• Uncategorized
  • 0

‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ২ ।। খন্ড – ১৫)

কফি পাহাড়ের রাজা

দ্বিতীয় পর্ব:

১৫)

ক্যাম্পবেলের সঙ্গে বিয়েটা হয়ে গেল গৌরাম্মার। রানী আর আপত্তি করেননি বিশেষ। প্রিন্স অ্যালবার্টের কথা মতো সেরকমই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ওঁরা। দলিপকে তাঁর নিজের মতো চলতে দেওয়া হোক—এরকমই আপাত ভাবনায় তাঁকে তাঁর দেশে মায়ের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল সেই সময়ে। একসময়ে ক্যাম্পবেলের ঘরনী হয়ে গৌরাম্মা বিদায় নিল রানীর কাছ থেকে। গৌরাম্মাকে বিদায় জানানোর সময়ে রানী তাঁকে অবশ্য বলে দিয়েছিলেন—কোনরকম অসুবিধে হলে বা ওখানে মানাতে না পারলে, অথবা আরাম আয়েসের অভাব থাকলে, সে যেন কোনরকম দ্বিধা না করে মায়ের প্রাসাদে ফিরে আসে। এই প্রাসাদে তার অধিকার রয়ে যাবে সারাজীবন। হাসিমুখে বরকনে হানিমুনে চলে গেল। রানী অবশ্য মেয়ের মাসান্তের প্রাপ্য টাকা কিছু বাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। যদিও গৌরাম্মা তাতে রাজি হয়নি। শুরু হল তাদের এক নতুন জীবন।
  কুপিল্লা ভাবছিল, তাদের বিবাহিত জীবন কিন্তু সুখেরই প্রায়। অভাব শুধু সন্তানের। অবশ্য ‘শুধু সন্তানের’ বললে অভাবের প্রকরণটা ঠিক বোঝানো যাবে না। একজন মেয়ের মা হতে না পারার অতৃপ্তি সে পুরুষ হয়ে কীকরেই বা অনুভব করবে! ধীরে ধীরে বিদ্যা অনেক শান্ত, ধীর হয়ে উঠেছে। কথা বলা কমে গেছে তার। কথায় কথায় আর হাসে না, অভিমান করে না। কঠিন, কঠোর হয়ে উঠছে একটু একটু করে। মাঝেমাঝে কুপিল্লা চেষ্টা করে হাসি, পরিহাস দিয়ে ভুলিয়ে রাখার। কিন্তু সে যে সাময়িক, সে হাসিও যেন কষ্টার্জিত বুঝতে অসুবিধে হয় না। তবুও দিন কেটে যাচ্ছিল এক রকম। কুপিল্লা মনে মনে পরিকল্পনা করেছিল, একটি অনাথ শিশুকে দত্তক নেবে। সে পরিকল্পনা যদিও বিদ্যাকে জানায়নি ঘুণাক্ষরেও। ভেবেছিল খুব অবাক করে দেবে ওকে। আবার হাসিতে, খুশিতে, শিশুর কলকলে তাদের সংসার পূর্ণ হয়ে উঠবে। কিন্তু কুপিল্লাও জানত না, বিধাতার অন্য পরিকল্পনা ছকা আছে। তাঁর প্ল্যান মাফিকই চলছে সংসার। সেই প্ল্যানকে চ্যালেঞ্জ জানায় মানুষ ঠিকই, কিন্তু সাফল্যের পরিসংখ্যান কম।
  ক্যাম্পবেলকে আগে যত আমুদে মানুষ মনে হয়েছিল, বাস্তবে সে ঠিক তার উলটো। তার নিজের বক্তব্য অনুযায়ী সে নাকি পার্টিতে অত হাসিখুশি ভাব দেখাত স্রেফ গৌরাম্মাকে প্রভাবিত করার জন্য। আর ভালবাসা বলে নাকি এ পৃথিবীতে কিছু হয় না। ওটা শুধু এক মোহ এবং শারীরিক আকর্ষণ ছাড়া আর কিছু নয়। গৌরাম্মার শরীর নিয়ে খেলতে তার ভালই লাগে—এই পর্যন্তই। এই বক্তব্যের পরে গৌরাম্মার চোখ থেকে যেন এক পর্দা সরে গেল। হটকারিতার মাশুল জোগাতে হবে তাকে আজীবন, নয়ত ছেড়ে চলে যেতে হবে ক্যাম্পবেলকে। এই যদি তার প্রকৃত রূপ হয়, তাহলে সত্য বলে কিছু নেই পৃথিবীতে! কিন্তু গৌরাম্মা তখনও জানত না, এইটুকুই প্রকৃত রূপ নয় ক্যাম্পবেলের। কিছুদিন বাদে তার অপ্রকাশিত রূপটুকু ধরা দেবে আরও বীভৎস ভাবে।
