• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৩৮)

পর্ব – ১৩৮

শ‍্যামলী তার বাবাকে বলল, বাবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভক্ত কবীরকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছেন। তার শুরুটা এই রকম, ভক্ত কবীর সিদ্ধপুরুষ খ‍্যাতি রটিয়াছে দেশে। তো কি হয়েছে জানো, কবীরের পরিচিতি বাড়ায় যাদের গা জ্বলছে, তারা একজন সেক্স ওয়ার্কার, তুমি বুঝতে পারছ বাবা আমি কাদের কথা বলছি, তেমন একজন মহিলাকে বলল, বড়ো রাস্তার উপর কবীরকে জড়িয়ে ধরে বলতে হবে, হ‍্যাঁ গো, কেমন পুরুষ তুমি, বিয়ে করবে কথা দিয়ে শেষ কালে এইভাবে সাধুগিরির ভেক ধরেছ? জোচ্চোর কোথাকার! সকলেই মেয়েটার কথাকে ফেসভ‍্যালুতে নিয়ে কবীরকে ছি ছি করতে লাগলেন। কবীর ছিলেন মান অপমানের বহু ঊর্ধ্বে। তিনি লোকনিন্দায় মর্মাহত হলেন না। বরং মেয়েটিকে বললেন, চলো, আমার বাড়িই চলো, আমার কুটিরেই থাকবে তুমি। আমার দুটো জুটলে তোমার সঙ্গে ভাগ করে খাবো। মেয়ে তো কবীরের কোনো রকম রাগ না করা দেখে  মনে মনে ভাবছিল, কাজটা বোধ হয় ঠিক হল না। তার উপর কবীর যখন সহজভাবে বললেন, চলো আমার ঘরে চলো, তখন তো ভয় পেয়ে গেল। ভাবল, বাপ রে, এ যে একেবারে সাচ্চা সাধু। আমি তো দেবতার কোপে পড়ব। ভয়ে সে কেঁদে ক্ষমা চাইল। কবীর বললেন, তুমি তো আমার প্রভুর দান। কবিতার নাম অপমান বর। আমাদের কথা ও কাহিনী ব‌ইতে ছিল। তো, আমি তোমাকে বলছি বাবা, ওদের বাড়িতে আমাকে যে যাচ্ছেতাই করে বলল, তাতে আমি একটুও দুঃখ পাইনি। একটু আগেই দ‍্যাখো অন্তু থানার ওসির সাথে আমার হেসে কথা বলার সম্পর্ক নিয়ে কি রকম বলল। ও কিন্তু আমায় ছোটবেলা থেকেই সবসময় দেখছে। তবুও বলল। দাদাও তো কম বলেনি। বাবা, এই বলাগুলো আমার ভেতরে আর ঢোকে না।
 শশাঙ্ক পাল বললেন, অশান্তিটা হল কি করে?
শ‍্যামলী বলল, বাবা, সে একটা মজার গল্প। রমানাথের মা আমি গিয়ে পৌঁছতেই বললেন, তুমি ব‍্যাগে করে জামাকাপড় আনো নি? আমি তোমার জন্য একটা ঘর গুছিয়ে রেখেছি। আমি  কিছু বললাম না। মনে মনে জানতাম আমি থাকব না নিশ্চয়ই। তারপর বললেন, বাড়িতে সেদিন যাঁরা অভ‍্যাগত আসবেন, সবাই ঠিক মতো খেতে পেল কি না, তদারকির দায় আমার এতেও একটু অবাক হলাম। আমি ওদের বাড়ি কখনও যাই নি, কাউকে চিনিও না। তবু ঠিক করলাম কারখানাটা তো যা হোক করে চালিয়ে দিই। সেই কেজো বুদ্ধিতে এটাও উৎরে দেব। এদিকে রমানাথ বলে রেখেছিলেন যে, উনি যখন পিতৃশ্রাদ্ধ করবেন, তখন ওঁর কাছে কাছে থাকতে হবে। সে ব‍্যাপারে আগের সন্ধ্যায় প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলেন। তাই আমি ওঁর কাছেই সে সময়টা ছিলাম। ওই সময়, আর তার আগেও দেখেছি, ওঁদের বাড়ির আত্মীয় পরিজন মেয়ে ব‌উরা সবাই আমাকে বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করছে।
 বাবা, তুমি শুনলে অবাক হবে, শ্রাদ্ধবাসরে পিছনে বসে মেয়েরা আমাকে নিয়ে গল্প করছিল। শাড়ি, গয়না, চুলবাঁধা, এইসব। আমার তো ভাবলেই গা কেমন করে। মাঝখানে ওঁর মা আমাকে ডেকে পাঠালেন, বললেন, রমানাথ যখন শ্রাদ্ধ করে উঠে আসবেন, তখন যেন আমি নিজে ওঁকে জল মিষ্টি দিই।
বাসন্তীবালা বললেন, কেন, তার ছেলে কি এতদিন জল মিষ্টি খেত না, যে শ‍্যামলী দাঁড়িয়ে থেকে না খাওয়ালে চলবেনা? যতো আদিখ্যেতা।
শশাঙ্ক পাল চোখের ইঙ্গিতে স্ত্রীকে চুপ করতে বলে, কন‍্যাকে বললেন, সে তো তুই নিখুঁতভাবে করেছিস আমরা দেখেছি। সব্বাই তোর প্রশংসাও করছিল।
শ‍্যামলী হেসে বলল, ওইতেই তো বিষবৃক্ষের হরিদাসী বৈষ্ণবীর কথা মনে পড়ে গেল।
বাসন্তীবালা বিরক্ত হয়ে বললেন, আ খেলে যা, একটা দরকারি কথা বলতে বলতে তোর খালি এ কথা সে কথা। তুই দিন রাত অনেক ব‌ই পড়িস আমি জানি। কিন্তু সে সব কি আমায় গেলাতেই হবে?
