সাপ্তাহিক T3 অরিজিনাল মিনি সিরিজে নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী (পর্ব – ৫)
by
·
Published
· Updated
ইংরেজ কখনও এদেশে আসেনি – ৫
গল্পটা খুব মজার। মজার সেই গল্পটা অনেকটা এরকম।
একবার সরকারিখাতে কিছু টাকা বেঁচে যাওয়ায় ঠিক করা হলো এক এলাকায় একটা পুকুর কাটা হবেl সরকারি খেয়াল! পুকুর কাটানো হল। সাধারণ মানুষের দারুণ আনন্দ। এলাকায় নতুন পুকুর হয়েছে। সেই পুকুরে তারা নাইতে যায়, মাছ ধরে। কিন্তু পুকুর কাটার পর সে অঞ্চলে মশা প্রচন্ড বেড়ে গেল। সেই মশককুল ওই পুকুরের জলেই ব্রীডিং করছিল। সাধারণ মানুষ মশার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। ঘরে ঘরে ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য মশাবাহিত জীবাণুর আক্রমণে সরকারের টনক নড়লো। সরকারের মনে হলো নাহ, বিনা ভেবেচিন্তে এভাবে পুকুর কাটানোটা ঠিক হয়নি। সরকার ঠিক করল মশা কমাতে ওই পুকুর বোজাতে হবে। আবার সরকারি খেয়াল! সরকার পুকুর বুজিয়ে ফেলল। সাধারণ মানুষ সরকারের নামে ধন্য ধন্য করতে লাগলো।
তখন মশার আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়া মানুষের আর খেয়াল থাকলো না ওই পুকুর কিন্তু একসময় ওই সরকারই কাটিয়েছিল।
লেখার শুরুতে বলেছিলাম এই লেখা হলো এক ‘সিনারিও অ্যানালিসিস’। লেখা ক্রমশ শেষের দিকে এগোচ্ছে তাই সে কথা আরেকবার পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই। প্রেক্ষাপট বদলে বদলে বারবার একটাই ব্যাপারকে বোঝবার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই চেষ্টা কোন রাজার অন্দরমহলের কুৎসার খবর জেনে কৌতুহল নিবৃত্ত করার জন্য নয় অথবা কোন নবাবের কোন বদখেয়াল ছিল কিনা তা জানার জন্য নয়। সেই কৌতূহল শুধুমাত্র সীমাবদ্ধ সে যুগে বাংলার সাধারণ মানুষের অবস্থাটা বোঝবার জন্য।সেই সাধারণ মানুষ, যারা আমার বা আপনার মত ছিলেন। বাংলার মানুষের পূর্বপুরুষ, যাদের ঘর পরিবার ছিল, রোজকার পেট চালাবার মতো খুদকুঁড়ো যোগাড় হয়ে যেত, তবু কোন সিস্টেমের মধ্যে থেকে তারা বাধ্য হতেন নিজের পরিবার পরিজনকে বিক্রি করে দিতে, কেন তাদের ওপর নেমে আসতো হার্মাদদের দুর্দমনীয় অত্যাচার, শাসনযন্ত্রের কোন ফেলিওরের শিকার ছিলেন তারা যে, ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষাটা অবধি পেতেন না। তার মূল কারণ কী ছিল? কে দায়ী ছিল তার জন্য?
