আমার বাবার মুখাগ্নি করেছিল আমার ছেলে । বাবার মৃত্যুর যখন খবর পেলাম আমি শিলিগুড়িতে একটি মিটিং-এ আটকে রয়েছি ।
একটি সেমিনারে ‘গ্রীন টি’র নামে এমন অখাদ্য পাণীয় পরিবেশিত হতে পারে জানা ছিল না ।
উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে তখনও বাম জমানা । ফলে যিনি ছিলেন তিনি বাম জমানারাই কোন পৌরপিতা । তখন আমি ভূমি বিভাগে চাকরি করি । মিটিং-এর বিষয় বস্তু আমার মনে পড়ে না । মনে পড়ে ‘চা’ পানের তিক্ত স্মৃতি । আর আমার বাবা-র মৃত্যু সংবাদ । কয়েকদিন আগেই বাড়ি থেকে ফিরে এসেছি । বাবা তখন শয্যাশায়ী । দু মাসের সেই শেষ অসুখে আমি বাবাকে প্রথম শয্যাশায়ী দেখি । আমার বিশ্বাস ছিল , আমার অমন সাহসী বাবা কখনও বিছানায় শুয়ে থাকতে পারেন না ।
একটা অলীক স্বপ্ন জলপাইগুড়ির চিলেকোঠায় অপ্রশস্ত ঘরে প্রায় দেখতাম , বাবা ভালো হয়ে গেছেন । আমার বাবার যে মৃত্যু হতে পারে এটা আমার কাছে অবাস্তব ছিল । বাস্তব ছিল চিরকাল বাবার বেঁচে থাকা ।
ফলে আমার মনে হয়েছিল খবরটা সত্যি নয় । বহু বছর ধরে ভূমি বিভাগে চাকরি করলেও সেই বিভাগটিকে সত্যি কথা বলতে ভালোবাসতে পারিনি ।
সেই বিভাগের চারিদিকে কেমন জানি একটা অসূয়ার প্রেতচ্ছায়া ঘুরে বেড়াত । অনেক বছর আগের কথা লিখছি বলেই বোধহয় এমনটা মনে হচ্ছে ।
আমার যিনি অফিসিয়াল বস তিনি একটু দূরে গিয়ে আমার বউকে ফোন করলেন , কি হয়েছে । আমার বউ মৃত্যু-সংবাদটা দিয়েছিল ।
অবশ্য ভূমি বিভাগকে একা দায়ী করে লাভ নেই , সরকারি করণগুলি কম-বেশী এরকমই হয়ে থাকে । শ্যাওলা-জমা , রোদ্দুরের অভাবে রক্তাপ্লতায় ভুগতে থাকা পারস্পরিক অবিশ্বাস ।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে দার্জিলিং মেলে অসংরক্ষিত কামরায় লাইন দিয়ে উঠলাম । সে এক বিচিত্র নরক। কোনক্রমে বসলাম । বাবার জন্য আমি কখনও কাঁদিনি । বাবা অসুস্থ হয়েছেন বারবার , কতোবার যে আমি বাবার জন্য হাসপাতালে খাবার বয়ে নিয়ে গেছি – তার ইয়ত্তা নেই । কিন্তু বাবা ভালো হয়ে উঠতেন । দেওয়াল ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাবা ঠিক ভালো হয়ে উঠতেন । আর সামান্য জল , হাওয়া পেয়েই বাবা রুগ্ন গাছ থেকে বনস্পতি হয়ে উঠতেন , আমার মা আর আমাকে নতুন করে ছায়া দিতেন ।
বাবা খুব স্নেহশীল ছিলেন কিন্তু একেবারেই কঠোর অভিভাবক বলতে যা বোঝায় তা ছিলেন না ।
একবার উড়িষ্যায় গঞ্জামে ব্যাচেলর অফ ফার্মিসিতে ভর্তি হয়েও আমি ফিরে এসেছিলাম । বাবা সঙ্গে ছিলেন। কতোগুলি টাকা বাবার নষ্ট হয়েছিল । দু-দিন অপেক্ষার পর ফার্স্ট ক্লাসের সংরক্ষিত আসনে চেপে ফিরে এসেছিলাম ।
আমরা খুবই নিম্নবিত্ত পরিবার কিন্তু আমার মনস্তাপের কথা ভেবে বাবা প্রথম শ্রেণীর স্লিপার ক্লাসে আমায় নিয়ে আসেন । দার্জিলিং মেল মালদায় এলে ভদ্রলোক বললেন , খাবেন না কিছু !
