• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১২৯)

পর্ব – ১২৯

শ্রাদ্ধের মন্ত্রপাঠসহ নানাবিধ কৃত‍্য চলছে। পুরোহিতের সংস্কৃত উচ্চারণ মার্জিত তো নয়‌ই, এমনকি মোটের উপর সঠিক‌ও নয়। সংস্কৃতকে এদেশে দেবভাষা বলা হয় বটে, কিন্তু শুদ্ধ ও মার্জিতভাবে সংস্কৃতচর্চাকে আদৌ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। শুধু সংস্কৃতচর্চাই বা কেন, যে কোনো কঠোরভাবে পরিশ্রমসাপেক্ষ গবেষণায় এদেশের মানুষের অরুচি।  ওই যে গীতায় বলা হয়েছে শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জমেব চ। জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক‍্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্।। এতে খুব স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ভদ্রলোকের পক্ষে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের প্রতি আস্থা রাখা স্বাভাবিক কাজ। আর নিজেকে শান্ত রাখা, ইন্দ্রিয়পরতাকে শাসন করা, ভিতরে বাইরে স্বচ্ছ পরিচ্ছন্ন থাকা, সহজ সরল নির্মল জীবনে আস্থা রাখা, এগুলি মান‍্য করতে বলা হয়েছে। অথচ কাজে কর্মে এদেশের মানুষ তার ঠিক বিপরীত। জ্ঞানচর্চাকে গীতাকার বারংবার উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন। ওই সাথে ইঙ্গিত করেছেন কোনো কিছু হাতে করে পাবার জন‍্য নয়, জ্ঞানচর্চা থেকে উদ্ভূত আনন্দই চর্চাকারীর সেরা প্রাপ্তি। বলেছেন, শ্রেয়ো হি জ্ঞানমভ‍্যাসাজ্ জ্ঞানাদ্ধ‍্যানং বিশিষ‍্যতে। ধ‍্যানাৎ কর্মফলত‍্যাগস্ত‍্যাগাচ্ছান্তিরনন্তরম্।।
গীতাকার এত উৎসাহ নিয়ে বললেন, অথচ এই জ্ঞানচর্চাটাকেই এদেশের মানুষ সবচাইতে অকিঞ্চিৎকর ভাবে। লেখাপড়া যে কোনো কোনো মানুষ করে না, তা নয়, তবে সে নিছক জাগতিক সুযোগ সুবিধা টেনে নেবার জন‍্য। ওইজন‍্য কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়ে একটা চাকরি জুটিয়ে ফেলতে পারলে, লোকজন আর ব‌ইপত্রের কদর করে না। উকিল এক‌ই ঘানিতে নিজেকে ঘোরাতে থাকে। মক্কেল নিংড়ে গাড়িবাড়ি করাই তার জীবনের মোক্ষ। ডাক্তার মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের জিভের দাস। কোন্ কোম্পানির ওষুধ খামকা লোককে কত গেলাতে পারলে বিদেশ ভ্রমণটা ফোকটে সারা যায়, তার বুদ্ধি চলে সেই দিক ঘেঁষে। এদেশের মিস্ত্রি মজুররা কলকব্জা ঘাঁটাঘাঁটি করে তার নিয়মকানুনগুলি উপর উপর শিখে নেয়। কেন অমন হয়, অন‍্য কিছু হয় না কেন, ও প্রশ্ন কোনোভাবেই তাদের নাড়া দেয় না। তাই চাষির ঘর থেকে উইলিয়াম ফেরেল বা ব‌ই বাঁধাই দপ্তরির পক্ষে মাইকেল ফ‍্যারাডে হয়ে উঠতে সচরাচর দেখা যায় না।