বাংলায় মুঘল শাসনের কথা বলতে গিয়ে এখনও বহু মানুষের নাল ঝোল গড়ালেও অনেকেই কিন্তু বোঝেন না যে মোগলরা সিস্টেমেটিক্যালি বাংলার মানুষের পায়ুমৈথুন করার ব্যাপারে ইংরেজদের থেকে কিছু কম যায়নি। কিভাবে সেটা বুঝিয়ে বলা যাক।
পৃথিবীতে যুদ্ধের ব্যাপারগুলোয়, যতই রাজায় রাজায় ইগোর লড়াই, ধর্ম, মোক্ষ, কাম ইত্যাদির নাম নেওয়া হোক, পৃথিবীতে সকল যুদ্ধের একটাই মাত্র মূল কারণ থাকে, আর তা হল – অর্থ। সেই অর্থের বিভিন্ন নাম, বিভিন্ন রূপ থাকে। কখনো যুদ্ধ করা হয় দেশ দখলের নামে বাণিজ্য বন্দর দখল করতে, কখনো যুদ্ধ করা হয় রাজ্য দখলের নামে কোন দেশের ইন্ডাস্ট্রি দখল করতে। বাংলায় এই দুটোই ছিল। ফার ইস্ট এর যতগুলি দেশ ছিল – জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিও, জাপান, চীন- প্রতিটি দেশে যাবার বাণিজ্যপথ কিন্তু এই বাংলা দিয়েই। এছাড়া বাংলায় বিভিন্ন বর্ধিষ্ণু শিল্পর কথা আগেই বলেছি। মোগলরা এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছিল একইসঙ্গে বাংলা দখল করে। যেমন তারা সপ্তগ্রাম, তাম্রলিপ্ত, চট্টগ্রাম এইসব বন্দরগুলোর দখল নিয়েছিল, ঠিক একইভাবে তারা ধ্বংস করেছিল বাংলার সম্পূর্ণ শাসন ব্যবস্থা। আকবর বাংলা দখল করবার পর তাতে ধাক জমাতে পাঠাল শাহবাজ খান, উজির খান ও রাজা মানসিংহকে কিন্তু তারা বাংলা দখল করলেও তা হড়প করতে ব্যর্থ হল। আর তাদের এই ব্যর্থতার কারণ বাংলার একদল রাজা, ভূমিপুত্র রাজা, তাদের বলা হয় ভূঁইয়া। ইতিহাসে তাদের বিভিন্নভাবে ছোট করবার বহু চেষ্টা করা হয়েছে। কখনও তাদের পরিচয় দেওয়া হয়েছে জমিদার, কখনও বা সামন্ত প্রভু বলে। তাদের রাজা বলে কখনোই স্বীকার করে নেওয়া হয়নি।
যশোরের প্রতাপাদিত্য ছাড়া যে রাজারা বাংলা শাসন করতেন তাদের মধ্যে প্রবল প্রতাপান্বিত আর যারা ছিলেন তারা হলেন বিক্রমপুরের চাঁদ রায় ও কেদার রায় ,শাহজাদপুরের রাজা রায় চন্দ্র প্রতাপ, মানিকগঞ্জের বিনোদ রায় ও মধু রায়, চন্দ্রদ্বীপের পরমানন্দ, ভুলুয়ার অনন্ত মানিক্য, লক্ষণ মানিক্য এবং বাঁকুড়ার বীর হাম্বীর ও সুবর্ণগ্রামের ইশা খান।
আগেই মুঘল সেনাপতি ইসলাম খানের নাম বলেছি। ইসলাম খান চিশতী ছিল জাহাঙ্গীরের সেনাপতি। ইসলাম খান চিশতীর কিন্তু আরেকটি পরিচয় আছে। ইসলাম খান ছিল ফতেপুর সিক্রির বিখ্যাত প্রভাবশালী শেখ সেলিম চিশতির নাতি। ইসলাম খান চিশতী বাংলায় এসে প্রথম যে কাজটি করে তা হল – হাজার বছর ধরে চলে আসা বাংলার প্রশাসনিক শাসন ব্যবস্থাটা ভেঙেচুরে ধ্বংস করে দেওয়া। আর তা করতে গিয়ে বাংলার স্বাধীন রাজাদের পায়ের তলায় পিষে দেওয়া হয়। পুরো বাংলাতে অরাজক অবস্থা চলে আসে। ছোট ছোট যে রাজ্যতে বাংলা