বাসন্তীবালা বললেন, তোর দিদি ডিমের ডালনা করেছে। হাঁসের ডিমের।
অতনু রাগ দেখিয়ে বলল, গতকাল মাছ তো এনে রেখে দিতে পারতে!
বাসন্তীবালা বললেন, কি করে জানব বল্ ইন্দিরা গান্ধী পট করে মরে যাবে! নইলে তোর জন্যে কি আনাই না?
শশাঙ্ক পাল বাসন্তীবালার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এমন বলছ যেন মরে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধী খুব অপরাধ করে ফেলেছে! একটা ঘটনা ঘটেছে। তার ফল সবাইকে ভুগতে হচ্ছে। কেউ কচি খোকা নয়।
সবিতাপিসি বলল, আহা দাদা, ও তো ছেলেমানুষই।
শশাঙ্ক পাল সবিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, এইজন্য তুই বকুনি খাস্। বাপ মা যদি ছেলেদের শাসন না করবে, তো কি পাড়ার লোকেরা এসে করবে?
শ্যামলীর রাঁধা লাউয়ের তরকারির প্রভূত প্রশংসা করলেন শশাঙ্ক পাল। বললেন জানিস্, আমাদের ছোটবেলায় বিরাট যৌথ পরিবার ছিল। দাওয়াতে কলাপাতা কেটে নিয়ে বসে পড়তে হত। তখনও বাজারে অন্ধ্র আর বিলাসপুরের রুই কাতলা আসে নি। শরিকি পুকুরে জেলেদের মাছ চাষ করতে দেওয়া থাকত। রোজ মাছ আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। মাংস তো ভোজবাড়ি ছাড়া চোখেই দেখতে পেতাম না। বাড়ির লাগোয়া বাগানে কাঁচকলা, মোচা, থোড়, ডুমুর, পুঁই, লাউ, কুমড়ো বেশ হত। মা জ্যেঠিমারা বড়ি দিতে জানত। গয়নাবড়ি নামে বড়ি দিতে যে মেয়েরা শিখত, সবাই তাদেরকে বাহবা দিত। লাউয়ের খোসাটা পর্যন্ত মায়েরা ফেলত না। গোটা সরষে দিয়ে ভাজা করে দিলে তাই দিয়ে ভাত খেতাম। ওকে বলত ব্যাগলা ভাজা। তোরা কি জানিস, নিরামিষ রান্নাতেই রাঁধুনির গুণের পরিচয়!
শ্যামলী বলল, মা, চালতার আচার বের করি?
অতনু বলল, না না, আমাকে আমসত্ত্ব দাও।
বাসন্তীবালা বললেন, ঘরে তৈরি আমসত্ত্ব বাড়ন্ত হয়েছে বাবা, কাল তোমার জন্য আনিয়ে রাখব।
শশাঙ্ক পাল বললেন, লাউ আর তেঁতুল দিয়ে বেশ অম্বল রাঁধা যায়। কথায় বলে ঝোলের লাউ আর অম্বলের কদু! তোরা জানিস্ তো লাউ আর কদু একই জিনিস?
লাউয়ের গুণকীর্তন শুনে অতনুর অসহ্য লাগছিল। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, মা রাতেও কি এইসব হাবিজাবি খাওয়াবে?
শ্যামলী বলল, না রাতে ঘুগনি রাঁধব বলে মটর ভিজিয়ে রেখেছি। তাতে একটু নারকেল কুচো দেব।
শান্তনু বলল, মা আমি কিন্তু রুটি খাব না। আমার পরোটা চাই।
শশাঙ্ক পাল বললেন, হ্যাঁ রে, শুধু চাই বললেই তো হবে না। ঘি আছে কিনা সে খোঁজটা তো নিবি। এতটা বড় হলি, আজও যদি দশবছরের ছেলের মতো বায়না ধরিস, সেটা তো ভাল দেখায় না।
সবিতাপিসি অনেকক্ষণ ধরে কিছু বলার জন্য উসখুস করছিল। এবার বলেই ফেলল, ওদের দুঃখু কষ্টের গল্প শোনাও কেন দাদা? ওদের তো সেভাবে মানুষ করি নি কোনো দিন।
শশাঙ্ক পাল আবার বললেন, সবিতা, সব সময় বক বক করাটা ভাল না।
বাসন্তীবালা স্বামীর উপর রাগ দেখিয়ে বললেন, অ, শুধু তুমি একাই ভাষণ দিয়ে যাবে, আর অন্য কেউ কিছু বললেই তাকে দাবড়ে দেবে, তাই না?
