• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় যশোবন্ত্ বসু

মদ্য, শেষ রজনী

“… … হ্যাঁ স্যার, ঠিক আছে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, একদম নিয়ম মেনেই পুরো বিক্রিবাটা করবো, আপনি একবার ঘুরতে-ঘুরতে পায়ের ধুলো দিয়ে যাবেন স্যার, ইয়ে মানে, আপনার জন্য ভালো এক পেটি আলাদা করে রেখে দিইচি, না না, আপনার গাড়িতে নয়, ছি ছি স্যার, কী যে ভাবেন আমাকে, আপনার কাছে আমিই ঠিক পৌঁছে দেবো, ডোন্ট ওরি স্যার… “
মেজোবাবুর ফোনটা রেখে সতু মণ্ডল চওড়া এক খানা হাসি হাসলেন। ” হুঁ হুঁ বাবা, জানতাম দোকান খোলার অনুমতি দিতেই হবে। আরে বাবা সরকার কি অত বোকা নাকি ? লকডাউনে মদের দোকানও বন্ধ রেখে এতটা রোজগার হাতছাড়া করবে ! তাই কখনও হয় ? “
এবার তিনি ফটিককে ফোন করলেন। তাঁর দোকানের কর্মচারী।
” ফটিক, শোন, কাল সকাল দশটার মধ্যে স্নান-খাওয়া সেরে দোকানে ঢুকে যাবি। কাল থেকে দোকান খুলবে।
আরে হ্যাঁ রে বাবা, সত্যি নয় তো কি আমি তোর সঙ্গে রসিকতা করছি নাকি? টিভি ফিভি কিছুই কি দেখিস না ? সরকার দোকান খোলার পারমিশন দিয়েছে। কাল থেকে। ১২ টা থেকে ৬টা পর্যন্ত।
কাল ওই দশটাতেই ঠিক ঢুকে যাবি। গোডাউন থেকে মাল এনে দোকানে সব রেডি করে রাখতে হবে। বুঝতেই পারছিস, হেভি ডিমান্ড হবে, হে হে হে…
আর শোন, গোটা দুয়েক পোস্টার লিখে আনবি তো, ইংরেজি আর বাংলায়, ‘ মাস্ক ছাড়া মদ বিক্রি হইবে না ‘, ‘ নো মাস্ক, নো ওয়াইন ‘ — এইরকম, বুঝলি ?
দেখিস, আবার বানান ভুল করে মাক্স লিখে বসিস না। মনে রাখবি, এটা রেশনের দোকান নয়, মদের দোকান, আমাদের খদ্দেররা সব শিক্ষিত, ভদ্রলোক। মাস্ক বানান মাক্স লেখা হয়েছে দেখলে সব হাসাহাসি করবে, খুব প্রেস্টিজের ব্যাপার, বুয়েচিস ? “
পরদিন যথারীতি সতু মণ্ডল, ফটিক, কানু কারোরই আর দম ফেলবার ফুরসত নেই। এক মিটার দূরে দূরে চুনের গোল দাগ। দোকান খোলার বহু আগে থেকেই খদ্দেরের লাইন পড়ে গেছে। মেজোবাবু জনা চারেক সিভিক পুলিশ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, বেলা বাড়তেই আরও জনা ছয়েক ভলান্টিয়ার ভিড় সামলানোর ডিউটিতে যোগ দিল।
মেজো বাবু নিজে একবার এলেন। কাউন্টারের ভেতরে বসে
চা,জল খেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন,
” বাজার থেকে কালীতলা পর্যন্ত আপনার দোকানের লাইন পৌঁছে গেছে দেখে এলাম। কাউকে দুটোর বেশি দেবেন না একদম। আমাদের কাছে রিপোর্ট এসেছে, কেউ-কেউ দুটো কিনে বাড়ি পাঠিয়ে আবার গিয়ে লাইনে দাঁড়াচ্ছে। আমরা কড়া নজর রাখছি। ছটা বেজে গেলেই দোকানের ঝাঁপ ফেলে দেবেন, পাঁচ মিনিটও যেন বাড়তি খোলা না-থাকে, তাহলেই রিপোর্ট হয়ে যাবে। চুনের দাগ মুছে গেছে। ভিড়ের গ্যাপটা কমে গায়ে-গায়ে হয়ে যাচ্ছিল। আমি ছ’ফুট করে গ্যাপ করে দিতে বললাম। সিভিক পুলিশ আরও বাড়িয়ে দিয়েছি, তারা লাইন মেনটেন করছে। আপনি এই দিকটা সামলান। “
” ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। ছটা বাজার এক ঘণ্টা আগে থেকেই ফটিক লাইনে কজন আছে গুনে নিয়ে শেষ মাথার খদ্দের থেকে হাতে-হাতে টোকেন ধরিয়ে আসবে। পুরো সেই ভোটের লাইনের মতো ব্যবস্থা করে রেকেচি স্যার। গড়বড়ের কোনও কেস নেই। ডোন্ট ওরি স্যার, ডোন্ট ওরি।”
পাঁচটায় ফটিক টোকেন বিলি করতে বেরোলো।
আধ ঘণ্টা গেলো, এক ঘণ্টা গেলো, ফটিক তবু ফেরে না। অদ্ভুত ছেলেটা তো ! সতু মণ্ডল কাউন্টারের বাইরে এসে হাত জোড় করে বললেন,
” দাদা, গম্মেন্ট অর্ডার, ছটা বেজে গেছে, আর দোকান খোলা রাখা যাবে না, আপনারা এবার দয়া করে বাড়ি যান। যারা আজ পেলেন না, কষ্ট করে কাল আর একবার আসুন, আমাদের প্রচুর স্টক আছে, কোনও চিন্তা নেই, কাল বাকিরা ঠিক পেয়ে যাবেন। আর হ্যাঁ, মাস্কটি দয়া করে পরে আসবেন। তা না-হলে মাল দেওয়া যাবে না।
ওরে কানু, এবার শাটার নামা। “
দোকান বন্ধ করে সতু মণ্ডল ক্যাশ গুনতে বসলেন। আটটা বাজলো, খেয়াল হল, ফটিক এখনও ফেরেনি। কানু বাড়ি চলে গেছে। কিন্তু ফটকেটার হল টা কী ?
ব্যাটাচ্ছেলে কি অ্যালকোহলের মতন হাওয়ায় উবে গেল ?
রাত দুটো নাগাদ এক অচেনা নম্বর থেকে সতু মণ্ডলের মোবাইলে ফোন এল,
” কাকা, আমি ফটিক বলছি। “
” ফটিক ! কী ব্যাপার তোর, অ্যাঁ ? কোথায় আছিস তুই ? এত রাতে ? কোন্ চুলোয় গেছিস ? “
” আহ্ কাকা আস্তে, আস্তে, একসঙ্গে এত প্রশ্ন করলে আমার সব গুলিয়ে যায়। আগে আমাকে বলতে দিন।
লাইনে টোকেন দিতে-দিতে আমি ভদ্রকালী অব্দি চলে এসেছি। “
” ভদ্ … ক্কী, কী বললি, ভদ্রকালী ? মানে ? সেটা কোথায় ? সেখানে কী ? সেখানে কেন ?
” আবার সেই একগাদা প্রশ্ন ! আমার কথাটা চুপ করে শুনুন। মেজোবাবু তো এসে লাইনের লোকেদের গ্যাপ বাড়িয়ে দিলেন। আর এনারা সব শিক্ষিত, ভদ্রলোক। পুলিশের কথা মেনে গ্যাপ বাড়িয়েই দাঁড়িয়ে রইলেন। এদিকে লাইনের শেষ লোকটাকে খুঁজতে-খুঁজতে আমি দুখানা জেলা ছাড়িয়ে একেবারে এই ভদ্রকালীতে এসে পড়লাম। দেখি লাইনের শেষ ভদ্রলোক এখানে এই মদের কারখানার গেট অব্দি পৌঁছে গেছে। গ্যাপ বাড়ালে যা হয় আরকি !
কিন্তু যতই মদের কারখানার গেটে পৌঁছক, ওখান থেকে তো আর রিটেল মাল পাবে না কাকা ! সেই আমাদের দোকান থেকেই কিনতে হবে। তাই টোকেন হাতে বসে-বসে ঝিমোচ্ছে।”
” বলিস কী রে , অ্যাঁ ! “
সতু মণ্ডলের মুখে আর বাক্যি সরে না।
” কি-কিন্তু, তুই ফিরবি কী করে ? কাল বেলা বারোটার আগে দোকানে এসে ঢুকতে পারবি তো ? “
” ডোন্ট ওরি কাকা, জি.টি. রোডের ধারে দাঁড়িয়ে আছি। মদের দোকানের কর্মচারী বললে কোনও-না-কোনও ট্রাকওলা ঠিক
পৌঁছে দেবে।
ডোন্ট ওরি কাকা, কাল ঠিক সময়ে দোকানে হাজির হয়ে যাবো। গুড নাইট । “
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।