বিভক্ত ছিল সেখানকার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সুরক্ষার সমস্ত পরিকাঠামো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতাপাদিত্য কে যতই অত্যাচারী নিষ্ঠুর রাজা হিসেবে দেখান এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে প্রতাপ ছিলেন সে যুগের মোগলদের বিরুদ্ধে অন্যতম বড় শক্তি। বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল তার রাজত্ব, ছিল প্রচুর রনপোত এবং একটি স্বাবলম্বী সৈন্যদল। বউ ঠাকুরানীতে যতই তিনি রাজপুত্রকে বাবার বিরুদ্ধে দেখান, উদয় কিন্তু প্রতাপের সঙ্গেই ছিল। যখন ইসলাম খান প্রতাপাদিত্যের সলক দুর্গ আক্রমণ করেন তখন সেখানে প্রতাপের সৈন্যের সেনা অধিনায়ক উদয়াদিত্য ছিল। প্রতাপাদিত্যকে বন্দী করার পর প্রতাপাদিত্যের রাজ্যে মোগল সেনাপতি গিয়াস খানকে নিযুক্ত করা হয়। গিয়াস খানের যশোর সম্বন্ধে কোনো ধারনাই ছিল না। যশোরের মানুষকে এমন এক শাসকের হাতে তুলে দেওয়া হয় যে সে রাজ্যকেই চেনে না। একই কাজ করা হয় ভুলুয়ার রাজা অনন্ত মানিকের রাজ্যের সঙ্গেও। এমনকি কামরূপ কাছাড়ের মতো বাংলার সীমান্তবর্তী যে রাজ্যগুলি বৃহত্তর বঙ্গের অংশ হিসেবে গণ্য করা হতো সেই রাজ্যগুলির রাজাদেরও মুঘল সেনা পরাজিত করে তাদের শাসন ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়।
ইসলাম খানের মৃত্যুর পর বাংলায় আসেন মীর জুমলা ও তারপর শায়েস্তা খাঁ। একদল বিজাতীয় অর্বাচীন শাসক যাদের এই দেশ, তার ভূগোল, ইতিহাস এবং এখানকার মানুষদের সন্মন্ধে কোনো ধারনাই ছিল না, তাদের শাসনে এই দেশের মানুষের দুর্গতি চরমে ওঠে।
কীভাবে?
চট্টগ্রাম এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকত আরাকান দস্যুরা। জলযুদ্ধে অসাধারণ পটু তারা। মেঘনার অববাহিকা অঞ্চল তারা সব সময় অধিকার করতে চাইত। বাংলার স্বাধীন রাজারা একজোটে তাদের ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। তাদের অবর্তমানে আরাকানে রাজের মদতপুষ্ট সেই দস্যুদল সেই অঞ্চল পুরোপুরি দখল করে নেয়। ফিরিঙ্গি নামে পরিচিত পর্তুগীজ জলদস্যুদের সাথে মিলিত হয় তারা হত্যা, মানুষ পাচার এবং আতঙ্কের এক নব অধ্যায় বাংলার মানুষের জন্য তৈরি করে ফেলে।
বলা হয় সেসময় এই আরাকান পর্তুগীজদের মিলিত দলের জলদস্যুদের মোগল সৈন্যরা এত ভয় পেত, যে জলের মধ্যে দূর থেকে এই জলদস্যুদের জাহাজ দেখলে তারা যুদ্ধ করার বদলে নৌকা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে পছন্দ করত। বাংলার মানুষকে কিভাবে দাস বানানো হচ্ছিল তার সামান্য পরিচয় লেখার শুরুতে দিয়েছি। কিন্তু সে কাহিনী পরে। প্রথমে বাংলার সেই স্বাধীন রাজা – ভূঁইয়াদের নিয়ে আরেকটু কথা বলা যাক।
অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার যে বাংলার মানুষ ‘বারো ভূঁইয়া” এই শব্দটি ছাড়া এই স্বাধীন নৃপতিদের বিষয়ে আর বিশেষ কিছুই প্রায় জানে না। কারা ছিলেন ভূঁইয়ারা? কেমন ছিলেন তারা? একটু দেখা যাক।
‘দ্বাদশ ভৌমিক’ বাংলায় একটি সহস্র বছরের পুরোনো টাইটেল। একসময় এই ভূঁইয়া কথাটা প্রাচীন বাংলায় ব্যবহৃত হতো ‘মন্ডল” অর্থে। এই মন্ডলদের সমস্ত পরিচালন ক্ষমতা যার উপরেই থাকত তাকে বলা হতো ‘মন্ডলাধিপতি’। সম্রাট বা রাজ চক্রবর্তীরা মন্ডলাধিপতি হতেন। দ্বাদশ মন্ডল বা দ্বাদশ ভৌমিক – এই কথাটা থেকেই বারো ভূঁইয়া কথাটির উৎপত্তি। পাল ও সেন বংশের রাজত্বকাল থেকেই বাংলায় এই ভৌমিকরা বিশেষ প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। আফগান আধিপত্য থাকলেও এই ভৌমিকদের সেই প্রতিষ্ঠা কমেনি। সেই ভৌমিকদের সাথে যোগ হয়েছিল তৎকালীন অন্যান্য পাঠান এবং আফগান শাসকরা। সব মিলিয়ে ছিল সেই যুগের বারো ভূঁইয়া।
বাঙালি একবার ভেবে দেখুন, মোগলরা যখন দিল্লির সিংহাসনে সম্পূর্ণ গৌরব নিয়ে রয়েছে, সেই সময়েও বাংলার কিছু ভৌমিক সেই প্রবল প্রতাপ সম্পন্ন মোগলদের সাথে সমানে টক্কর দিয়ে বাংলায় রাজত্ব করে যাচ্ছে। রাজপুতদের থেকে সে সংগ্রামের গৌরব কোন অংশে কম নয়। কিন্তু একজন রাজপুতের রানা প্রতাপের বিষয়ে বলতে গেলে যেভাবে বুক ফুলে ওঠে একজন বাঙালি কি প্রতাপাদিত্যের বিষয়ে বলার সময় একই গৌরব অনুভব করে? একজন বাঙালি কি প্রতাপাদিত্যের বিষয়ে আদৌ কিছু জানে? সে কি এই বারো ভূঁইয়াদের বলসম্পন্নতার ব্যাপারে আদৌ ওয়াকিবহাল?
একজন বাঙালি কি জানে পূর্ববঙ্গে ভৌমিকরা এত শক্তিশালী ছিল যে প্রতাপাদিত্যকে বিধ্বস্ত করার জন্য মানসিংহকে একটি নৌবাহিনী স্থাপন করতে হয়? বাঙালি কি জানে, রাজা কেদার রায় সেই মোগলকেই সন্দীপ থেকে বিতরণ করে সন্দীপ পুনর্দখল করেন। বাঙালি কি জানে এই যুদ্ধ করার সময় রাজা কেদার রায়ের একশ খানা রণতরী ছিল? আর সেই রণবহর এতই শক্তিশালী ছিল যে যখন আরাকান সন্দ্বীপ দখল করতে আসে তখন প্রায় একসহস্র রণতরী নিয়ে আসে, কিন্তু কেদার রায়ের সাথে যুদ্ধে সেই এক হাজার রণতরী এঁটে উঠতে পারে না। মোগলদের, রাজা কেদার রায় একবার নয় তিন থেকে চারটি নৌ যুদ্ধে হারিয়ে ছিলেন এবং মোগলদের প্রায় পাঁচশো রণতরী তিনি অধিকার করেছিলেন। মানসিংহের সাথে শেষ যুদ্ধে কেদার রায় পরাজিত বন্দী হন। অস্ত্রাঘাতে জর্জরিত কেদার রায়কে মানসিংহের কাছে উপস্থিত করার কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি মারা যান। বাঙালি কি মনে করে, এই ইতিহাস হলদিঘাটের চেয়ে কিছু কম সাহস ও শৌর্যের?
