বড়োদের ছড়ার (৭-এ বাঁচে) সিরিজে সুশোভন ব্যানার্জী

(১)
লিখব ছড়া, মিঠেকড়া,
অদ্ভুতুড়ে রোদ্দুরে।
লিখব ছড়া, বাঁধনহারা,
মুক্তধারার সেই সুরে।
যে সুরে সব অহমিকা
আমিত্ব সব যায় ঘুচে,
আপন-পরের, কাছে দুরের,
শোক সন্তাপ যায় মুছে।
লিখব ছড়া, ভাঙাগড়ায়,
মান অভিমান, বিচ্ছেদে
আঁকব ছড়া, আগাগোড়া,
সব কবিতার প্রচ্ছদে।
শিখব ছড়া স্রোতের কাছে,
যার টানে সে যায় ছুটে,
সেই মোহনার সাতকাহনে,
যা বলে সে অস্ফুটে।
লিখব ছড়া, শিখব ছড়া
আঁকব ছড়া,সবখানে,
মাখব ছড়া, সকাল সাঁঝের
আড়ি-ভাবের আখ্যানে।
ভাসবে ছড়া অথই জলে,
বাঁচবে ছড়া বন্দরে,
নাচবে ছড়া খেয়াল খুশি,
সব মনেরই অন্দরে।
*****
(২)
আজ না জানি কোথাও উঠেছে ঝড়,
অতিবর্ষনে ভেঙে গেছে ঘর-বাড়ি,
আজকে না হয় আপন হয়েছে পর,
হিসেব রাখাটা তবু জানি দরকারী।
সময় চাইবে ফেরত অনেক কিছুই,
ধারবাকি আর সুদের বখরা নিতে।
পেটে ক্ষিধে নিয়ে মারা গেছে যত শিশু,
জঠরে তাদের আগামীকে এঁকে দিতে।
জবাব চাইবে নষ্ট কন্যাভ্রুণ,
কোন পাপে তার এমন হয়েছে সাজা?
কত এয়োতির সিঁদুরের গুমখুন,
জুড়েছে পালক তোমার মুকুটে রাজা?
আর কত হবে আর্থিক তছরুপ?
দুর্নীতিতে ডুবে গেছে আজ দেশ,
এসব প্রশ্নে রাজা তুমি আজও চুপ?
জবাব তোমায় দিতে হবে শেষমেশ।
*****
(৩)
উল্লাসে আজ রক্ত ঢেলেছি গ্লাসে,
অনায়াসে জয় করেছি মৃত্যুভয়,
হয় তো সেদিন নয়’কো বেশী দুর-
নাগরিক মনে কেটে যাবে সংশয়।
সে’দিন না’হয় জানোয়ার বলে ডেকো,
আজও মানুষ আছি তাই কান্নায়-
হীরা-পান্না’র উপমা খুঁজে মরি,
কবি মহলে আজও তাই মান নাই।
এ’খন কোথায় সেই অবতার-নবী,
ভবিষ্যতে সে আশা ম্রিয়মান,
প্রিয় নয় কেউ প্রয়োজন কাছে টানে,
নকল প্রেমে রোমাঞ্চ টানটান।
পাওনাগন্ডা ঠিকমত বুঝে পেলে,
“সব ঝুট হ্যায়” শ্লোগানে সুর মেলে,
স্বার্থ ফুরোলে আমি কে ভাই তোমার-
তুমিই বা কবে আমার আপন হ’লে?
