১
পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথ হিমালয়ে বেড়াতে যাচ্ছেন। সঙ্গে পুত্র রবি। ছোট্ট রবি সকলকে প্রণাম করে দেউড়িতে ঘোড়ার গাড়িতে উঠল।
পথে বোলপুরে বিশ্রাম। বোলপুরে কাঁকুরে মাটির নারিকেল গাছের ছায়ায় বসে ছোট্ট রবি আপন মনে লিখে ফেলল ‘পৃথ্বীরাজ পরাজয়’ নাট্যকাব্য।
ক’দিন বিশ্রামের পর বোলপুর থেকে ট্রেনে চেপে এলাহাবাদ, দানাপুর হয়ে পিতৃদেব পৌঁছলেন পাঞ্জাবের অমৃতসরে। সেখানে মহর্ষি প্রতিদিন সকালে পাঞ্জাবের স্বর্ণমন্দিরে যান। মাঝে মাঝে কিশোর রবীন্দ্রনাথও পিতার সঙ্গে হেঁটে যায়। অমৃতসরে সন্ধেবেলায় বাংলোর বাগানের বারান্দায় মহর্ষি কোলের উপর দুই হাত জোড় করে চুপ করে বসে নতশিরে শোনেন কিশোর রবির কণ্ঠে ব্রহ্ম সঙ্গীত—
‘ তুমি বিনা কে প্রভু সংকট নিবারে
কে সহায় ভব অন্ধকারে —-‘
কিশোর বয়সের এই স্বর্গীয় সুখ স্মৃতি আজীবন রবির মনের গহনে রইল চিরস্থায়ী হয়ে।
অমৃতসর থেকে ডালহৌসি পাহাড়ের বক্রোটা শৈলশিখরে মহর্ষি প্রতিদিন সন্ধেবেলা রবিকে সংস্কৃত, ইংরেজি, জোতিষ্কের পাঠ দেন। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে পুত্রকে গ্রহ নক্ষত্র চেনান।
২
এর অনেককাল আগে ছোট্ট ঈশ্বরচন্দ্র পিতার সঙ্গে সুদূর মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে কলকাতায় এসেছিলেন। পিতার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে পথের ধারে মাইলস্টোনের সংখ্যা দেখে ছোট্ট ঈশ্বর শিখেছিলেন ইংরেজি সংখ্যা।
পিতা ঠাকুরদাসের কাছে শোনেন এক কঠিন দুঃখের কথা। কলকাতায় একদিন ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, ঠাকুরদাসকে এক মুড়ি মুড়কির মহিলা দোকানী পেট ভরে খাওয়ান। খাওয়ানোর পর বলেন এরকম অনাহারের দিন যেন ঠাকুরদাস তাঁর কাছে অবশ্যই করে এসে অন্ন গ্রহণ করেন। পিতার এমন দুঃখের কাহিনীতে মন ভারাক্রান্ত হলেও মাতৃ অনুরাগী ঈশ্বরের নারীজাতির উপর ভক্তি আরো গভীর হল।
ছোট্ট ঈশ্বর কলকাতায় এসে একা সব কাজ করেন। ভোর থেকে উঠে পড়া শুনো সেরে বাবা কাজে গেলে বাজার করা, রান্না করা তারপর স্কুলে যাওয়া। সে এক কঠিন লড়াই। কঠিন লড়াইয়ের শেষে ঈশ্বরচন্দ্র হলেন বিদ্যাসাগর।
৩
আবার সেই কবে হরিহর ‘বঙ্গবাসী’র পুরনো কাগজগুলো বান্ডিল করে তুলে রাখতেন ছেলে বড়ো হলে পড়বে বলে। কিশোর অপু পুরনো ‘বঙ্গবাসী’ নিঃশেষে শেষ করে শনিবার সকাল থেকে খেলা ছেড়ে ডাক বাক্সটার কাছে পিওনের পথ চেয়ে হ্যাঁ করে বসে থাকতে দেখে, পয়সার অভাবে নতুন কাগজ না আনতে পারায় দরিদ্র হরিহরের মন টন টন করে ওঠে।
একবছর পর হরিহর যেদিন বেহারী ঘোষের রামকবচ লিখে দু টাকা দিয়ে ‘বঙ্গবাসী’ কিনে কাগজের মোড়কটা অপুর হাতে এনে দিলে, অপু বাবার হাত থেকে কাগজের মোড়কটা নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে ঝটপট মোড়কটা খুলে ভাবে হ্যাঁ খবরের কাগজই বটে! সেদিন দু’টাকার বিনিময়ে পুত্রের এমন হাসি মুখ দেখে দরিদ্র হরিহরের মনে হয় সোনার বন্ধকী ছাড়িয়ে আনা এর কাছে হার মানে।
৪
বাবার মুখে এসব কথা শুনতে শুনতে সুধাকর আর অর্পণ এসে দাঁড়াল জোড়াসাঁকোর বাড়ির বাগানে। তারপর পিতা পুত্র মাথা নিচু করে প্রণাম করলো রবীন্দ্রনাথের মর্মর মূর্তিতে।