• Uncategorized
  • 0

গল্পে মানিক দাক্ষিত

ঘরে ফেরা

টিভির খবরটা কানে যেতেই হঠাত্‍ তিনজন ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে ওঠে। দেখা দেয় ওদের মধ্যে তীব্র মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বাড়ির গিন্নি ছন্দা সজোরে কপালে কড়াঘাত করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। একমাত্র মেয়ে রিয়া হাঁটুদুটোর মাঝখানে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বাড়ীর কর্তা সদানন্দ কঠিন মুষ্টিবদ্ধ ডান হাতখানি জোরসে উপরে তুলে জয়ের উল্লাসে ফেটে পড়ে। তক্তাপোষ থেকে হনুমানের মত তড়াক করে লাফিয়ে গগনভেদী চীত্‍কার করে সে বলে ওঠে, “জিতে গেছি।” খবরটা মিথ্যে নয়। একেবারে টাটকা তাজা খবর। সরকারের ঘোষণা। লকডাউনেও মিলবে মদ। কাল থেকে খোলা থাকবে সমস্ত মদের দোকান। লক্ষ্মী
হয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে লাইনে কিনতে হবে এই অমৃত সুধা। সদানন্দ আহ্লাদে আটখানা!  মনে আনন্দ আর ধরে না! সময় নষ্ট না করে এক্ষুণি দোকানের সামনে একটা ইঁটের লাইন রেখে আসতে চায় সে।