শ্যামলী বলল, ঘি না থাকুক, বাদামের তেল আছে। আজ আমি হিংয়ের কচুরি রাঁধব, দেখি কে না খায়!
শশাঙ্ক বললেন, হ্যাঁ রে শ্যামলিমা, তুই এসব শিখলি কবে?
সবিতা বললেন, মেয়েমানুষকে রান্না শেখাতে হয় না। রান্না মেয়েদের রক্তে থাকে।
শশাঙ্ক বললেন, তোর ঘটে একটুও বুদ্ধি নেই সবিতা! বড় হোটেলে রেস্তোরাঁয় তো কোনোদিন নিয়ে যাই নি তোকে। গেলে দেখতিস হোটেলে ছেলেরাই রান্না করে।
বাসন্তীবালা বললেন, কতদিন পর আজ দুপুরে মেয়েটা বাড়িতে খাবে।
শশাঙ্ক বললেন, হ্যাঁ রে শ্যামলিমা, কলেজের ক্যানটিনে মুখরোচক খাবার বানায় জানি। ভাত ডাল কি করে হবে! তোর তো মর্ণিং কলেজ। দুপুরের খাবার হবে কি করে?
শ্যামলী বলল বাবা, আমি কালিঠাকুরের প্রসাদ পাই।
শশাঙ্ক পাল বললেন, সে কি রে? কালিঠাকুরের প্রসাদ মানে?
শান্তনু বলল, কোনো মন্দিরে খিচুড়ি বিলোচ্ছে দেখলে শালপাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় মনে হয়।
শ্যামলী ম্লান হেসে বলল, তা আমাদের দেশের শ্রীনিবাস রামানুজন দুটি অন্নের জন্য দোরে দোরে ঘুরেছেন। বলেছেন, আমি অঙ্ক করি, অঙ্ক নিয়ে থাকতে চাই। আমায় দুটো ভাতের বন্দোবস্ত করে দিন। হয় নি। জোটেনি। অঙ্কের নামকরা অধ্যাপকেরা পর্যন্ত তাঁকে বুঝতে পারেন নি, বুঝতে চান নি।
তীক্ষ্ণ চোখে শশাঙ্ক পাল নিজের কন্যার কাছে জানতে চাইলেন, কালিঠাকুরের প্রসাদটা ঠিক কি?
শ্যামলী বলল, আমাদের শহরে নৃত্যকালী দেবী নামে একজন দয়াবতী শিক্ষানুরাগিণী মহিলা ছিলেন। তিনি বয়েজ কলেজের রিডিং রুম গড়তে অনেক টাকা দান করে গিয়েছেন। নিয়ম করে গিয়েছেন যে সপ্তাহে অন্ততপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা সেখানে পড়াশুনা করলে কলেজের ক্যান্টিনে খাবারের কুপন মিলবে। আমি সেই কুপনে খাই।
শশাঙ্ক পাল খসখসে গলায় বললেন, কিন্তু কেন?
শ্যামলী বলল, পড়াশুনা না করলে কোথায় যাব বলো? রিডিং রুমের পরিবেশটা ভাল। খুশি মত বই টেনে নিয়ে পড়ি। আঠারো কবেই পেরিয়ে গিয়েছি বাবা। একুশ চলছে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে খুব ইচ্ছে করছে।