  একদিন রাতে ক্যাম্পবেল বেহেড হয়ে ফিরল। এসেই চিৎকার চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিল বিশ্রী ভাবে। গৌরাম্মা যতই তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে ততই সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। তার বক্তব্য হল—তার মাইনের টাকা নাকি রানীর মেয়ের বিলাস ব্যসনে ফুরিয়ে যাচ্ছে। গৌরাম্মা কেন নিজের খরচ নিজে চালাচ্ছে না, ইত্যাদি। বাস্তবে গৌরাম্মা কিন্তু তার নিজের টাকায় চলে। এমনকি সংসার খরচেও সে উদার হস্ত সবসময়ে। আজ তার কাছে একটি বিশেষ দিন ছিল। অনেকক্ষণ অপেক্ষায় বসেছিল ও স্বামীর জন্য। আজই প্রথম ডাক্তারের মুখ থেকে সে নিজের মাতৃত্বের আগমনী শুনেছে। খুশিতে বিহ্বল হয়ে ছিল ও। ভেবেছিল আজকের দিনটা ক্যাম্পবেল না জানি খুশিতে আত্মহারা হয়ে কত আনন্দ করবে! কিন্তু আজই ও এভাবে এসে অসভ্যের মতো কাণ্ড ঘটাবে, স্বপ্নেও ভাবেনি গৌরাম্মা। সে কিছু বলল না আর ক্যাম্পবেলকে। উপরন্তু ক্যাম্পবেল এরপর গৌরাম্মার গয়নার হিসেব চাইল। ঘাড় সোজা করে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হল গৌরাম্মা। না! এই লোভী লোককে সে আর কিছুতেই বরদাস্ত করবে না। সেই মুহূর্তে নিজের গার্ডকে ডেকে ক্যাম্পবেলকে নিজের ঘরে শুইয়ে দিতে বলল। সারারাত সে পাথরের মতো বসে রইল। বুঝল, এবার থেকে নিজের সন্তানের এবং নিজের খেয়াল তাকে একাই রাখতে হবে। এক অযোগ্য, অধমকে সে বিয়ে করেছে ভুল করে।
  পরেরদিন অবশ্য ক্যাম্পবেল নিপাট ভালমানুষের অভিনয় করল। ক্ষমা চাইল বারবার। একটু নরম হল গৌরাম্মাও। বলেই ফেলল সন্তানের খবর। খুবই উচ্ছাস দেখাল ক্যাম্পবেল। কয়েকদিন স্বাভাবিক ভাবেই কাটল দিনরাত। কিন্তু কিছুদিন পরে আবার ক্যাম্পবেল ক্ষেপে উঠল। এবং এই ঘটনা বারবার হতেই থাকল। একসময়ে এমন অবস্থা হল যে, ক্যাম্পবেলের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতে ভয় পেত গৌরাম্মা। এদিকে সন্তান সম্ভবা এক নারী, আতঙ্কিত, অসুখী, যার খেয়াল রাখার কোন আত্মীয়, বন্ধু নেই, মনে আনন্দ, খুশি তো দূরে থাক, হতাশা চেপে বসেছে—সেই নারী যে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাবে, সে আর অস্বাভাবিক কী? একটি মেয়ের জন্ম দিল গৌরাম্মা।
  ১৮৬১ সালের ২রা জুলাই গৌরাম্মার মেয়ে, এডিথ ভিক্টোরিয়া গৌরাম্মা ক্যাম্পবেল জন্মগ্রহণ করল। সেই থেকে তার পিতা প্রায়শই অনুপস্থিত থাকত বাড়িতে। মাঝেমাঝে ধূমকেতুর মতো উদয় হয়ে টাকাপয়সা হাতিয়ে নিয়ে চলে যেত কোথাও। পয়সা ফুরোলে আবার এসে হাজির হত। নিঃসঙ্গ গৌরাম্মা একার জীবন টানতে টানতে কখন যে যক্ষ্মারোগের প্রকোপে পড়ল, কেউ বুঝলই না। তার তেইশ বছরের জন্মদিনের কয়েকদিন আগে, ১৮৬৪ সালের মার্চে গৌরাম্মা এ ধরাধাম থেকে বিদায় নিল। আর তার কিছুদিন পর থেকেই ক্যাম্পবেলের আর কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি আশ্চর্যজনকভাবে। ক্যাম্পবেল শেষ পর্যন্ত গৌরাম্মা গয়নাগাটি হাতিয়ে নিতে পেরেছিল।