বাঙালি ইতিহাস বইতে পরীক্ষার নম্বর তুলতে রাজস্থানের রাজকাহিনী পড়েছে, কিন্তু সে কি কাব্যে অবহেলিত প্রতাপাদিত্যের বীরগাঁথার সব কথা জানে? প্রতাপাদিত্য মোগলদের শুধু একটা দুটো নয়, বহু যুদ্ধক্ষেত্রে, বহু যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। বলা হয় তার বীরত্ব খ্যাতি এতদূর পৌঁছেছিল যে বাঙালি এক সময় মনে করত গৌড় রাজধানীর হারিয়ে যাওয়া অতীত গৌরব আবার তিনি বাঙালির জন্য ফিরিয়ে আনবেন। প্রতাপাদিত্য যৌবনে দিল্লি এবং আগ্রা গিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি মোগলদের সৈন্য ব্যবস্থা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। সেইসব ব্যবস্থা তিনি নিজের সৈন্যদের মধ্যে চালু করেন এবং মোগলদেরই বিরুদ্ধে একটি প্রায় অপরাজিত সৈন্যদল দাঁড় করান। সাগরদ্বীপ ছিল তার প্রধান নৌবন্দর। খুদালি, জাহাজঘাট চাকৈ এইসব বন্দর তার অধিকারে ছিল, যেখানে নিয়মিত নির্মিত হতো সমুদ্র ও নদীযুদ্ধের উপযোগী রণতরী। প্রতাপাদিত্যের রাজ্য অধিকার করার পর মোগল সেনা সেখানে এমন অত্যাচার চালিয়েছিল যে তার রাজ্য অরণ্যে পরিণত হয় এবং সুন্দরবন সেই রাজ্যকে গ্রাস করে। শুধু মোগল নয়, প্রতাপাদিত্য পর্তুগীজদের বাংলা থেকে বহুদিন দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। তার ছেলে কীর্তিনারায়ন পর্তুগীজদের মেঘনার মোহনা থেকে সবসময় দূরে রেখেছিল। আইন-ই-আকবরীতে পাওয়া যায় বাংলার এক একজন ভূঁইয়াদের কাছে তখন প্রায় চার লক্ষ ন হাজার পদাতিক সৈন্য, তিন চার হাজারের ওপর কামান এবং সাড়ে চার হাজারের কাছাকাছি রণতরী ছিল। রাজকীয় ক্ষমতা না থাকলে এ কি কোন সামান্য জমিদারের সাধ্য?