গীতাকার বলছেন, শ্রেয়ান্ দ্রব‍্যময়াদ্ যজ্ঞাজ্ জ্ঞানযজ্ঞঃ পরন্তপ। সর্বং কর্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ‍্যতে।। নানা ধরনের এটা সেটা জিনিসপত্র যোগাড়যন্ত্র করে, এটার পর ওটা করতে হয়, সেটা করার সময় না বুঝেই অমুক মন্ত্র বলতে হয়, একে গীতাকার ভালো চোখে দেখেননি। তিনি জ্ঞানচর্চাকে বেশি কাঙ্ক্ষিত বলেছেন। বলেছেন সকল কর্ম জ্ঞানেই সমাপ্ত হয়। অথচ সারা জীবন কাজ করতে করতেও এদেশের লোকের জ্ঞান আর হয় না। ঘরে সে দেখতে পাচ্ছে, খাট, বাসনকোসন, ছাতা জুতো সাজানো হয়েছে মৃত ব‍্যক্তিকে উপহার দেবার নাম করে। আবার পাশেই গীতাপাঠ করা হচ্ছে। মূল পুরোহিত একের পর এক মন্ত্র বলে যাচ্ছেন। শ্রাদ্ধাধিকারী তা যান্ত্রিকভাবে আবৃত্তি করে চলেছেন। পুরোহিতের দায় নেই উচ্চারিত মন্ত্রের গূঢ়ার্থ বা ব‍্যঙ্গার্থ দূরের কথা, বাচ‍্যার্থটুকু শ্রাদ্ধাধিকারীকে বুঝিয়ে দেবার। যিনি শ্রাদ্ধ করছেন, তিনিও কোনো প্রশ্ন তুলবেন না। অথচ পরিপ্রশ্ন ধারণাটিকে গীতায় যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন করলেই তুমি খারাপ। প্রবাহণ রাজার সভায় বিতর্কের আয়োজন হয়েছে। গার্গী প্রশ্ন করছেন। উপলব্ধির উচ্চ শিখরে গার্গী। কঠোর প্রশ্ন করছেন। উত্তর দেবার দায় যাজ্ঞবল্ক‍্যের। মেধাবী গার্গীর সুতীক্ষ্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না যাজ্ঞবল্ক‍্য। একটি মেয়ের প্রশ্নের সামনে বিপন্ন বোধ করছে প্রতিষ্ঠিত ব‍্যবস্থা। যাজ্ঞবল্ক‍্য মেজাজ ঠিক রাখতে পারলেন না। কটুভাবে বললেন, গার্গী, আর একটাও যদি প্রশ্ন করো, তোমার মুণ্ডু মাটিতে গড়াগড়ি খাবে।
শ্রাদ্ধকর্ম চলছে। রমানাথের সাথে কথা হয়েছিল শ্রাদ্ধের সময় শ‍্যামলী তাঁর কাছাকাছি থাকবে। সে তাই করেছে। বয়স্ক ব‍্যক্তিদের বসার ব‍্যবস্থা সামনে। মধ‍্যে পুরুষেরা বসেছেন। একেবারে পিছনে কিছু মেয়ে বৌ। তারা চাপা স্বরে অনবরত কথা বলে চলেছে। তাদের আলোচনার বিষয় নিতান্তই জাগতিক। তারা ফিসফিস করে আলোচনা করছে শাড়ির ধরণ, শাড়ি পরার ধরণ, আঁচলের কারুকাজ, গহনা বেশি করে না পরলে ভাল দেখায় কি না, চেহারায় মোটা হলে সুন্দর বলতে হয় কি না, এইসব। বয়স্ক ব‍্যক্তিরা কেউ কেউ এক আধবার কড়া চোখে পিছনে তাকিয়ে ইঙ্গিতে ভর্ৎসনা করছেন। কয়েকটি মিনিটের জন‍্য শাড়ি জামা গহনা নিয়ে পারস্পরিক বক্তব্য উত্তর প্রত‍্যুত্তর থমকে দাঁড়াচ্ছে মাত্র। একটু পরেই আবার ফিসফিস শুরু। বাইরে কাদের একটা বাচ্চা কাঁদছে। একজন বয়স্ক মহিলা বলছেন বাচ্চা ছেলে কাঁদতে থাকলে বুকের দুধ দাও। সে মেয়ে বুঝি বেশ পরিপাটি করে সেজেগুজে এসেছে। বাচ্চাকে বুকের দুধ দিতে গেলে সব এলোমেলো হয়ে যাবে। সে বোতলের ব‍্যবস্থা করেছে। বাচ্চার তা পছন্দ নয়। মায়ের অখণ্ড মনোযোগ সহ স্তনের বোঁটায় মুখ রাখার সুখের জন্য সে নাছোড়। বৌটি দিল বাচ্চার পিঠে দুটি চাপড়। রেগে উঠে বাচ্চা আরো ককিয়ে উঠল।
এক‌ই ঘরে নানাবিধ দর্শক থাকায় ঘরটি সরগরম হয়ে উঠছে মাঝে মাঝেই। দত্ত দা, কতক্ষণ এসেছেন, এমন প্রশ্ন এইঘরে করার সারবত্তা ঠিক কি কিছুতেই বোঝা যায় না। একঘেঁয়ে ভাবে এককোণে গীতাপাঠ হচ্ছে। যিনি গীতাপাঠ করছেন, তিনি যেন ভালভাবেই জানেন, তাঁকে যান্ত্রিক ভাবে পাঠ করে যেতে হবে। পাঠটুকু হ‌ওয়া নিয়ে কথা। তাতেই মজুরি মিলবে। অবশ‍্য গলায় পৈতে ঝোলানো আছে বলে মজুরি কথাটা না বলে, বলা হবে দক্ষিণা।
