• Uncategorized
  • 0

প্রবন্ধে অসিকুমার

পশ্চিমবঙ্গ শিবপুরের তদানীন্তন বিক্কলেজ (অধুনা আইআইইএসটি) এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রাক্তনী| পরবর্তীতে ম্যানেজমেন্ট গ্রাজুয়েট| দীর্ঘ তেইশ বছরের চাকরি জীবনে দেশের নানা প্রান্তে নানা ভাষাভাষীর লোকজনের সাথে কাজ করেছেন| ঘুরতে ভালোবাসেন| নিছক কাজের তাগিদে নয়, অকাজে এবং কৌতূহলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর ও পেশার মানুষের সাথে নানান বিষয়ে মত বিনিময় করতে ভালোবাসেন| রাজনীতি, ভ্রমণ, ফটোগ্রাফি, মুভিস আর লেখালেখি পছন্দের বিষয়
চাঁদের প্ৰিয় চাঁদ
হায়, করলো বিবাদ !
ক্রোধী চ্যাংমুড়িকানি ;
ডাঁশে কালনাগিনী |
লখিন্দর, ওঠো !
ভেলায় ভাসছে প্রাণ ,
বেহুলার সাম্পান |
বুঝি চিরঘুমে ঢলে ,
সাপের ছোবলে –
লখিন্দর, জাগো !
দেখো স্বর্গদ্বার –
নদীর কিনার |
পারিজাত-ঘ্রাণ
দিয়েছে জানান –
লখিন্দর, দেখো !
বেহুলার নাচ –
খুশি স্বর্গরাজ |
দেববরদান ,
সোয়ামি’র প্রাণ |
লখিন্দর, হাসো !

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-এর এক অন্যতম মহান সৃষ্টি ‘মনসা মঙ্গল কাব্য’| ওপরের চার ছত্রের কবিতায়, প্রায় বাদামের খোলার মধ্যে পুরে (যাকে ইংরাজিতে in a nutshell বলে) অত বড় কাব্যের মূল কাহিনী পরিবেশনের প্রয়াস করেছি!

