করলেই কত কি হয়ে যেত।হাসপাতালে বেড নেই, রুগী ভর্তি হচ্ছে না।বাড়ির লোক আসছে না দেখে সুস্থ পেশেন্টকে ডিসচার্জ করা যাচ্ছে না।থানা পুলিশ ধরে রূগীর বাড়ির লোক আনিয়ে পেশেন্ট ছুটি দিয়ে বেডের ব্যবস্থা করেছি।নয়নকে তোর মনে থাকার কথা নয়।মেজদির কাছে জেনে নিস।গরীব ঘরের ছেলে।শিক্ষাগত যোগ্যতা খুব ভালো ছিল না কিন্তু ছবি তোলে অসাধারণ।ইন্টারভিউতে ওকে বাদ করে দেবে আমি জানতাম। ইন্টারভিউ চলাকালীন ফোন করে বোর্ড মেম্বারদের বলেছিলাম “ছেলেটির রেজাল্ট দেখবেন না।ফটোগ্রাফি নিয়ে যতখুশি প্রশ্ন করুন।দরকার হলে এক্সরে মেশিনে প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষা নিন”।নয়ন আমার মুখ রেখেছিল বুঝলি রূপক।ওরকম কত নয়নের চাকরী …
কি হ’ল থেমে গেলে কেন? ঘুম যখন আর হবেই না তখন বলে যাও। একটানা অনেক কথা বলেছ, একটু না হয় জিরিয়ে নাও।এবার আমি বলি তুমি শোন।আচ্ছা তোমার মনে আছে আমার তখন ক্লাশ এইট।সকাল থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। অফিস যাবার আগে তুমি আমায় স্কুলে যেতে নিষেধ করলে।রেনি-ডে প্যারাগ্রাফ লিখতে আদেশ দিয়ে গেলে।সারাদিন বসে খাতায় লিখছি আর কাটছি।গ্রামারে খুব ভুল করতাম।তোমার একটা কথা মনে পড়ে গেল।ছোড়দাকে তোমায় বলতে শুনেছিলাম “জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রথম সুযোগেই নিজেকে পারফেক্টলি এক্সপোজ করতে চেষ্টা করবি”।রেনি-ডে প্যারাগ্রাফ লিখতে গিয়ে সেটা মাথায় রেখেছিলাম।শুরুটা করলাম এই ভাবে “রেইনি ডে মীনস আ ডে হোয়েন রেইন ফলস হেভিলি”।ব্যাস, তারপর কিছু ভাবতে হয়নি। কোন যাদুমন্ত্র কাজ করেছিল কে জানে!কাকভেজা হয়ে সন্ধ্যার পর ঘরে ঢুকে জামা কাপড় ছেড়ে তুমি বিছানায় বসতেই খাতা এগিয়ে দিলাম।চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে খাতা তুলে নিয়ে আমায় বাইরে যেতে আদেশ দিলে।পাশের ঘরে চলে এলাম। ছেলেমেয়ের প্রশংসা কোনদিন তুমি সামনাসামনি করতে না। জীবনে এই প্রথমবার তুমি আমার লেখাপড়ায় দৃষ্টি দিলে।খুব ভয় করছিল। আড়াল থেকে শুনেছিলাম তুমি মেজদিকে ডেকে বললে-“রূপকের দিকে একটু খেয়াল করিস রে মাধু।সামান্য কিছু ভুল থাকলেও বেশ গুছিয়ে লিখেছে”।
-হাঁ আমি স্বীকার করছি তোমাদের লেখাপড়ার দিকে সেভাবে নজর দিতে পারিনি।বিশেষতঃ তুমি, তোমার ছোড়দি এবং ছোটভাই বুবুন।
না আমি তোমার এই কথা সবটা মানতে পারছি না। ছোড়দি এবং আমি কোনদিন নতুন বই পাইনি কিন্তু বুবুন ছোট থেকেই নতুন বই পেয়েছে।ওর সব আহ্লাদ আবদার তো্মরা মিটিয়েছ।
-কেন একথা বলছিস রূপক।তোর মেজদি চাকরীতে ঢোকার পর সংসারে কিছুটা সুরাহা হ’ল দেখেই তোদের লেখাপড়ার দিকে খরচ বাড়াতে পেরেছিলাম।নন্দ মাস্টারকে রাখলাম তোদের টিউশন দেবার জন্য।
সেতো মাত্র একবছর। তার পরেই তো শুরু হ’ল বোমা গুলির লড়াই।নন্দ মাস্টার ভয়ে পড়ানো বন্ধ করে দিল।ক্লাস নাইনে অ্যানুয়াল পরীক্ষা হ’ল না, অটোমেটিক প্রমোশন।ছোড়দার মেডিকেল থার্ড ইয়ার।সি আর পি মিলিটারির খানা তল্লাশি চলছে।হাজরা রোডে পিসির বাড়িতে ছোড়দাকে চালান করে দিলে যাতে পড়াশুনার ক্ষতি না হয়। ছোড়দার ব্যাপারে তুমি এবং মা দুজনেই খুব বেশি্রকম কেয়ারিং ছিলে।অফিস থেকে ফেরার সময় পরিচিত ডাক্তারদের সংগ্রহে থাকা অ্যানাটমি, ফিজিয়োলজির মোটামোটা বই টেনে আনতে ভীড় বাসে।