শিরদাঁড়া টানটান করে বসে আছে শ‍্যামলী। আজ রমানাথ তার করস্পর্শ করেছেন বলে তার সে রকম কিছু মনে হয় নি। তার বেশ মনে আছে, তার বাবার হাসপাতালে থাকার সময় অপারেশন করার দিনে পর্যন্ত শিয়ালদহের হোটেলে সে অতি ভোরে উঠে বেড়াতে বেরিয়েছিল। সেদিন অরিন্দম দাশগুপ্ত ও প্রবাল সেন, দুজনে তার দুটি হাত ধরে হেঁটেছিল। ওই যে হাত ধরা, ওটা তার খারাপ তো লাগেই নি বরং ভাল লেগেছিল। কিন্তু অন‍্য সকলে তো এটাকে ভাল চোখে না দেখতেই পারে। বিশেষত‌ঃ, এই বাড়িতে কাজের মেয়েরা সহ সবাই মিলে এমন ভাব দেখাচ্ছে, তার সাথে যেন রমানাথের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। সাতপাকে বাঁধা মনে মনে হয়েই গিয়েছে। লৌকিক আচার আচরণটুকুই যা বাকি। রমানাথের মা তাকে রাতে থাকতে বলছেন। তিনি নাকি একটা ঘর পর্যন্ত তার জন‍্য ঠিক করে রেখেছেন। শ‍্যামলী ঘরটি দেখেছে। ছোটো একটা ঘর। সিঙ্গল একটা খাট। একটা দেরাজ। ঘরটার সবচেয়ে বড় সুবিধা যে , অ্যাটাচ বাথরুম রয়েছে। কিন্তু শ‍্যামলী ঠিক করে ফেলেছে, এ বাড়িতে সে রাতে কিছুতেই থাকবে না। আগামীকাল সে কলেজে যাবে এবং ক্লাস করবে। রমানাথ অনেকবার করে আবদার করেছেন, তাই তার আসা। ন‌ইলে এমন অনুষ্ঠানে আসার কোনো প্রবৃত্তি তার নেই।
যান্ত্রিকভাবে এক‌ই কৃত‍্য বার বার হয়ে চলেছে। নকুড় নন্দী প্রেতস‍্য বলে একটা কথা কানে খটখট করে লাগছে। প্রেত কথাটা উচ্চারণ করার সময় রমানাথের মুখটা ঠিক কি রকম দেখাচ্ছে জানতে ভারি ইচ্ছা করছে তার। কিন্তু উপায় নেই। একটা ইমেজের মধ‍্যে ধরা পড়ে গেছে সে। ঠিক যেমন কারখানার অফিসে সে গম্ভীর হয়ে ছোড়দি সেজে বসে থাকে, কলেজের ক্লাসে মেয়েরা জানে এই মেয়েটা হাসে না, সেই রকম এখানেও। রমানাথের মা এটা কি করলেন! সবার সামনে বলে দিলেন, তোমাকে পরিচালনা করতে হবে। তিন কাল পেরিয়ে যাওয়া কাঠ কাঠ বুড়িদের কাছে দাঁড়িয়ে সে সদ‍্যবিধবা মহিলার এই অনুজ্ঞা অবহেলা করতে পারল না। তার উপর রমানাথ বলে রেখেছেন আড়াল থেকে সমস্ত আয়োজন করেছে আশ্রম। অর্থাৎ বীরুবাবু। কারবারের চাবিকাঠি মায়ের হাতে। রমানাথ মায়ের আদরের খোকা মাত্র। কোনো ব‍্যাপারে তার কোনো সিদ্ধান্ত নেবার এক্তিয়ার তাঁর নেই। এমন একটা অবস্থায় নিজের নৌকার হাল ধরার অনুরোধ তাকে করেছেন রমানাথ। সেই রমানাথ যিনি তাকে মার খাওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন।
শ‍্যামলী বেশ টের পাচ্ছে, সে রমানাথের প্রতি কৃতজ্ঞ।  বোনকে মারার জন‍্য শান্তু যেই কিল তুলেছে, অমনি শক্ত মুঠোয় শান্তুকে আটকে দিয়েছেন রমানাথ। শান্তু চ‍্যালেঞ্জ করেছিল, আমার বোনকে আমি শাসন করছি, আপনি তার মধ্যে কথা বলছেন কোন্ অধিকারে?