শিবের মাথায় বা জটায় অর্ধচন্দ্র বা crescent moon বিরাজমান বলে ওনাকে চন্দ্রকান্তও বলা হয়| ওই চন্দ্রকান্ত নামটা ছোট করে চাঁদ বলেছি| আর, ‘চাঁদের প্ৰিয় চাঁদ’ – এর অর্থ হল, চন্দ্রকান্ত বা শিবের প্ৰিয় চাঁদ সওদাগর, যাঁর পুত্র লখিন্দর এবং পুত্রবধূ বেহুলা|
শিবের মেয়ে ছিলেন মনসা| মনসা মর্তে ওনার পুজোর প্রচলনের জন্য বিখ্যাত সওদাগর চাঁদ-এর দ্বারস্থ হন| চাঁদ আবার শিবের উপাসক ছিলেন বলে অন্য দেবতাদের উপাসনায় ইচ্ছুক ছিলেন না| মনসার অনেক অনুরোধের পরেও চাঁদের একগুঁয়ে আচরণ এবং পরে চাঁদের মনসাকে অপমানের হেতু মনসা ওনার সহচরী বিষাক্ত কালনাগিনীকে দিয়ে বিবাহবাসরেই চাঁদের পুত্র লখিন্দরকে হত্যা করেন| কিন্তু, কি সেই অপমান যার জন্য এত বড় শাস্তি?
চাঁদের স্ত্রী সনকা স্বামীকে লুকিয়ে মনসার পুজো করেন| স্ত্রী সনকার এরূপ আচরণে যারপরনাই ক্রুদ্ধ হয়ে চাঁদ তাঁর হেতালের লাঠি (সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের এই হেতাল গাছের জঙ্গলেই বাঘমামা বা বাবা দক্ষিণ রায় স্বয়ং লুকিয়ে থাকেন) দিয়ে মেরে মনসার একটা চোখ কানা করে দিয়েছিলেন| ‘চ্যাং মুড়ি কানি’ মনসার আর এক নাম| চ্যাং মুড়ি শব্দদুটির কোনও উৎস বা অর্থ আমার জানা নেই; তবে, কানি শব্দটার উৎস যে ওই এক চোখ কানা হওয়ার ঘটনা, তাতে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়|
কাব্যের শিব, চাঁদ, সনকা, লখিন্দর, বেহুলা এরা সব্বাই সমাজের elite class এর representatives; অন্যদিকে, মনসা বা কালনাগিনী এরা সমাজের subaltern class এর representatives|
যে কোনও সমাজে, elite class যে কখনোই subaltern দের প্রাধান্য বা আধিপত্য গ্রাহ্য করেনা, সেটা ‘মনসা মঙ্গল কাব্য’ তেও সমানভাবে দেখানো হয়েছে|
Elite চাঁদ বণিকরা তখনই subaltern মনসাদের সম্মান করে যখন চাঁদ বণিকদের স্বার্থে আঘাত আসে!
নভেল করোনা ভাইরাস জনিত pandemic এবং তার consequence হিসেবে যে lockdown চলছে, সেই কারণে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে দিনমজুররা, রিকশাওয়ালারা, মুচিরা, ধোপারা, ফুচকাওয়ালারা, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকরা, পরিযায়ী শ্রমিকরা, ছোটখাটো কারখানা বা উৎপাদন শিল্পের শ্রমিকরা এবং আরও যত অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিক আছে তারা| তাদের দুরকম বিপদ| কাজে না গেলে টাকা রোজগার হবে না আর তাই ঘরে বসে অনাহারে মৃত্যু| আবার, কাজে বেরোলে কোভিড-19 এ আক্রান্ত হওয়ার বিপদ! এদের কাছে physical distancing একটা বিশাল বড়ো ঠাট্টা বই কিস্যু নয়! কজন ইঁটভাটা শিল্পের শ্রমিকের বা ছুরি-কাঁচি-বঁটি শান দেওয়া কামারের পাঁচ-কামরার বাড়ি আছে যেখানে কোনও পারিবারিক সদস্য চাইলে একান্তে বা personal isolation এ গিয়ে থাকতে পারে?
অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে, ইতিমধ্যেই প্রায় চল্লিশ কোটি ভারতীয় দারিদ্রসীমা’র নীচে চলে যেতে বসেছে| এই হতদরিদ্র ভারতীয়রা যদি খিদের তাড়নায় তাদের আর্থিকভাবে সক্ষম সহ-নাগরিকদের থেকে টাকা, খাবার, সোনা-দানা অলংকার ইত্যাদি চুরি-ছিনতাই করে, তাহলে এক ভীষণ আইন-শৃঙ্খলা’র প্রশ্ন কি উঠবে না?
যত দিন যাচ্ছে, এই ধারণাই মানুষের মনে বদ্ধমূল হচ্ছে : করোনা জনিত এই আর্থ-সামাজিক সমস্যা elite দের দ্বারাই বিদেশ থেকে বাহিত; এই দীর্ঘ lockdown এর সিদ্ধান্ত কেবল elite দেরকেই বাঁচানোর জন্য (প্রধানমন্ত্রীর balcony তে দাঁড়িয়ে হাততালি বা বাতি জ্বালানো অথবা চিকিৎসকদের self isolation এর নিদান কোথাও এই elite class কে মাথায় রেখে বলেই মনে হয়)…অথচ, সমস্ত কিছুর দায়ভার কেবল subaltern দের ঘাড়েই!
‘মনসা মঙ্গল কাব্য’-এর চ্যাং মুড়ি কানি মনসা আর কালনাগিনী দের মতো এখন যদি subaltern রা elite চাঁদ, বেহুলা, লখিন্দর দের আক্রমণ করে বা ক্ষতি করার চেষ্টা করে?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।