-তোদের সবারই সেই এক অভিযোগ।রেগুলার সিলেবাসের বই কিনে দিতেই কালঘাম ছুটে যেত। রেফারেন্স বুক দু চারটে আমায় কালেক্ট না করে উপায় ছিল না। সেই সময়ে এত বড়ো সংসারে একজন কে ডাক্তারি পড়ানো খুব সহজ ছিল না রূপক।আমি জানি তোর একটা অভিমান আছে।বি-কম পাশ করে তুই ল’ পড়তে চেয়েছিলি।আমি পারিনি।তোমাদের তিন দিদির বিয়ে দিয়ে আমার কানাকড়ি প্রায় শেষ।সামান্য সঞ্চয় রেখেছিলাম তোর ছোড়দির জন্য।মারণব্যাধিতে আক্রান্ত না হলে ওর বিয়েটাও দিয়ে দিতাম। বেঁচে থাকলে বুবুনকে কোন না কোন জায়গায় ঠিক এনগেজ করে দিতাম।
তুমি অসময়ে চলে যাওয়ায় কষ্ট হয়েছিল খুব।কিন্তু পরে অনেক ভেবে দেখেছি তোমার চলে যাওয়া একদিকে ঠিক ছিল।সন্তানের মৃত্যুশোক সহ্য করা কি কঠিন বুঝেছিলাম দাদুকে দেখে।তুমি যাবার দুবছর আগে দিদু চলে গেল।কষ্ট হলেও দাদু সামলে নিয়েছিল।কিন্তু তোমার দেহ বাড়ির উঠোনে আনার পর দাদুর কি আক্ষেপ এবং যন্ত্রণা হয়েছিল স্পষ্ট মনে আছে।ঠিক আট মাসের মাথায় দাদু চলে গেল।খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করলেন।সেজন্যই বলছি তুমি চলে যাওয়ায় ভালোই হয়েছে।মাকে দেখেছি তো, দাদা এবং বুবুন মারা যাবার পর মা যে কদিন ছিলেন কি অবর্ণনীয় শোক সহ্য করেছে।একটা বিষয় তোমার কাছে জানতে চাই। আগের দিনও বুবুনের মাত্র সাইত্রিশ বছর বয়সে মারা যাওয়া নিয়ে তুমি অনেক অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করেছিলে।কিন্তু দাদা্র চুয়ান্নতে চলে যাওয়া!সেটা নিয়ে তুমি কি বলবে!ক্লাস-ওয়ান গেজেটেড অফিসারকে সুন্দর এই পৃথিবী থেকে অসময়ে বিদায় নিতে হ’ল কেন!কোন উত্তর আছে তোমার কাছে?
-রূপক তুই আমায় কাঠগড়ায় তূলে অপরাধীর মতো প্রশ্ন করছিস কেন?বড় সন্তান হিসাবে তোমাদের দাদার প্রতি ভরসা এবং দাবী আমার একটু বেশিই ছিল।
বেশ মেনে নিলাম।কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না তো!অন্য একটা বিষয় এবার বলছি ।দাদার বিয়ে যখন হয় আমারা ছোট।পরে জেনেছিলাম দাদার একজনকে পছন্দ ছিল।কিন্তু তোমার মত ছিল না।তোমার আপত্তির কথা নিজে না বলে দাদুকে দিয়ে বলিয়েছিলে।দাদা তোমার ইচ্ছেকে মর্য্যাদা দিয়ে তোমাদের পছন্দের পাত্রীর সাথে বিয়ের পিড়িতে বসতে বাধ্য হয়।বিয়ের পর বৌদির সাথে বেশ সুন্দর মানিয়েও নিয়েছিল।কয়েকবছর পর দেশে এমারজেন্সী জারি হ’ল।দাদার ধানবাদে ট্রান্সফার অর্ডার বের হ’ল।মায়ের অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে তুমি বৌদিকে ধানবাদে যেতে দিলে না।কেন দাওনি বলবে?
-সংসারের স্বার্থ দেখেছিলাম, তাই তোর বৌদিকে যেতে দিইনি।তখনও তোর ছোড়দির বিয়ে হয়নি, তুই সবে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছিস।বুবুন কলেজে ভর্তি হয়েছে।তোদের ছোড়দার নর্থবেঙ্গলে ইন্টার্নশিপ চলছে।পেনশনের সামান্য কিছু টাকা।আমার কিছু করার ছিল না রূপক।
আজ তোমায় বলছি শোন- ধানবাদে বৌদিকে যেতে না দেওয়া দাদা মেনে নিতে পারেনি।দাম্পত্যসুখ থেকে ক্রমশ বঞ্চিত হতে হতে জীবনে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা দাদা হারিয়ে ফেলেছিল।তোমার অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে চার বছর পর দাদা যখন বদলি হয়ে বাড়িতে এল তখন সব শেষ।অফিস থেকে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত আমাদের উদ্বেগ এবং অনিবার্য অশান্তি ছিল নিত্যসঙ্গী।তুমি চলে যাবার পর পুরোপুরি বেলাগাম হয়ে গেল।আমরা সবাইমিলে অনেক চেষ্টা করেছিলাম দাদাকে সুস্থ জীবনে ফেরাতে, কিন্তু পারিনি।খোলাখুলি বলছি তোমায়- দাদা এবং বুবুনের অকাল মৃত্যু আমাকে মুল্যবান শিক্ষা দিয়েছে।কথায় আছে “স্নেহ অতি বিষম বস্তু”। অপত্য স্নেহ, নৈব নৈব চ।
কি হ’ল চলে গেলে নাকি! রাত শেষ হতে চলেছে, এখন তো যাবেই চলে।আমার শেষের কথাগুলো শুনেছ আশা করি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।