শিকড়ের সন্ধানেতে আজ “বেনারস” – লিখেছেন প্রাপ্তি সেনগুপ্ত
১. মার্ক টোয়েন যে শহরকে ইতিহাস, সভ্যতা, ঐতিহ্য এমনকি কিংবদন্তির থেকেও পুরোনো বলেছেন, সেই শহর হল বেনারস,বাঙালির আপন বাংলায় কাশী।
২. কাশ শব্দের মানে জ্যোতি,তার থেকে কাশী। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাসে এই শহর তিন হাজার বছর আগে তৈরি হয়। গঙ্গানদীর উত্তরদিকে অবস্থিত, এই শহরের নামটি এসেছে সম্ভবত বরুণা ও অসি দুটি নদীর নাম থেকে।
৩. ঋকবেদে এবং স্কন্দপুরাণে এই শহরকে কাশী বলা হয়েছে। তবে বিভিন্ন যুগে বারাণসী কাশী, কাশিকা, অবমুক্ত, আনন্দবন, রুদ্রবাস প্রভৃতি আলাদা আলাদা নামে অবিহিত হয়েছে।
৪. লোককথায় মহাদেব স্বয়ং এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা। স্কন্দপুরাণের বর্ণনায় কাশী হল মহাদেবের রাজপ্রাসাদ। মহাভারতের কাহিনীর সূত্রানুসারে পান্ডবরা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর ভ্রাতৃহত্যা ও ব্রহ্মহত্যার মতো পাপ থেকে উদ্ধার পেতে মহাদেবের খোঁজে এই শহরেই এসেছিলেন।
৫. এই শহর মোক্ষলাভের ভূমি। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন এখানে মৃত্যু ও দাহ হলে পুর্নজন্ম থেকে মুক্তি ঘটে।
৬. হিন্দু ও জৈন বিশ্বাসে সাতটি শহরের (সপ্তপুরীর) মধ্যে একটি বারাণসী। কাশী বিশ্বনাথ মন্দির, দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের একটি আর এখানের বিশালাক্ষী মন্দির হল শক্তিপীঠের একটি, এখানে সতীর কানের দুল পড়েছিল।
৭. বহুবার বহিরাগত শত্রুর দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে এই কাশী আর তার মন্দিরগুলি। দ্বাদশ শতাব্দীতে মহম্মদ ঘোরি কাশীর বহু মন্দির লুঠ করেন। তারপর কুতুবউদ্দিন আইবেক, ফিরোজ শাহ, সিকন্দর লোদিও ক্ষতি করেন বারাণসীর। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই শহর আজকের রূপ পেয়েছে। মোগল সম্রাট আকবরের আমলে বেনারসের চোখে পড়ার মত উন্নতি হয়।
৮. বারাণসীর কাছে সারানাথে তথাগত প্রথম বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। এই বেনারসেই আদি শঙ্করাচার্য তাঁর বিখ্যাত টীকাগুলি রচনা করেন। এখানের কোনো ঘাটে বসেই তুলসীদাস লেখেন রামচরিতমানস।
৯. কাশী নরেশের পৃষ্ঠপোষকতায় এই মন্দির নগরী হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বারাণসী ঘরানার জননী।
১০. এখানে ১৯২৩ সাল থেকে পাঁচদিনব্যাপী পালিত হয় সংকটমোচন সঙ্গীত সমারোহ। সারাদেশের বিশিষ্ট শিল্পীরা এতে যোগ দেন।
১১. কবীর, রবিদাস থেকে আধুনিককালের রবিশঙ্কর, ওস্তাদ বিসমিল্লা খান, গিরিজা বেগম প্রমুখ মহান ব্যক্তিত্বের জন্মস্থান এই বেনারস।
১২. এখানকার প্রধান আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে এখানকার গঙ্গার ঘাট গুলি (দশাশ্বমেধ, মণিকর্ণিকা, অসি, পঞ্চাঙ্গ, হরিশ্চন্দ্র প্রভৃতি) আর তার সরু গলি। বেনারসি সিল্ক, বেনারসি পান, বেনারসের গলির লস্যি, সুগন্ধী, হাতির দাঁতের কাজ বা বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি সমস্ত ঐতিহ্যের মিশেল এই আলোক-নগরী।
১৩. প্রতি সন্ধ্যায় কাশীর ঘাটের গঙ্গার পূণ্যারতি সারা বিশ্বের ফটোগ্রাফারদের কাছে এক বিস্ময়।