*****
(৪)
একের পিঠে দুই চাপিয়ে এক করে দিই,
উপুড় হয়ে আকাশ দেখি গভীর রাতে,
ইচ্ছেগুলো তারার মত জ্বলে নেভে,
বিলিয়ে দিয়ে, মিলিয়ে যায় ভোরবেলাতে।
শিশির মেখে সকাল খোঁজে সম্ভাবনা,
স্বপ্ন দেখে রঙীন আলোয় রাতজাগা চোখ,
অল্পচেনা মুখের ভীড়ে দুপুর গড়ায়,
মনকেমনের বিকেল আনে না-ভোলা শোক।
সন্ধ্যে আসে নিয়মমাফিক, সময়মত,
বিষাদ ঘেরা সাঁঝবাতিতের টিউশনিতে,
পরিমিতির সুত্র মনের ক্ষেত্রফলে,
‘এক্স মানে তুই’-এই বুঝেছি বীজগণিতে।
ঘুমচোরা সেই রাত্রি আসে খানিক পরেই,
বাড়তি সময় নিয়ে হাতে রোজের মত,
বাড়ছে ক্ষত দ্বিগুন হারে, রক্ত-পুঁজও,
কাটাছেঁড়ার অভ্যাস তার সহজাত।
ক্ষিদে থেকে ঢেঁকুর অবধি নামতা গুনি,
পেয়েও হারাই সুখের চাবি স্বভাবদোষে।
আখর দিয়ে জীবনগানের ছন্দে মাতি,
অন্ত্যমিলের যন্ত্রণা পাই ছড়ার শেষে ।।
*****
(৫)
আমরা, যারা রোদ পাহারায় ছুটছি,
হোঁচট খেয়ে পড়ছি,আবার উঠছি,
ক্ষতের গায়ে হাত বুলিয়ে ফের
ভ্রান্ত সুখের প্রান্তসীমায় জুটছি।
আমরা, যারা বেসাহারা দিনে,
আপন-পরের মুখ নিয়েছি চিনে,
অভিজ্ঞতায় ভরসা করে ঢের
খুব ঠকেছি টাটকা গোলাপ কিনে।
আমরা, যারা রাঙতামোড়া বিষ
অজান্তে পান করেছি অহর্নিশ,
ভুলের মাশুলে সব হিসেবের জের
মিটে গেছে-বলে রটে গেছে ভাগ্যিস।
আমরা, যারা কিছুই পারিনা আর,
কিছু লিখব ভেবে হয়ে যাই জেরবার,
অন্ত্যমিলের যন্ত্রনা পাই টের
ছড়া ভালোবাসি, পুজো করি কবিতার।
*****
(৬)
কেউ আড়চোখে দেখে সরে যায়
কেউ দুরে থেকে পেয়ে যায় আঁচ
কারো হাট খোলা আজও দরজা
কারো আধভাঙা জানলার কাঁচ।
কিছু বিশ্বাস বাঁচে অছিলায়
কিছু আপোসের লাল মোড়কে
কিছু ভুল বোঝাবুঝি রাস্তা
গিয়ে মিশে যায় ভুল সড়কে।
সব পেয়ে হারানোর স্বভাবে
অভাব বোঝে না মনফকিরা
কেউ ছেড়ে যায় মাঝরাস্তায়
থাকে সুযোগের খোঁজে বাকিরা।
*****
(৭)
তখন তুমি খুব চুপচাপ, দু’বিনুনী চুল,
সদ্য শেখা বীজগণিতে হাজার মজার ভুল।
বাইসাইকেল,বেআক্কেল,মাতাল প্যাডেল, চেন,
সবে সেভেন তোমার তখন, আমার ক্লাস টেন্।
শাড়ির আঁচল পোষ মানে না,আলগা সেফটিপিন,
সোম টু শনির ধারাবিবরনী, ছকবাঁধা রুটিন,
রবি’র ছুটি, দিন হুটোপুটি, তোমার পাড়ায় মাঠ,
মিড অন ছুঁতো খুড়তুতো বোন, তোমাকে স্কোয়ার কাট,
স্লিপ বা গালি,শুধু শালা শালি, ফুলকাকিমার শাড়ি-
আড়াআড়ি মিলে, কাকুর আঁচিলে আদরের কাড়াকাড়ি।
দাদা -বন্ধুরা জোরে শিষ দিত, মিস হতো শর্ট পিচ,
তখনো শিখিনি ডিচ করা মানে বা কাকে বলে বিচ।
নিরামিসহুডে ন্যুডিটি ছিল না, নিষ্পাপ ছোঁয়াছুঁয়ি,
লোকে কি বলবে, ভেবেই হঠাৎ, ‘তুমি’ হয়ে গেলে ‘তুই’।
সময় গড়াল, বছর পাঁচেক, তোমার কলেজ গেটে পা,
প্লেন গ্রেজুয়েট, করে মাথা হেঁট, আমার টিউশনিতে চা-
বিস্কুট পেলে মিনিট পনেরো, ঘড়ির কাঁটায় লেট,
বাবা রিটায়ার্ড, আমিও ক্লান্ত, ঘরে তিনখানা পেট।
একদিন দেখা, ফিরছিলে একা, থমকে দাঁড়ালে পাশে,
কিছু কথা বাকি রয়ে গেছে নাকি,জানতে চাইলে শেষে-
শুনে গেছি শুধু, কিছুই বলিনি, কিবা ছিল আর বলার-
পরের মাসেই আমাদের বিয়ে, শুরু হল পথচলা।
খুবই সাধারণ, জীবনযাপন, হরেকরকম বাধা,
তবু সয়ে যাই, সুখ বয়ে যায়, কভি কম কভি জিয়াদা।
এখন তুমি খুব কথা বলো, আমি চুপ করে শুনি,
চেনা জানলায় উঁকি দিয়ে যায় অচেনা ফাল্গুনী।