আমি বললাম , খেতে পারবো না । সংক্ষেপে বললাম , মৃত্যুর খবরটা ।
ভদ্রলোক এতোটাই ভালো ছিলেন যে মালদা স্টেশন থেকে আমার জন্য অরেঞ্জ জুস এনে দিয়েছিলেন ।
আমি খেতে পাচ্ছিলাম না । তবুও ওঁর ভালোবাসার কারণে খেয়েছিলাম ।
বাড়ি ফিরে এসে আর বাবাকে খাটে শুয়ে থাকতে দেখিনি । আমার ছেলেই ঠাকুর্দার দাহ করে , মুখগ্নিও সে-ই করে ।
বাবা নাতিকে সব সময়ই আমার চেয়ে যোগ্য মনে করতেন , যদিও কাকে বেশী ভালোবাসতেন – আমি জানি না ।
বাবা মহালয়ার দিন মারা গেছিলেন । এতোদূর অবধি এটা নিশ্চয় তেমন কোন গল্প ছিল না । হয়তো গল্প নেইও কোথাও ।
২
বাবার মৃত্যুর কয়েক বছর পর ভূমি বিভাগ থেকে আমি চলে এসেছিলাম প্রশাসনিক বিভাগে ।
সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে একটি কাজ প্রায়ই করতে হতো তার নাম – ‘সুরত হাল’ ।
‘সুরত হাল’ কি – কখনও অন্য গল্পে বলা যাবে বা হয়তো অন্য কয়েকটি গল্পে বলেছিও ।
এমনিতে কোথাও চাকরি – সূত্রে গেলে শ্মশান আগে আমি খুঁজে বার করি । আর গেলেই দাহকার্য দেখি । বিশেষ করে মুখাগ্নি । মাও রইল না একদিন । বাবার মতোন হয়নি আমি মায়ের মায়ের দাহ আর মুখাগ্নি করতে পেরেছিলাম ।
একদিন সামান্য অবসরে শ্মশানে বসে আছি । একটা লাশ এলো পুরুষের ।
লাশটার সঙ্গে খুব কম লোকজন । যারা এসেছিল ইলেকট্রিক চুল্লিতে না দিয়ে কাঠ জোগাড় করে পুরোনো প্রথায় চিতা তৈরি করল ।
কৈশোর ও যৌবন এরকম চিতা আমি বহু তৈরি করেছি । কাঠের পর কাঠ কি-ভাবে সাজাতে হয় তাও আমি জানি ।
ওদের সাহায্য করলাম । স্বল্প কয়েকজন শ্মশান-যাত্রীকে জিজ্ঞেস করে জানলাম , বৃদ্ধ মানুষটার কেউ নেই । তাই বলে গরীর মানুষও তিনি নন । ছেলে বিদেশে থাকে , আসতে পারেনি । ওদের বলেছে , কয়েকদিনের মধ্যে ফিরে এসে যাবতীয় খর্চা মিটিয়ে দেবে ।
আমি বললাম, কাছাকাছি ভালো মিষ্টির দোকান আছে !
তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ।
আমি বললাম , দাহকার্যের পর তো খাওয়াতে হয় ।
এবার তাদের মুখে হাসি ফুটল ।
তাদের মধ্যে একজন আমায় বলল – আরেকটা কাজ আপনি করতে পারবেন !
বললাম – কী ?
মুখাগ্নি ! ওরা সমস্বরে বলে উঠল ।
সামান্য আগেও বৃষ্টি হচ্ছিল । এখন গোল হয়ে চাঁদ উঠেছে । মৃতদেহের মুখের উপর এসে পড়েছে । বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল । অবিকল না হলেও বাবারই মতোন । টিকোলো নাক , ব্যাক ব্রাশ করা চুল । অনেকটাই কালো , সামান্য সাদা । আমার বাবারও তাই ছিল ।
শ্মশান-ব্রাহ্মণ বললেন – কই তাড়াতাড়ি করুন । মুখাগ্নি কে করবেন !
অগ্নি শলাকা হাতে নিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম ।
কলকাতার রাস্তা পার হচ্ছে এক বালক । চোখ জ্বালা করছে । বাবা রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছেন বালকের দু-চোখ ।
বালক বলছে – বাবা , এগুলি কি !
কাঁদানে গ্যাস , টিয়ার গ্যাস ।
পুলিশের ভ্যান হুশ করে বেরিয়ে গেলো । বোম পড়ছে । ভয়ে বালক বাবার ধুতির প্রান্ত ধরে নিজেকে আড়াল করছে ।
বাবা বলছেন , ভয় নেই তোর , আমি আছি তো !
শবদেহ যেন বলল – আমি আছি , আছি ।
ভয় নেই তোর । মুখাগ্নি করতে করতে হৃদয়ের প্রতিধ্বনি আমাকে নতুন করে প্রত্যয়ী করল ।