ফোন বেজে ওঠে সদানন্দের। ফোন ধরতেই মুখের হাসি নিমেষে চওড়া হয়ে যায়। বলতে থাকে–
“তোরাও খবরটা দেখেছিস! জব্বর খবর! ও:, এতদিনে ধড়ে প্রাণটা এলো! যা বলেছিস ভায়া। আর ক’দিন পেটে না পড়লে নির্ঘাত ছবি হয়ে যেতাম মাইরি। ঠিক আছে। আবে, শোন না কথাটা– তোরা এক্ষুণি চলে আয় হাবুর চায়ের দোকানে। চা  খেতে খেতে কথা হবে। কি বললি? পুলিশ পেঁদাবে! চায়ের দোকানে বসে চা খেতে দেখলে! আরে বাবা, সামনে খাবো না, দোকানের পাঁদারে বসে খাবো। টেরটিও পাবে না পুলিশের বাবা। কি বললি? কায়দা করে একটা বোতল এরমধ্যে ম্যানেজ করে ফেলেছিস? গুরু!গুরু!! কি বলে যে ধন্যবাদ
দোবো গুরু! তোমার ক্ষুরে দণ্ডবত্‍। এক্ষুণি আসছি আমি।” একটা চিটকুটে ময়লা পাঞ্জাবিতে মাথা গলিয়ে নিমেষে ঘর থেকে হাওয়া হয়ে যায় সদানন্দ।
রিয়া হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে। মা সান্ত্বনা দেয় —
“চুপ কর্, কপালে যা আছে হবে।” রিয়া মাকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলে, “মদ খেয়ে মাঝরাতে ঘরে ঢুকে বাবা ঠিক দেখবে আগের মত অশান্তি করবে। অকথ্য ভাষায় তোমায় গালিগালাজ করবে, মারধর করবে। এগুলো দেখতে আমার মোটেই ভাল লাগে না। বড্ড কষ্ট দেয়।” একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে–“গত দেড়মাস কোনো অশান্তি ছিল না। আজ থেকে আবার শুরু হবে।”
সদানন্দ মানুষটা এমনিতে খারাপ নয়। নিপাট ভদ্র- লোক। কিন্তু পেটে একটুখানি পড়লেই তিনি আর
মানুষ থাকেন না। হয়ে যান অন্য জগতের এক বীরপুরুষ! বাড়ীতে ঢুকে বাধিয়ে দেন দক্ষযজ্ঞ। হাতের কাছে তখন যা পান, ছুঁড়ে মারেন বউটার দিকে। কতদিন ফাটা বাঁশ দিয়ে বউটাকে গরু ঠেঙানো ঠেঙিয়েছে, তার ইয়ত্তা নাই।  মেয়ে বড় হয়েছে। রিয়া এবার উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছে। এ-সব সহ্য করতে পারে না। মাঝে মাঝে রাগের চোটে বাবার হাতদুটো মুচড়ে ধরে দু-কথা শোনায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ভবি ভোলবার নয়।একবার তো বাবার কবল থেকে মাকে ছাড়াতে গিয়ে বাবার বঁটির বাঁটের বারি খেয়ে মাথাটাই চৌচির হয়েছিল। একটা দুটো নয়, সাত সাতটা স্টিচ পড়েছিল।
মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ছন্দা বলে, একটা কথা শুধু ভাবছি, জানিস!” বিষ্ময়ের সুরে মায়ের দিকে মুখ ঘুরিয়ে রিয়া জিগ্যেস করে, “কি কথা মা?”
–ভাবছি আজ তো বিয়াল্লিশ দিন হলো ডাক্তার- বাবুর পরামর্শমতো হোমিওপ্যাথিক মাদার টিংচার ওষুধটা গরমজলে খাওয়ালাম তোর বাবাকে। দেখছি এতটুকু কাজ হলো না। অনীহা তো দূর, দেখি সব্বোনেশে মদের প্রতি আরো আগ্রহটা বেড়েছে। অথচ, উনি বললেন–” কথাটা শেষ হয় না ছন্দার। পিছনে একটা ছায়ামূর্তি দেখে চমকে ওঠে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে সদানন্দ দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। অবসন্ন দেহে ম্লান মুখে যেন একটা প্রশান্তির ছাপ। ছন্দার চোখে-মুখে একরাশ বিষ্ময়। ব্যাপার কি হলো! বাড়ী থেকে বেরিয়েছে এখনও তো একঘণ্টা কাটেনি। এরইমধ্যে ঘরে ফেরা! উদ্বিগ্ন সুরে ছন্দা বলে, “কি-গো, এত তাড়াতাড়ি চলে এলে? শরীর খারাপ নাকি!” –না – না, ভাল লাগলো না। তাই চলে এলাম।
ছন্দা সদানন্দের মুখের কাছে মুখ এনে চেনা গন্ধটা পাবার চেষ্টা করলো। না, মুখ থেকে কোনো গন্ধ বেরুচ্ছে না। তবুও বলে, “ওরা তোমায় ঐ ছাই-পাঁশ গেলায়নি?”
— না–মানে–খেতে পারলাম না। কেমন যেন গা-টা ঘিনঘিন করে উঠলো। মুখে দিতে না দিতেই হড়হড়
করে বমি করে ফেললাম।
–কি বলছো তুমি!
–মদের গন্ধটা আমার কেমন যেন অসহ্য লাগলো। গা-টা এখনও পাক দিচ্ছে। আর আমি কোনদিন মদ খাবো না।
—সে-কি! এতদিনের অভ্যেস। একটু-আধটু না খেলে যে শরীর খারাপ করবে তোমার!
–না-গো, না। কিচ্ছু হবে না। আপদ নিজে থেকে বিদেয় নিয়েছে, ভালই হয়েছে। এতদিন হাজার চেষ্টা করেও মদ ছাড়তে পারিনি। মদ আমাকে খেয়েছে। আজ ইচ্ছা করেও মদ খেতে পারিনি। মদ আমাকে ছেড়েছে।
ছন্দার দুচোখে আনন্দের অশ্রুধারা। রিয়া বাকরুদ্ধ। বিস্ময়ে বিস্ফারিত দুই নেত্র। বাবার চোখের ওপর স্থির, নজরকাড়া, এবার জানে তার বাবার প্রকৃত ঘরে ফেরা। সংসারে অশান্তির ঝড়টা এবার থামবেই থামবে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।