শশাঙ্ক মেয়েকে বললেন, তারপর কি নিয়ে সমস্যা হল?
রমানাথকে ওঁর মা বলেছিলেন ওঁর কাছে বসে খেতে। এদিকে ওঁর ইচ্ছে হচ্ছিল আমার সাথে একান্তে বসে খাবেন। এই নিয়ে মায়েতে ছেলেতে একটু মন কষাকষি হয়েছিল। তখনও মেয়েদের মহলে সে নিয়ে একটু ইয়ার্কি ছলে মন্তব্য  হয়েছিল। তো খাওয়া হলে রমানাথ আবদার করলেন, একটু ছাতে গিয়ে গল্প করি। তো আমি ওঁর মুখ চেয়েই ওঁদের বাড়ি গিয়েছি। আমিও ছাতে গিয়েছি।
বাসন্তীবালা বললেন, না না, এটা তোদের ঠিক হয় নি। বাড়ি ভরতি আত্মীয় স্বজন। তাদের তখনও বিদায় হয় নি, ওই সময়ে সবার চোখের সামনে তোদের ওভাবে গল্প করাটা ভুল কাজ‌ই হয়েছে।
সবিতা বললেন, বৌমণি, তোমার‌ই উচিত ছিল যখনি ফিরছ, মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে আসা।
বাসন্তীবালা রাগ দেখিয়ে বললেন, হ‍্যাঁ, অতো বড় মেয়ে, যে একটা কারখানা চালাচ্ছে, পুলিশ উকিল সব তাঁহা তাঁহা লোককে পকেটে পুরে ফেলার ক্ষমতা রাখে যে মেয়ে, আমি নাকি তাকে আঁচলে বেঁধে রাখব!
 শ‍্যামলী বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, তারপর শোনো, এখন এই নভেম্বর মাসে বেলা ছোট হয়ে এসেছে, সূর্য অস্ত গিয়ে একটা একটা করে তারা ফুটছে, আর আকাশের দিকে তাকালে আমার যে কতরকম কিছু মনে পড়ে যায়, কী আর বলব! তো সেই সব করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বাড়ির মেয়ে ব‌উয়েরা যে আড়ি পাতছে, তা তো আমি ভাবি নি।
সবিতা বললেন, ছি ছি, এটা তোর একদম উচিত হয় নি। শ্রাদ্ধ সবে চুকেছে, আর তোমরা দুটিতে ছাতে এক কোণায় বসে বসে গল্প করবে, সেটা কোনো মা মেনে নেবে না। কথায় বলে ঘি আর আগুন একসাথে রাখতে নেই।
শ‍্যামলী হেসে বলল, পিসি, তুমি ঠিক বলেছ। রমানাথের বাড়ির আত্মীয় কুটুমরা আবার বলছিল সন্ধ্যায় প্রেতাত্মারা নাকি ছাতে পায়চারি করে। যুবতী শরীরের উপর তাদের বিশেষ রকম আকর্ষণ। সুযোগ পেলেই তাঁরা হুলুস্থুল বানিয়ে দেন।
সবিতা বললেন, তুই তো দেখছি জ্ঞানপাপী।
শ‍্যামলী বলল, কিন্তু শ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়ার সময় বামুন খুব স্পষ্ট করে বলেছিলেন সমস্ত অতৃপ্ত আত্মা যেখানে যে থাকো সবার শান্তি কামনা করি। তাহলে তো ওঁদের শান্তি পেয়ে যাবার কথা, তাই না?
শশাঙ্ক পাল সবিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওরে তুই এবার গা তোল্, বাজারে যা। ন‌ইলে অতনুর হাতে আজ তোর অপঘাতে মৃত্যু হতেই পারে।
সবিতা হেসে উঠে পড়লেন।
বাসন্তীবালা স্বামীর দিকে চেয়ে বললেন, নাও, এখন কি করে সবদিক সামলাবে তা ভেবে রাখো।
 শশাঙ্ক পাল স্ত্রীকে বললেন, আমার মেয়ে বকুনি খেয়ে ওদের বাড়িতে বলে এসেছে, তোমাদের ছেলেকে বিয়ে আমি করব না। তাইতে রমা বেচারা বড্ড দুঃখ পেয়ে আজ সকালেই ছুটে এসেছিল।
বাসন্তীবালা বললেন, ছি শ‍্যামলিমা, একথা বলা তোর উচিত হয় নি। রাগের মাথায় ওকথা বলে তুই ঠিক কাজ করিস নি। ওরা আমাদের কুটুম হতে যাচ্ছে। সেই অবস্থায় এইসব বললে সমস্যা বাড়ে। হাজার হোক, জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। সেখানে এটা ঠিক হল না।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।