দোতলায় ঐ শেষের প্রান্তটুকু স্থান-কাল-পাত্রের বিচারে কারোর খুব প্রিয় স্থান ছিলো, কারোর প্রায় সাক্ষাৎ নরকের দ্বার। ঘরে বসা মানুষগুলির বৈশিষ্ট্য ছিলো (এখনও নিশ্চিত আছে) তাঁরা পড়াশুনোয় ভালো খারাপ দেখে ভালোবাসতেননা, যারা তাঁদের ভালোবাসতে শেখেনি তাদেরও স্নেহই ক’রতেন তাঁরা। কিন্তু যারা তাঁদের ওপর পূর্ণ নির্ভরশীলতা দেখাতো তাদের জন্য সর্বস্ব দিতেও পারতেন অবশ্যই। অপরাধ ক’রলে রাগ দেখাতেন, ক’রতেননা। অবাধ্য হ’লে দুঃখ ক’রতেন, দেখাতেননা।
এমনিতে ছোটোখাটো চড়চাপড় বা হাঁটু গেড়ে কান ধ’রে বসা ছাড়াও বিভিন্ন অভিযোগে আমার মা বাবাকে তাঁদের সামনে মাথা নীচু ক’রতে হ’য়েছে বহুবার। তখন ভয় পাইনি বা রাগ ক’রিনি, এমন কথা ব’লবোনা। প্রথাগত শিক্ষালাভের দৌড়ে পিছিয়েই থেকেছি বরাবর। মর্জিমতো তাঁদের কাজে ব্যাঘাত ঘ’টিয়েছি। একটু বড়ো হ’লে স্বভাবগত ঔদ্ধত্যও দেখিয়ে ফেলেছি। তবু তাঁরা ভালোবেসেছেন। অকারণে মিথ্যাচারণের অভ্যাস ছাড়িয়েছেন। বাবা প্রকাশ্য রাস্তায় অপমান ক’রলে ঘরে ব’সিয়ে চোখ মুছিয়েছেন। প্রথম সারির ছাত্রদের মতো সরাসরি প্রশ্ন ক’রতে অদ্ভুত লজ্জা লাগতো (খারাপ বিষয়ে লজ্জা লাগতোনা কিন্তু এসবে খুবই লাগতো) ব’লে কতো উত্তর দিতেও পারিনি, তারপরেও তাঁরা যতোটুকু সহজ ক’রে পেরেছেন আমাকে বোঝাতে সফল বা নিষ্ফল চেষ্টা ক’রে গেছেন।
এ জীবনে পার হ’য়ে আসা কোনো পথই কি কুসুমাস্তীর্ণ হ’তে পারে? না, বোধ’য়। পড়া না পারায় তাঁদেরও কেউ কেউ আমায় কখনও বাবার পেশা তুলে তাচ্ছিল্য ক’রেছেন, কেউ বা বিনা অপরাধে আমার পূর্বে ঘটানো দুষ্কর্মের যুক্তিতেই মেরেছেন চড়। কিন্তু দিনের শেষে আমি তো মনে রাখবো সেই অকস্মাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বোকার মতো প্রশ্ন ক’রেও প্রশ্রয় পাওয়ার দিনগুলিই। মনে রাখবো সাহস ক’রে মুখ বাড়িয়ে, “ও স্যার আসবো? ” ব’লে উত্তরের অপেক্ষায় না থেকেই ঘরে ঢুকে পড়ার মুহূর্ত। আজ আমাদের কেউ ডাক্তার, কেউ বিভিন্ন বেসরকারী তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্রে চাকুরীরত, কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও, কেউ ক্রীড়াজগতে, কেউ বা আমার মতো যৎকিঞ্চিৎ লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু আমাদের মতো সকল চারাগাছগুলিতে সযত্নে কুঁড়ি ধ’রিয়েছিলো ঐ বারান্দায় ওঠা রোদ্দুরই। আজও যখন সেখানকার দুয়েকজনকে প্রণাম ক’রলে শুনি, “ভালো লিখছিস” তা একজন প্রতিষ্ঠিত লেখকের মৌখিকতার তুলনায় কোটিগুণে বেশী উৎসাহ দিতে জানে, এ কথা আমি নিশ্চিত ব’লতে পারি। সত্যি ব’লতে কী, পরোক্ষে তাঁরাই তো শিখিয়েছিলেন পড়াশুনোই জীবনের সর্বস্ব নয়।
শ্রী নবনীতা দেবসেন যেদিন এই পৃথিবী ছেড়ে চ’লে গেছিলেন সেদিনই প্রথম শুনেছিলাম এ স্থানের নাম। ধারাবাহিক দূরে থাক, দুয়েকটি প্রবন্ধ ছাড়া তাঁর লেখা সেভাবে পড়াই হয়নি কখনও। আমাদের ছাত্রাবস্থায় বারান্দার পাঁচিলের ওপরে কিছু ছিলোনা, কিন্তু আজ কিছু থাকতে দেখে দুঃখ হ’লেও মনে হয় ঐ গরাদের এ পারে যেন পরম মমতায় সুরক্ষিত আছে আমাদের ফেলে আসা কৈশোর, ফেলে আসা সুখস্মৃতি, স্বপ্নে যাদের কাছে বারবার ফিরে যাওয়া। আজও সরস্বতী পুজো বা অন্যান্য উৎসবে বন্ধু, প্রিয়জন, সেই মানুষগুলি, সকলের সাথে ঐ বারান্দাতে বার্তালাপ হয়, গল্পে গল্পে পুরোনো দিনে ফিরে যাওয়া হয়, কিন্তু একবার, অন্ততঃ একটিবার আমরা প্রত্যেকে একান্তে গরাদের সামনে দাঁড়াই আর নিজেদের পাওয়া না-পাওয়াগুলিকে রোমন্থন ক’রতে ক’রতে ব’লি, “ভালো থেকো, খুব ভালো থেকো, আমার ভালোবাসার বারান্দা”।