এরকমই হাজার এক গল্প আছে লোয়ার সার্কুলার রোডের সিমেট্রির । এর ভিতরে ঢুকে একটু এগোলেই উইলায়াম হে ম্যাকন্যাথেন এর সমাধি। প্রথম আংলো আফগান যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ম্যাকন্যাথেন। তাঁর মৃত্যু নিয়েও নানা তত্ত্ব ঘুরে বেড়ায় ইতিহাসের অলিন্দে।একদল মনে করেন তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। বিশ্বাসভাজন কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তার সঙ্গে। অনেকে বলেন শত্রুপক্ষ তার মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন বন্দুকের নল। ঘটনা যাই হোক তারপরের ঘটনা নৃশংশতার চূড়ান্ত…. মারা যাওয়ার পর তার দেহ ছিঁড়ে কেটে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হয়। তাঁর স্ত্রী সেই টুকরো টুকরো খণ্ডিত দেহ সেলাই করেন। এর পর সেই সেলাই করা দেহ সমাধিস্থ করা হয়। জনশ্রুতি দেহ সেলাই করার সময়েও নাকি তাঁর প্রাণ পুরোপুরি বের হয় নি। তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘কাউকে ছাড়ব না।’অত্যাচারী সাহসী মেগালম্যানিয়াক এই লোকটির সমাধি এড়িয়ে চলে সবাই লোয়ার পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতে। আর যদি কেউ সমাধির কাছে গিয়ে এই গল্প বলে তাহলে প্রবলভাবে নড়ে ওঠে ওপরের গাছ।
তবে ইতিহাস কথা বলে ওঠে এই সিমেট্রিতে । এখানে আছেন তৎকালীন হিন্দু কলেজের প্রথম প্রিন্সিপ্যাল জেমস আইজ্যাক ডি অ্যানসেল্ম।অনেক কষ্টের পর এখানে শান্তিতে শায়িত বাঙালীর মধুকবি …আর সমাধিফলকে অনবদ্য কিছু চিরকালীন পংক্তি…
“দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম)মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ি কপোতাক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী”
আরেকটু যদি এগোন , তাহলে লোয়ার সার্কুলার রোড এর এই গোরস্থানে খুঁজে পাবেন একটি অত্যন্ত অপাঙ্ক্তেয় একটি পাথর যার নিচে শুয়ে আছেন মারিয়া ম্যাডেলিন টেইলর..১৮৪১ এর ১৩ই মে থেকে ! কে ইনি?
সুদূর অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে কেরিয়ারের শুরু এই কোকিলকন্ঠী গায়িকা ও অভিনেত্রীর।অভাবজনিত কারণে প্রথম স্বামীকে ত্যাগ করে বিয়ে করেন এক বাণিজ্যিক জাহাজের ক্যাপ্টেন পিয়ের সার্গেট কে! সম্পদ বলতে একটিমাত্র জাহাজ …. সেই জাহাজ বেচে ভাগ্যের সন্ধানে দুজনে চলে এলেন সুদূর কোলকাতাতে আর সেই সঙ্গে পার্ক স্ট্রিটে একটা বাড়ি ভাড়া করে একেবারে ‘ব্যারন’ সেজে বসলেন ! ক্যাপ্টেন নতুন নাম নিলেন হেনরি ডারমেনভিল সেই সঙ্গে মাদাম ডারমেনভিল নামে আত্মপ্রকাশ করলেন এবার মাদাম ম্যাডেলিন…. এদিকে পার্ক স্ট্রীটে তখন নতুন থিয়েটারের মঞ্চ সাঁ সুসি…. বর্তমান সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ….কিন্তু অভিনেত্রী এসথার লিচের আধিপত্যে সেখানে জায়গা হলো না মাদাম ডারমেনভিলের।সুতরাং তিনি নিজের নাটক মঞ্চস্থ করতে এগিয়ে এলেন …. নাটকের নাম ‘The Taming of the Shrew’ এবং নায়িকা ক্যাথেরিনের ভূমিকায় মাদাম ডারমেনভিল ! কিন্তু উপস্থাপনার আগের রাত্রে প্রাণ হারালেন ব্যারন হেনরি ডারমেনভিল।নাটক গেল পিছিয়ে…তো নতুন করে ধার্য দিনে নাটক মঞ্চস্থ হলো …. উতরেও গেলো ভালোমতো…. ইতিমধ্যে মাদাম ডারমেনভিলের বন্ধুত্ব ঘনিষ্ঠ হয়েছিলো ফায়ার ইনসিওর কোম্পানীর এক কর্মী মি: কক্সের সঙ্গে .. কিন্তু আদতে কক্স ছিলেন বিবাহিত ..।নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার দিনই তিনি দেশ থেকে চিঠি পেয়েছিলেন স্ত্রী পুত্র কন্যাসহ ভারতে আসছেন। দুদ্কের টানাপোড়েন সামলাতে না পেরে কক্স মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন….আর কদিন পর মারা যান মিসেস টেলর ওরফে ডারমেনভিল ওরফে মারিয়া ম্যাডেলিন । আর সেই পরিচয় বুকে নিয়ে চুপ আজও লোয়ার সার্কুলার রোডের কবরটা … না কারোর কন্যা, না কারোর স্ত্রী… তিনি একজন নারী … মানবী … ২৭ বছরে থেমে শাওয়া মেয়েটি কি আজো জীবনের গল্পই শোনাতে চায়…??
এইরকমই আশ্চর্য গল্প তিরেত্তার …. যাঁর নামে এখনকার টেরিটি বাজার। তাঁর পত্নী অ্যাঞ্জেলিকা মারা গেলে তাঁকে তিরেত্তা সমাধিস্থ করলেন শিয়ালদার বৈঠকখানা বাজারের পর্তুগিজ সিমেট্রিতে।সম্ভবত স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে পর্তুগিজ সিমেট্রি কর্তৃপক্ষ আ্যঞ্জেলিকার সমাধিটিতে অন্যকোনো ব্যক্তির শবাধার রাখার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্তে অসম্মত ক্ষুব্ধ তিরেত্তা নতুন জমি কিনে সমাধি দেন আদরের স্ত্রী অ্যাঞ্জেলিকাকে এবং সেই সঙ্গে ঘোষণা করেন … ইওরোপের যে কোন দেশের যে কোন ক্যাথলিকের জন্য খোলা রইলো এ গোরস্থান …।তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সময়ের সাথে শহর সম্প্রসারনের সময় গুড়িয়ে গিয়েছে অ্যাঞ্জেলিকার শেষ চিহ্নটুকুও। তিনি রয়ে গেছেন শুধু বেঙ্গল অবিচুরির পাতায়।
কত গল্প … অজস্র ইতিহাসের মনিমাণিক্য … কিন্তু
এর মাঝেই আবার এমন অনেক সমাধি আছে যার কোন গল্প নেই ….ইতিহাস নেই … তাদের গল্প জানে শুধু অতীত দিন আর তাই তো আজও শহরের বুকে অফুরন্ত সবুজ মেখে শুয়ে থাকে অতীত … একদিন যারা ছিলো এই শহরের বর্তমান তাদের অস্তিত্ব শুধু কিছু এপিটাফ ট্যাবলেট কিংবা ওবেলিক্সে আর সমাধিফলকের দেওয়ালে … কিংবা তাও নেই ….
আসলে হাজার মিথ্যের ভিড়ে মৃত্যুই বোধহয় একমাত্র সত্য, যাকে এড়ানো যায় না কোনও ভাবেই। সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত, সহজ, অবশ্যম্ভাবী একটা পরিণতির নাম মৃত্যু। আর সেই মৃত্যু গায়ে জড়িয়ে নরম আলোর ভাঁজে শুয়ে থাকে আমার মাটির নীচের কোলকাতা।।