বিক্রমপুরের কাছে শ্রীপুরের রাজা চাঁদরায়, চন্দ্রদ্বীপের কন্দর্প নারায়ন, ফতেহাবাদের মুকুন্দরাম রায় এরা সকলেই ছিলেন ভৌমিক রাজা। চাঁদ রায় বিক্রমপুর থেকে সন্দ্বীপ অবধি নিজের রাজত্ব বিস্তার করেছিলেন। তিনি পিতলের কামান ব্যবহার করতেন। মোগল সেনাপতি মুরাদ খা রাজা মুকুন্দরামের হাতে নিহত হন। তাঁর বীরত্বের কথা আকবরনামাতে অবধি লিপিবদ্ধ আছে। লক্ষীমানিক্য নোয়াখালীর ভুলুয়া জেলার রাজা ছিলেন। তিনি মেঘনা নদীর তীরে নিজের রাজত্ব বিস্তার করেছিলেন। ঈশা খাঁর বাবার নাম ছিল কালিদাস। তিনি কোন সুলতানের মেয়েকে বিয়ে করেন। ঈশা খাঁ সোনারগাঁ বা সুবর্ণগ্রাম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। তাছাড়া আসামের রাঙ্গামাটি, নারায়ণগঞ্জের ত্রিবেণী এবং এগারসিন্ধুতে তার দুর্গ ছিল। অমিত শারীরিক শক্তির অধিকারী ঈশা খাঁ মহারাজ মানসিংহকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে হারিয়েছিলেন।
মহারাষ্ট্রের পাঠ্যবইতে মধ্যযুগের ইতিহাস বলতে মারাঠীদের বীরদের ইতিহাস সম্বন্ধে পড়ানো হয়। মোগল, বিজাপুর ইত্যাদি আক্রমণকারীদের বিষয়ে সেখানে ততটুকুই আছে যা না থাকলে নয়। বাঙালি, পাঞ্জাবি, রাজপুত এবং সেখানে থাকা ভারতের সব জাতির ছাত্রই সেই ইতিহাস পড়ে। স্বাভাবিক ব্যাপার। ভারতের মতো একটি বৃহৎ দেশের প্রতিটি মানুষের অন্য প্রদেশের ইতিহাস জানা উচিত। বিশেষত, সেই মানুষ যদি সেই প্রদেশে থাকে, সেখানে কাজ করে নিজের পেটের অন্ন জোগায়, তবে অবশ্যই সেখানকার মানুষকে বুঝতে, তাদের অতীতকে তার জানা অবশ্যই দরকার। একইভাবে, কর্নাটকের ইতিহাসে কেলেডির নায়েক, ওডিয়ারের মাইসোরের সম্বন্ধে পড়ানো হয়। তামিলনাড়ুর গৌরবগাথা রয়েছে বিজয়নগর আর নায়কদের পিরিয়ডে। আর রাজপুতদের ইতিহাস তো ছত্রে ছত্রে সংগ্রামের গৌরবে ওভারলোডেড।
কিন্তু প্রশ্ন হল, বাংলায় বাস করা মাড়োয়ারি, গুজরাটি, ইউপি আর বিহারীরা বাংলার যথাযথ অতীত সম্পর্কে জানে? ‘হামি তুমাকে বালবাসে’ বলা মানুষগুলি কি জানে, ইংরেজের কেরানি আর নকশাল হওয়া ছাড়াও বাঙালি এককালে আরো অনেক কিছু করেছে? এখন না থাক, অতীতে কিছু বাঙালির মেরুদন্ড বলে একটি জিনিস ছিল, সেটা সম্বন্ধে তাদের কি কোন জ্ঞান আছে? আচ্ছা তাদের কথা বাদ দিন, একজন গড়পড়তা বাঙালিই এই বারো ভূঁইয়াদের ব্যাপারে কিছু জানে?
অথচ আমরা, লিবেরাল বাঙালিরা আমাদের মধ্যযুগের ইতিহাস খাতাখানা ভরিয়ে রেখেছি পাঠান, আফগান আর মুঘলদের গদগদে ভক্তিগীতি দিয়ে। নিজেদের বাহুবলের কথা বলতে কুন্ঠিত বোধ করা, নিজের মানুষকে ‘নিজের মানুষ’ বলাকে প্রাদেশিকতা ভাবা এক প্রগ্রেসিভ জাতি হিসেবে আমাদের স্বাধীন শাসকদের আমরা ইতিহাস বইতে জমিদার, সামন্তপ্রভু বলে বেশ খাটো করা একটা জায়গায় মাত্র কয়েকটা লাইন দিয়েছি। ইতিহাস বইয়ের কয়েকটা পাতাও আমরা তাদের জন্য বরাদ্দ করিনি।
একজন বাঙালি হিসেবে এই আক্ষেপ রাখব কোথায়?
ক্রমশ…
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের ইতিহাস – রমেশ চন্দ্র মজুমদার প্রতাপাদিত্য – নিখিল নাথ রায় Bengal Under Mughals – Richard Eaton