রমানাথ সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন, অধিকার যে কিছু একটা আছে, তা আপনি নিশ্চয়ই টের পাচ্ছেন। রমানাথ তাদের বাড়িতে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট করে তাঁর যে একটা অধিকার আছে তা ঘোষণা করেছেন। এই অধিকার আসলে অন‍্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অধিকার। দুর্বলের উপর সবলের অত‍্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ন‍্যায়সঙ্গত অধিকার। শ‍্যামলী ভাবল, আজ তার প্রতিদান দেবার সুযোগ এসেছে। বন্ধু হিসেবে সে যথাকর্তব‍্য করবে।
এদেশের মানুষ ছেলে ও মেয়ের মধ্যে সহজ সরল বন্ধুত্ব কল্পনায় আনতে পারে না। মেয়েদের তারা নিচুশ্রেণীর জীব ভাবে। মেয়েরাও নিজেকে নিম্নমানের ভাবে। তুমি যদি নিজে নিজেকে হীন না ভাবো, তোমাকে হীন করবে কে? বিচার বুদ্ধি, পর্যবেক্ষণ শক্তি, বাচনভঙ্গি, সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা, সব অভ‍্যাসগুণ। সচেতন ও সক্রিয় অভ‍্যাস করলে তবেই আয়ত্ত্ব হয়।
একঘেঁয়ে মন্ত্রোচ্চারণ শ‍্যামলীকে বীতশ্রদ্ধ করে দিয়েছে। সে টানটান হয়ে বসে আছে ঠিকই, কিন্তু নানাবিধ চিন্তার ঢেউ তার ভিতর উঠছে এবং পড়ছে। এমন সময় তার মনে হল, পিছনে মেয়েরা তার পোশাক আশাক সাজগোজ নিয়ে গুনগুন করছে।
শ‍্যামলী হাই নেক থ্রি কোয়ার্টার ব্লাউজ পরেছে। মেয়েদের মধ্যে সেই ব্লাউজ পরা আরামদায়ক নয় বলে একটা মত উঠল। অন‍্যেরা বলল, কলেজের ছাত্রীর পক্ষে এটা বেশ মানানসই। তার শাদা পোশাকের সঙ্গে মুক্তোর হার ও দুল খুব মানিয়েছে। কিন্তু হাতে চুড়িও পরা উচিত ছিল বলে মতামত এল। তারপর একজন বলল পায়ে নূপুর পরলে ওকে খুব ভালো লাগত। শ‍্যামলী আরো আশ্চর্য হয়ে গেল যখন একজন বলল, হবু বরকে নাম ধরে ডাকা উচিত নয়। বর মানে একরকম গুরুজন। সেই হিসেবে যার সাথে বিয়ের ঠিক হয়ে গিয়েছে, সেও গুরুজন।
শ‍্যামলীর হাতটি যে রমানাথ একবারটি ধরেছিল, সেই কথাও এতক্ষণে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছে। একটা মত উঠে এল, পিতৃশ্রাদ্ধে বসার কিছু আগে রমানাথ এই আচরণ করে গর্হিত কাজ করেছেন। একজন দোষ চাপালো শ‍্যামলীর ঘাড়েই। মেয়েমানুষ হয়ে অতটা কাছে যাওয়া নাকি উচিত হয়নি শ‍্যামলীর।
শ‍্যামলী যে কলেজে পড়ে, আর পড়াশুনায় রীতিমতো ভাল, সে খবর এদের জানা। জলপানির টাকার পরিমাণ জানা না থাকলেও মেয়েদের হাতে আগে ভাগেই টাকা এসে গেলে সে উদ্ধত ও অসংযমী হয়ে পড়ে, এটা জানা গেল। কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের লাজলজ্জা একটু কম হয়। তারা প্রেমপত্র পায়, এমনকি প্রেমপত্র পাবে বলে মুখিয়ে থাকে।
কোনো কোনো মেয়ে এমনকি প্রেমপত্র জমায়। নিজেদের মধ্যে অঘোষিত প্রতিযোগিতা করে। কেউ কেউ উত্তর অবধি লেখে। এসবের ফলে কলেজের মেয়েদের মনে স্বামীকে দেবতা জ্ঞান করা সম্ভব হয় না, ও সংসারে খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে অশান্তি সৃষ্টি হয়। ফিসফিসিয়ে বলতে থাকা এইসব অদ্ভুত উদ্ভট বক্তব্য শুনে শ‍্যামলীর ভীষণ রাগ হতে লাগল। কান লাল হতে শুরু করতে সে উঠে পড়ে কলঘরে গিয়ে ঘাড়ে চোখে মুখে জল দিয়ে নিজেকে ঠাণ্ডা করে আবার শ্রাদ্ধস্থলে যাবে ভাবছে, এমন সময় রমানাথের মা তাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, শ্রাদ্ধের শেষে রমা উঠে এলে তুমি নিজের হাতে তাকে জল মিষ্টি দিও। এই নির্দেশটা নিতান্তই অদ্ভুত বলে মনে হল শ‍্যামলীর। একটা প্রাপ্তবয়স্ক লোক, নিজের বাড়িতে জল খেতে গেলে শ‍্যামলীকেই সেটা গুছিয়ে দিতে হবে কেন? বিশেষত‌ঃ যে বাড়িতে এত কাজের লোক রয়েছে! শ‍্যামলী কোনো তর্কে জড়াতে চাইল না। নীরবে ঘাড় নেড়ে সরে এল। তখনই দেখল ঝলমলে একটা পরীর মতো সেজে তার দিদি তনুশ্রী গাড়ি থেকে নেমে শ্রাদ্ধ বাড়িতে ঢুকছে। তাকে দেখেই দিদি হাত ধরে টেনে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলল, মুখটার কি দশা করেছিস্, একটা টিপ পর্যন্ত পরতে পারিস্ নি?
শ‍্যামলী বলল, চন্দন দিয়ে টিপ এঁকেছিলাম। মুখে চোখে জল দিতে গিয়ে ধুয়ে গিয়েছে। দিদি তার হাতে একটা চিমটি কেটে বলল, মুখটা এমন রামগরুড়ের ছানার মতো করে রেখেছিস কেন? হাসি খুশি থাকলে কি মিষ্টি লাগে তোকে জানিস্ না?
শ‍্যামলী বলল, দিদি, আমি একটা দুঃখের অনুষ্ঠানে এসেছি। এমন সময়‌ই তার চোখে পড়ল প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর অন্ত‍্যেষ্টি ক্রিয়ার টেলিকাস্ট হচ্ছে। রাজঘাটের কাছে শক্তিস্থল নামে একটা জায়গা চিহ্নিত করে সেখানে মায়ের মরদেহে অগ্নিসংযোগ করছেন রাজীব গান্ধী। তাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে। যে মানুষটা সাংসদ পর্যন্ত নয়, রাজনীতিতে নিতান্তই অনভিজ্ঞ, তাকেই ভারতীয় রাজনৈতিক কর্তাব‍্যক্তিরা প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছেন। তনুশ্রীর বর অরুণ সবাইকে শুনিয়ে বলল, এই পরিবারের আত্মত‍্যাগ ভারতের ইতিহাসে সোনারজলে লেখা থাকবে। শ‍্যামলীর বলতে তীব্র ইচ্ছা করছিল, একে আত্মত্যাগ বলে না। নিজের হঠকারী আচরণের প্রতিদান পেয়েছেন ইন্দিরা। কিন্তু তার চোখে পড়ল রাজীব গান্ধী মাতৃদেহে অগ্নিসংযোগ করছেন, এই দৃশ‍্য দেখে শ্রাদ্ধ বাড়িতে অভ‍্যাগত জনেরা অনেকেই রুমালে চোখ মুচছেন। সে প্রবল পরাক্রমে নিজেকে সংযত করল। তার মনে হল নিজেকে শান্ত রাখা ভদ্রতার অন‍্যতম পরিচায়ক।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।