শিকড়ের সন্ধানেতে আজ “প্রাচ্যের ব্রাইটন :দীঘা” – লিখেছেন রাজদীপ ভট্টাচার্য্য

১৭৮০ সাল নাগাদ ওয়ারেন হেস্টিংস তার স্ত্রী সিডনি সি. গ্রেয়ারকে চিঠিতে লিখছেন – “Beercool was the sanitarium, the Brighton of East…”।
মীর কাশিম নবাব হয়ে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মেদিনীপুর অঞ্চল ইংরেজ সরকারকে উপঢৌকন হিসেবে দেন। এর ফলে এই এলাকায় ইংরেজদের আনাগোনা বাড়ে। তখন পূর্ব ভারতে ইংরেজ ক্ষমতার চূড়ায় ওয়ারেন হেস্টিংস। তাই তিনি একাধিকবার মেদিনীপুর জেলায় যান। এমনই কোন সময়ে তিনি প্রথম বীরকুলে আসেন। সমুদ্রতীরবর্তী এলাকাটি তাঁর ভারি পছন্দ হয়। প্রকৃতপক্ষে ইউরোপিয়ানরা ভারতের উষ্ণ আর্দ্র জলবায়ুর সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে বারবার নাজেহাল হয়েছেন এবং নিজের মাতৃভূমির ছায়া খুঁজে পেতে চেয়েছেন এই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এভাবেই দার্জিলিং, সিমলা বা মুসৌরির আবির্ভাব। সেই তালিকায় আরেকটি নাম সেদিনের বীরকুল যা আজকের জনপ্রিয় গন্তব্য ‘দীঘা’।
প্রাথমিকভাবে হেস্টিংস এখানে একটি বাংলো তৈরি করান। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের এইসব নদী-নালা প্রধান এলাকায় যাতায়াত তখন একান্তই দুঃসাধ্য। তার উপরে উপকূল এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রাবল্য। ফলে ইউরোপিয়ানদের যাতায়াত ক্রমশ কমে আসে। ১৮২৩ সাল নাগাদ অপর একদল পর্যটকদের বিবরণ থেকে জানা যায় তখন এই অঞ্চল ঘনবন ও ম্যানগ্রোভে ঢাকা। বুনোজন্তু আর সরীসৃপের আড্ডা। আজকের দীঘা হয়ে ওঠার পথে যাত্রা শুরু করার জন্য তখনো রয়ে গেছে একশো বছরের দীর্ঘ অপেক্ষা।
ঊনবিংশ শতকের শেষে কলকাতার এক নামি বিজনেস হাউস “Hamilton & Co”। তারই কর্ণধার John Frank Snaith (14 August 1882 – 18 December 1964)। যতদূর সম্ভব জন সাহেবের অন্যতম কাস্টমার ছিলেন বালিসাহির জমিদার। তিনিই প্রথম জনকে বীরকুলের সৌন্দর্যের কথা বলেন। ১৯২১ সালে জন স্নেথ কাঁথি হয়ে হাতির পিঠে চেপে বীরকুলে পৌঁছান। নীল আকাশের নিচে চঞ্চল সমুদ্র, দীর্ঘ সোনালী সৈকত – এসব দেখে তিনি আত্মহারা হয়ে যান। কলকাতায় ফিরে সরকারের কাছে বীরকুলে খানিকটা জমির জন্য আবেদন করেন। অবশেষে সাড়ে এগারো একর জমি বরাদ্দ হয়। স্থপতি H. A. Cloy এর তত্ত্বাবধানে সেখানে ‘Runswick House’ তৈরি হয়। সেই সময়ে বেহালা ফ্লাইং ক্লাব থেকে প্রতি সপ্তাহে জন স্নেথ নিজের টু’সিটার এরোপ্লেনে চড়ে বীরকুলে আসতেন। একসময় ব্যবসা আত্মীয়ের হাতে ছেড়ে তিনি স্থায়ীভাবে এখানেই বসবাস শুরু করলেন। জন স্নেথের অনুরোধেই মহিষাদল রাজবাড়ি থেকে সেখানে অট্টালিকা, স্কুল প্রভৃতি গড়ে উঠল।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে ইংরেজরা একে একে ফিরে গেলেন স্বদেশে। কিন্তু জন পড়ে রইলেন বঙ্গোপসাগরের তীরে এক অখ্যাত সমুদ্রসৈকতে এবং বরাবর তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা রইল বীরকুলকে কিভাবে পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলা যায়। তাঁর অনুরোধক্রমেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় স্বপ্ন দেখলেন সমুদ্রতীরের এই বেলাভূমিকে নিয়ে। অবশেষে ১৯৫৬ সালে বিধান রায় দীঘাকে ঘিরে একটি পরিকল্পনা নিলেন। ১৯৬১ সালে পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর উপস্থিতিতে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হলো। ধীরে ধীরে দীঘা হয়ে উঠল “far from the madding crowd” বাঙালি জীবনের অঙ্গ।
তবে আরো প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলটি যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল। দীঘা থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে মীরগোড়ায় আছে লঙ্কেশ্বরী মন্দির। এই দেবীমূর্তি আনা হয়েছিল সুদূর শ্রীলঙ্কা থেকে। তাই প্রাচীন যুগে এই অঞ্চলের সাথে যে জলপথে বিদেশের যোগাযোগ ছিল তা প্রমাণিত। সামুদ্রিক বন্যা থেকে বাঁচতে মুঘল আমলে এখানে দেওয়া হয়েছিল বাঁধ। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুন্ডলা উপন্যাসেও এই এলাকার বর্ণনা পাওয়া যায়।
ভৌগোলিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে দীঘার সমুদ্র সৈকত ৬ কিমি দীর্ঘ, ১২০-৩০০ মিটার প্রশস্ত। প্রকৃতিতে সুস্থায়ী, সমতল ও সুগঠিত। হেলিকপ্টার এমনকি ছোট বিমানও এখানে নামতে পারে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে দীঘা সৈকত প্রতিবছর ১৫ সেমি হারে অবনমিত হচ্ছে এবং গড়ে বছরে ৮ মিটার করে ক্ষয় পেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। এই স্বাভাবিক ক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যই বোল্ডার ফেলে সৈকতকে রক্ষা করার অবিরাম প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হয়েছে।
সমুদ্র সন্নিকটে অবস্থানের জন্যই দীঘার জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ। উষ্ণতা গ্রীষ্মে সর্বাধিক ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে শীতে সর্বনিম্ন ১৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। তাই পর্যটকরা সারাবছর এখানে আসতে পারেন। তবে গ্রীষ্মের শুরুতে আর শরৎকালে ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনা থাকে।