  কুপিল্লা পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে গাছের চারা গুনছিল মন দিয়ে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছিল প্রতিটি চারাকে। এ কাজে সে খুব দক্ষ হয়ে উঠেছে। মুরুগান তার ওপর দায়িত্ব দিয়ে এই লাইনের ব্যাপারে বেশি মাথা ঘামায় না। দায়িত্বে অবহেলা কুপিল্লাও কোনোদিন করেনি। আর সেই দায়িত্ব সামলাতে গিয়েই তার পা হড়কে গেল আচমকা। কদিন আগে প্রবল বৃষ্টি এসেছিল। মাটি ভিজে হয়ে আলগা ছিল হয়ত। যে কারণেই হোক, কুপিল্লার শরীর গড়াতে গড়াতে খাদে গিয়ে পড়ল। হৈহৈ করে ছুটে এলো লোকজন। ওর অচৈতন্য দেহ উদ্ধার করে ডাক্তার, হাসপাতাল, অনেক ছোটাছুটি হল। সেযাত্রা কুপিল্লা বেঁচে গেল বটে, কিন্তু তার শরীরে আর নড়াচড়ার ক্ষমতা রইল না। বিদ্যার জীবনে আচম্বিতে এমন চমক দিয়ে গেল বিধাতা, যা তাদের দুজনের কল্পনাতেও ছিল না। বিছানায় শুয়ে থাকে অসাড় শরীর এক, যার কথা বলার ক্ষমতাও চলে গেছে প্রায়। বিদ্যাই কেবল বোঝে তার জড়ানো সংলাপ। কিন্তু খিদে বড় দুর্বিসহ। দুটো জীবন্ত প্রাণের অন্নের প্রয়োজনে বিদ্যাকেই এবার কাজে নামতে হল। মুরুগান অবশ্য এই দুর্ঘটনার জন্য কুপিল্লাকে কিছু টাকাপয়সা দিয়েছিল, কিন্তু তা দিয়ে আর কদ্দিন? তাই একদিন বিদ্যা মুরুগানের কাছে গিয়ে পড়ল কাজের জন্য। মুরুগানও কালবিলম্ব না করে ওকে কুলি লাইনে কাজ দিয়ে দিল। আর তারপরে চাকা গড়াতে গড়াতে অনেক অনেক বছর কেটে গেছে। সেই সময়টায় মুরুগান বা বিদ্যার কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই।
    ইতিমধ্যে মহারানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্ট জার্মানিতে অধ্যয়নরত লিওপোল্ডের এক অভিনেত্রীর সঙ্গে যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা শুনে, ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে নিজেই জার্মানিতে চলে যান। সেখান থেকে তিনি মারাত্মক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ফেরেন। টাইফয়েডের ধাক্কায় ১৮৬১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তিনিও মারা যান। এই ঘটনার শোকে ভেঙে পড়েন রানী। বারবার নিজের ছেলেকে স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করতে থাকেন। অবস্থা এমনই হয় যে, তিনি এরপর থেকে স্বামীর শোকে বাকি জীবন কালো পোশাক পরে কাটিয়ে দেন। এই জন্যই বুঝি তাঁকে ‘উইডো অফ উইন্ডসর’ বলা হত। বাকি জীবনে তিনি আর জনসমক্ষে আসেননি, শাসনভারও রাখেননি নিজের হাতে। লোকশ্রুতি আছে গভীর ডিপ্রেশনে রানী শেষ জীবনে অস্বাভাবিক স্থূলকায়া হয়ে গেছিলেন।

দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *